গত দু হাজার বছরেরও বেশী সময়ে চীনা জনগণের চোখে ছু ইউয়ানই সর্বশ্রেষ্ঠ কবি এবং সর্বাধিক শ্রদ্ধার পাত্র । তিনি খ্রীষ্টাপূর্ব ৪৭৫ সাল থেকে খ্রীষ্টাপূর্ব২২১ সাল পর্যন্ত স্থায়ী যুদ্ধমান যুগে জীবিত ছিলেন।যুদ্ধমান যুগে অনেক রাজ্যের মধ্যে অনবরত যুদ্ধ চলত । ছিন রাজ্য ও ছু রাজ্য সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী । অন্য দশাধিক ছোটো রাজ্য ছিন রাজ্য বা ছু রাজ্যের উপরে নির্ভরশীল ছিল ।
ছু ইউয়ান ছু রাজ্যের অভিজাত- সম্প্রদায়ভুক্ত । তিনি রাজসভার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন ।তিনি অগাধ জ্ঞানের অধিকারী ।তিনি কূটনৈতিক প্রকৌশল প্রয়োগে বিশেষ পারদর্শী ।সুতরাং তিনি ছু রাজ্যের অধিপতির অনুগ্রহের পাত্র ।তখন বিভিন্ন দেশের রাজা ও প্রভাবশালী রাজকীয় কর্মকর্তারা নিজদের স্বার্থে প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবীদের জড়ো করতেন ।সুতরাং কৃতী ও সামর্থ্যবানদের শ্রদ্ধা করার প্রথা প্রচলিত ছিল । বহুসংখ্যক খ্যাতনামা পন্ডিত বিভিন্ন রাজ্যে ভ্রমণ করে তাঁদের রাজনৈতিক স্বপ্ন বাস্তবায়নে সচেষ্ট ছিলেন ।তাঁদের থেকে ছু ইউয়ান কিন্তু একেবারে আলাদা । তিনি মাতৃভূমিকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন।তাঁর অভিপ্রায় ছিল, তিনি নিজের বিজ্ঞতা প্রয়োগ করে রাজ্যশাসনে রাজাকে সহায়তা করবেন ,যাতে ছু রাজ্যে স্বচ্ছ রাজনীতি প্রর্বিতত হয় এবং ছু রাজ্য শক্তিশালী হয়ে উঠে । এই অভিপ্রায় নিয়ে তিনি কখনো মাতৃভূমির বাইরে যান নি ।কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে , অভ্যন্তরীন ও কূটনৈতিক ব্যাপারে ছু রাজ্যের অভিজাত- সম্প্রদায়ের একগুঁয়ে সদস্যেদর সঙ্গে ছু ইউয়ানের তীব্র মত বিরোধ বাঁধে । সেই সঙ্গে কেউ কেউ তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগও তোলেন । ফলে তাঁর উপর রাজার আস্থা কমে যায় । পরে শক্তিশালী বৃহত ছু রাজ্য ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে। খ্রীষ্টপূর্ব২৭৮ সাল ছিন রাজ্যের সৈন্যবাহিনী ছু রাজ্যের রাজধানী ইংদু দখল করে। দেশ ছারখার হওয়ায় অসহ্য বেদনা ও ক্ষোভে অতিষ্ঠ হয়ে ছু ইউয়ান নদীতে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করেন ।
পরবর্তী বংশধরদের জন্য ছু ইউয়ান রেখে গেছেন অমর সাহিত্যকর্ম ।চীনে তিনিই প্রথম স্বকীয় সৌন্দর্যচেতনায় কবিতা লিখেছিলেন । চীনের প্রাচীন সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর প্রতিনিধিত্বকারী রচনা ‘লি সাও’ একটি দীর্ঘতম রাজনৈতিক গীতিকবিতা ।এই কবিতায় অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা উল্লেখ করে তাঁর প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হয়েছে যে ,ছু রাজ্যের রাজা বিচক্ষণ অধিপতি ইয়াও,সুন ও ইউয়ুর মত দেশের ভিতরে চরিত্রবান ও সুদক্ষ ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণপদে নিয়োগ করে ন্যায়সংগত নীতিতে নি:স্বার্থভাবে দেশ শাসন করবেন এবং অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে জোট বেঁধে ছিন রাজ্যের আক্রমণ প্রতিহত করবেন । ‘লি সাও’ চীনের প্রথম কাব্য-সমগ্র ‘ ধ্রুপদি কাব্যগ্রন্থ ’এর কাব্যশৈলীর গণ্ডি অতিক্রম করে প্রাচীন কাব্যের নতুন জগত উন্মুক্ত করেছে এবং প্রকাশরীতি সমৃদ্ধ করেছে ।পরবর্তী যুগে তার কাব্য সহ ছু রাজ্যের কাব্যসমষ্টিকে ’ ধ্রুপদি কাব্যগ্রন্থ ’ এর সমতুল্য বলে অভিহিত করা হয়। ছু রাজ্যের কাব্যসমষ্টি ও ‘ধ্রুপদি কাব্যগ্রন্থ’ চীনের ঐতিহ্যিক বাস্তববাদী ও রোমান্টিক কাব্যধারার দুটো উত্স ।
‘লি সাও’ ছাড়া ছু ইউয়ানের কবিতা ‘ আকাশ-প্রশ্ন’ও একটি অনন্যরচনা ।এই কবিতায় আকাশকে আবহাওয়া ,ভূগোল ,সাহিত্য ও দর্শন সম্পর্কে যে ১৭২টি প্রশ্ন করা হয়েছে তাতে চিরাচরিত ধ্যানধারনা সম্ধন্ধে তার সন্দেহ সাহসের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে এবং বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে সত্য অন্বেষনের দৃষ্টটিভঙ্গী অভিব্যক্ত হয়েছে । ছু ইউয়ানের লেখা ‘ জিউ গো’ বস্তু: পূজার গানের সমষ্টি। সাধারণ মানুষদের গীত পূজার গান পরিমার্জনের ভিত্তিতে ‘জিউ গো ’ রচিত হয়েছে । ‘জিউ গো’ এ অনেক দেবতার শৈল্পিকচিত্র আঁকা হয়েছে। অধিকাংশ গানে মানব ও দেবের মধ্যকার প্রণয়ের স্তুতি গাওয়া হয়েছে ।
ছু ইউয়ানের কবিতায় রয়েছে প্রচুর অদ্ভুত ভাবনা । তিনি তাঁর কবিতায় ফুল- ঘাস ও গাছের সঙ্গে মনষ্যত্ব মিশিয়ে দিয়ে যে অনেক পরী সৃষ্টি করেন তাদের মধ্যে তাঁর নির্মল চরিত্র রূপ লাভ করেছে ।সুতরাং তাঁর কাব্য পাঠ করলে শুধু ভাষার মাধুর্য ও উপমার বৈচিত্র্য নয় ,তাঁর মহত্ত্ব ও দেশপ্রেমের পরিচয়ও পাওয়া যায় । এই কারণেই হাজার হাজার বছরে চীনা জনগণের কাছে তিনি পরম শ্রদ্ধাভাজন।