খ্রীষ্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দিতে চীনের প্রথম কাব্য-সমগ্র ‘ ধ্রুপদী কাব্যগ্রন্থ ’এর জন্ম হয় ।এতে যেমন রয়েছে মহাকাব্য,কাহিনী-কাব্য ব্যঙগ-কাব্য , তেমনি রয়েছে প্রেমের গান , যুদ্ধের গান , স্তুতিগান ,ঋতুর গান ও শ্রমজীবীদের গান ।‘ ধ্রুপদী কাব্যগ্রন্থ ’ এক জন কবির লেখা নয় । তবে তা গ্রীকের হোমারের বিখ্যাত মহাকাব্য ‘ ইলিয়াড ’ এর চেয়ে কয়েক শ’ বছর পূর্বে রচিত হয়েছিল।
চীনের ইতিহাসে ‘ ধ্রুপদী কাব্যগ্রন্থই ’ চীনের প্রথম কাব্য-সমগ্র।এতে স্থান পেয়েছে চীনের পশ্চিম চৌ রাজত্বকালের প্রথম ভাগ থেকে বসন্ত-শরত্ রাজত্বকালের মধ্যভাগ পর্যন্ত অর্থাত্ খ্রীষ্টপূর্ব একাদশ শতাব্দি থেকে খ্রীষ্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দি পর্যন্ত প্রায় পাঁচ শো বছরে রচিত ৩০৫টি কবিতা । ‘ ধ্রুপদি কাব্যগ্রন্থ ’ ফেং, ইয়া ও সং এই তিনভাগে বিভক্ত । ‘ ফেং ’ বলতে ১৫টি রাজ্যের ১৬০টি লোকসংগীতকে বোঝায় । ‘ ইয়া ’ বলতে চৌ রাজবংশের রাজধানীর আশেপাশের এলাকার ১০৫টি প্রচলিতসংগীতকে বোঝায় । ‘সং’ বলতে পূর্বপুরুষদের মহানকীর্তি ও দৈত্য-দেবতার মহাশক্তি প্রশংসা করা জন্য মন্দিরে রাজার ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পরিবেশিত ৪০টি পূজার গান ও স্তুতিগানকে বোঝায়।
‘ধ্রুপদী কাব্যগ্রন্থ ’ এর অধিকাংশ কবিতার এক এক শ্লোকে আছে চারটি চীনা শব্দ । বাকী কবিতার এক এক শ্লোকে আছে দুই ,তিন,পাঁচ,ছয় ,সাত বা আটটি চীনাশব্দ । অনুপ্রাস, দ্বিবর্ণ,দ্বিদল মিল প্রভৃতি অলঙ্করণ-কৌশল বিপুল পরিমানে ব্যবহৃত হওয়ায় ‘ধ্রুপদি কাব্যগ্রন্থ’ এর রুপবৈচিত্র্য এবং তরঙ্গিত ধ্বনিপ্রবাহ সৃষ্টি হয় । প্রতিটি কবিতার গীতিময়তা সহজেই অনুভব করা যায়। বিষয়বস্তু বিচার করলে দেখা যায় , ‘ফেং’ই ‘ধ্রুপদী কাব্যগ্রন্থের ’ সর্বশ্রেষ্ঠ অঙ্গ। ‘ফেং’এর কোনো কোনো লোকসংগীতে অতি অল্প অলংকার প্রয়োগ করা হয় , কোনো কোনো লোকসংগীতে অলংকারের ব্যবহার একেবারে নেই । চৌ রাজত্বকালের এ সব বিচিত্র লোকসংগীতে সাধারণ শ্রমজীবীদের প্রকৃত জীবন ফুটে উঠেছে। যেমন ‘কুয়ান সুই ’ , ‘ পুর্বদ্বারের বাইরে গমন’ কবিতা দুটিতে তরুণতরূণীদের পবিত্র প্রেম-পিপাসা প্রতিফলিত হয়েছে । বিনা পরিশ্রমে বিলাসী জীবাযাপনকারী দাস-মালিকের সামনে দাসরা সরোষে যে অসন্তোষ প্রকাশ করে তা চিত্রিত হয়েছে ‘মেঠো ইঁদুর ’ ও ‘ফাতান’ নামে দুটো কবিতায় । ‘ ইয়াংজি নদী’ , ‘যুদ্ধপীড়িত মানুষ’ ইত্যাদি কবিতায় যুদ্ধের করুণ দৃশ্য বর্ণিত হয়েছে ।
‘ ধ্রুপদী কাব্যগ্রন্থের ’ লেখকদের পরিচয় অত্যন্ত জটিল ।তাঁদের মধ্য যেমন রয়েছেন শ্রমজীবী ও সৈনিক, তেমনই রয়েছেন অভিজাত সম্প্রদায়ের উঁচু ও নিচু স্তরের সদস্যগণ ।কোনো কোনো লেখকের পরিচিতি আজো জানা যায় নি ।
‘ ধ্রুপদী কাব্যগ্রন্থের ’ রচনাবলী প্রধানত: তিনটি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হত । প্রথমত: নানা প্রকার উদযাপনী অনুষ্ঠানে এর সংগীত পরিবেশিত হত। দ্বিতীয়ত: চিত্তবিনোদনের স্থানে এর সংগীত গীত হত। তৃতীয়ত:কবিতা আবৃত্তি ও গান পরিবেশনের মাধ্যমে সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা সম্পর্কে লেখকদের মতামত প্রকাশিত হত ।তবে পরবর্তীকালে‘ ধ্রুপদী কাব্যগ্রন্থ ’ ক্রমে ক্রমে অভিজাত সম্প্রদায়ের পাঠ্যপুস্তকে পরিণত হয় । অভিজাত ব্যক্তিরা ‘ধ্রুপদী কাব্যগ্রন্থ ’অধ্যয়ন করে তাঁদের সাংস্কৃতিক মানোন্নয়নে সচেষ্ট হতেন ।শিক্ষার প্রসারে ‘ধ্রুপদী কাব্যগ্রন্থ ’ ভাষার সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে । সামাজিক জীবনে বক্তারা মাঝে মাঝে ‘ ধ্রুপদী কাব্যগ্রন্থ ’এর পংক্তি উদ্ধৃত করে অপ্রত্যক্ষভাবে নিজেদের মত ব্যক্ত করেন । ‘ ধ্রুপদী কাব্যগ্রন্থ ’ কালক্রমে চীনের কয়েকটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন পুঁথি সাহিত্যকর্মের কাতারে স্থান পায় । কনফুসিয়াসের উদ্ধৃতি নামক পুস্তকে ‘ ধ্রুপদী কাব্যগ্রন্থ ’এর উচচ মুল্যায়ন করে বলা হয়েছে , ‘ ধ্রুপদী কাব্যগ্রন্থ ’ না পড়লে যথার্থভাবে মত প্রকাশ করা অসম্ভব ।
সামগ্রিকভাবে বিচার করলে বলা যায় যে , ‘ধ্রুপদী কাব্যগ্রন্থ ’ ”চীনা সাহিত্যের দীপ্তিমান সূচনা এবং প্রাচীনযুগে সমৃদ্ধ চীনা সাহিত্যের নিদর্শন । এর উপজীব্য এসেছে আদিম যুগের সামাজিক জীবনের নানা অঙ্গ থেকে ,যেমন পরিশ্রম ও প্রেম , যুদ্ধ ও বেগার কাজ , অত্যাচার ও প্রতিরোধ, আদব কায়দা ও বিবাহ প্রথা , ধর্মাচার ও ভোজসভা । এমন কি এতে জ্যোতিষ্ক, ভূ-প্রকৃতি , জীবজন্তু ও গাছপালাও অঙ্কিত হয়েছে । এর ভাষা খ্রীষ্টপূর্ব একাদশ শতাব্দি থেকে খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দি পর্যন্ত হান ভাষার গঠনপ্রণালী গবেষণায় ব্যবহৃত সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অবলম্বন ।
|