বিখ্যাত নাট্যকার গুয়ান হান ছিং

       চীনের সাহিত্য ও নাট্যকলার ইতিহাসে ইউয়ান রাজত্বকালের নাট্যকার গুয়ান হান ছিং সর্বাপেক্ষা মহান লেখকদের অন্যতম।তাঁর রচিত বিয়োগান্ত নাটক“ দৌ এয়ের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ ” সাত বছর ধরে চীনে অভিনীত হয়েছে ।এই বিয়োগান্ত নাটক বহু বিদেশী ভাষায় অনুদিত হওয়ায় তাঁর খ্যাতি সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে । 

  গুয়ান হান ছিং জীবিত ছিলেন ত্রয়োদশ শতকে ।তিনি বুদ্ধিমান,রসিক , ও প্রাণোচ্ছল। তাঁর পাণ্ডিত্য অতুলনীয় । তিনি কবিতা আবৃত্তি, বীণা ও বাঁশি বাজানো, নাচ , দাবা খেলা এবং বন্যপশু শিকারে পারদর্শী ছিলেন । তিনি অনেক বছর ধরে রাজধানীতে থাকতেন , একসময়ে তিনি রাজকীয় হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্বপালন করেছিলেন ,কিন্তু চিকিত্সা বিদ্যার বদলে নাটক রচনা করতে তিনি অধিক আগ্রহী ।ইউয়ান রাজত্বকালে জাচু নামক চতুরাংক নাটক প্রচলিত ছিল ।জাচু বিষয়বস্তুর দিক থেকে কথকতা থেকে অধিক সমৃদ্ধ বলে এবং সমাজ সচেতন বলে অভিজাত সম্প্রদায় ও সাধারণ মানুষ উভয়ই তা দেখতে পছন্দ করতেন । তবে অভিজাত সম্প্রদায়কে চিত্তবিনোদনের সুযোগদানের পরিবর্তে জনসাধারণের দু:খদুর্দশা ফুটিয়ে তোলাই গুয়ান হান ছিংয়ের জাচু নাটক রচনার উদ্দেশ্য । 

  ইউয়ান রাজবংশের কুশাসনের জন্য তদানীন্তন সমাজ অস্থিরতায় টলমল করছিল ।শ্রেণীগত দ্বন্দ্ব ও জাতীয় দ্বন্দ্ব দিন দিন তীব্র আকার ধারণ করে । নিরপরাধ মানুষদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগে যে কত মামলা দায়ের করা হয়েছিল তার ইয়ত্তা নেই । সকল জাতির মেহনতী জনগণ দু:খকষ্টে জীবন যাপন করতেন । সমাজের নীচু স্তরের মানুষদের প্রতি গুয়ান হান ছিংয়ের প্রগাড় মমত্ববোধ ছিল। রাজকর্মচারীপদে ইস্তফা দিয়ে তিনি সমাজের নীচু স্তরের মানুষদের মধ্যে গিয়ে তাঁদের খোঁজ খবর নিতেন ।তারপর তিনি নাটকে সমাজের কদর্যতা উদঘাটন করে সুন্দর সমাজ গড়ার স্বপ্ন রুপায়নের প্রয়াস চালাতেন । 

   গুয়ান হান ছিং অপূর্ব শিল্পচাতুর্যের অধিকারী , তদুপরি তিনি জনসাধারণের দুরবস্থার খবর রাখতেন এবং তাঁদের ভাষা জানতেন , তাই তাঁর পক্ষে জনপ্রিয় নাটক রচনা সহজ হয়েছে ।তখন অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সামাজিক অবস্থান নেহায়েত নীচু ছিল , কিন্তু গুয়ান হান ছিং নি:সংকোচে তাঁদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন ,এমন কি স্বতস্ফুর্তভাবে নাটক পরিচালনা করতেন এবং নাটকের ভূমিকায় অবতীর্ন হতেন । তাঁর নাটকে শুধু যে সমাজের জীবন্ত চিত্র অঙ্কিত হয় তা নয় , অদম্য সংগ্রামী মনোবলও অনুভব করা যায় ;শুধু অমানসিক জুলুমে নিপীড়িত মেহনতী মানুষের আর্তনাদ শোনা যায় তাই নয় ,তাঁদের সরলতা, সাহসিকতা এবং অন্যায়ের বিরূদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সহজাত শক্তির পরিচয়ও পাওয়া যায় । 

  জনপ্রিয় নাটক “ দৌ এয়ের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ ” গুয়ান হান ছিংয়ের প্রতিনিধিত্বকারী রচনা । এই নাটকে তরুণী দৌ এয়ের শোচনীয় জীবনকাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। এই নাটক চীনের দশটি প্রসিদ্ধ প্রাচীন বিয়োগান্ত নাটকের কাতারে স্থান পেয়েছে এবং গত কয়েক শতকে চীনা দর্শকদের কাছে সমাদৃত আর প্রসংশিত হয়েছে ।  

  জীবিতকালে গুয়ান হান ছিং ছিলেন নাট্যাঙ্গনের শীর্ষস্থানীয় নাট্যকার ।তাঁর নাটক তত্কালীন মেহনতী জনসাধারণের অত্যাচার বিরোধী সংগ্রামে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলো এবং পরবর্তীকালের নাট্যকলার উপর বিরাট প্রভাব বিস্তার করেছিল । তিনি মোট ৬৭টি নাটক রচনা করেছিলেন ,তবে মাত্র ১৮টি নাটক এখন সংরক্ষিত।তিনি যেমন হৃদয়গ্রাহী চরিত্র গঠনে নৈপুন্য দেখিয়েছেন তেমনই চরিত্রের জটিল মনোবৃত্তি প্রকাশে কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন । তাঁর মত এতবেশী মনোমুগ্ধকর চরিত্র নির্মাতা দ্বিতীয় নাট্যকার চীনের প্রাচীন নাট্যাঙ্গনে আবির্ভুত হয় নি। 

   গুয়ান হান ছিংয়ের নাট্যসৃষ্টি চীনের নাট্যকলা ও সাহিত্যের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছে । তিনি ইউয়ান রাজত্বকালের নাট্যকলার স্রষ্টা বলে পরিচিত । বিশ্ব সাহিত্য ও শিল্পকলার ইতিহাসেও তিনি সুখ্যাতির অধিকারী ।তাঁকে প্রাচ্যের শেকসপিয়র বলে আখ্যায়িত করা হয় ।