পল্লী কবি থাও ইউয়ান মিং ও তাঁর কবিতা

       থাও ইউয়ান মিংয়ের আরেক নাম ছিল থাও ছুয়ান । তিনি খ্রীষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে পূর্ব জিন রাজত্বকালে জীবিত ছিলেন ।তিনি পল্লীআশ্রিত কাব্যধারার প্রতিষ্ঠাতা । গরীব হলেও তিনি সারাজীবন ছিলেন সত্যের সাধক ও প্রকৃতির পূজারী । তাঁর সরল ,ঋজু আর লৌকিকতাবিমুখ স্বভাব যুগ যুগ ধরে চীনের বুদ্ধিজীবীদের অকুণ্ঠ প্রশংসা লাভ করেছে । 

  থাও ইউয়ান মিংয়ের প্রপিতামহ থাও খান ছিলেন পূর্ব জিন রাজবংশ প্রতিষ্ঠায় প্রথম সম্রাটের অন্যতম দক্ষিণহস্ত ।তাঁর পিতামহ ও পিতা উভয়ই ছিলেন রাজদরবারের পারিষদ ।তাঁর বয়স যখন আট বছর তখন তাঁর পিতা মৃত্যু বরণ করেন ।এরপর তাঁর পরিবারের আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে ।কৈশোরে ও তারুণ্যে থাও ইউয়ান মিং প্রাথমিক স্তরের রাজপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অসামান্যকীর্তি স্থাপন করেছিলেন । 

  কিন্তু পূর্ব জিন রাজত্বকালের আদ্যন্ত চলেছিল গোলযোগ । নানান বংশের মধ্যে বিরাজমান ছিল রেষারেষি । রাজদরবার ছিল অন্যায়-অবিচারে ভরপুর ।থাও ইউয়ান মিং ছিলেন সরল প্রকৃতির ।২৯ বছর বয়সে প্রথমবার রাজকর্মচারীপদে অধিষ্ঠিত হন তিনি ,কিন্তু অনতিকাল পর সরকারের দুর্নীতি ও অন্ধকারময় কুশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি পদত্যাগ করে জন্মস্থানের বাড়িতে ফিরে যান । 

  পরবর্তীকালে থাও ইউয়ান মিংয়ের আর্থিক দুর্গতি ক্রমশই ভয়াল আকার ধারন করে ।খালি চাষ করে পরিবার প্রতিপালন করা তাঁর পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে । ৪১ বছর বয়সে জীবনের চাপে তিনি বাধ্য হয়ে রাজকর্মচারীপদের সন্ধানে রাজধানীতে যান এবং ফেংজে জেলার প্রশাসকপদে নিযুক্ত হন ।তিনি বরাবরই পদমর্যাদা আর ধনসম্পত্তির প্রতি উদাসীন ছিলেন বলে এবং  রাজসভাসদদের  তোষামোদ করতে অনিচ্ছুক ছিলেন বলে ৮০দিন জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালনের পর তিনি আবার পদত্যাগ করেন ।রাজ্য সরকারকে চির বিদায় জানিয়ে গ্রামে ফিরে আবার চাষাবাদ করে নিরিবিলি পরিবেশে তাঁর জীবনের বাকী দিন অতিবাহিত করেন। 

  পল্লীগ্রামে থাও ইউয়ান মিং দরিদ্র জীবন যাপন করেন ।৪৪ বছর বয়সে দুর্ভাগ্যবশত:তাঁর বাড়িঘর আগুন লেগে ভষ্মীভূত হয়। ফলে তাঁর পরিবারের অবস্থা আরো শোচনীয় হয়ে পড়ে । “গ্রীষ্মকালে অনাহারে দিন কাটে , শীতের রাতে বিনা লেপে ঘুমাতে হয় ” এই দুটো শ্লোকে তারঁ তখনকার চরম দুরবস্থা প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু আধ্যাত্মিক জীবনে তিনি দুশ্চিন্তামুক্ত।তিনি প্রচুর পল্লীজীবন আশ্রিত কবিতা রচনা করেন , কাব্যসৃস্টির দিক থেকে সেই সময়পর্ব ছিল তাঁর সোনালী ফসল ওঠার মওসুম । পল্লীজীবন ও ক্ষেতখামারের দৃশ্য প্রথমে তাঁর কবিতায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান পেয়েছে । তাঁর কাব্যিক ভাষায় পল্লীজীবন নির্মল ও সুন্দর রূপ লাভ করেছে । বেদানা-কাতর মর্ত্যে তাঁর কাব্য পাঠকদের একটি অধ্যাত্মিক আশ্রয় । 

  থাও ইউয়ান মিংয়ের বার্ধক্যও দারিদ্র্য পীড়িত ছিল । কখনো কখনো তাঁকে খাদ্যশষ্য ধার করে দিন কাটাতে হত । কিন্তু চরম দুর্গতির সময়েও তিনি আরেকবার রাজদরবারের অনুগ্রহ সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেন এবং সরকারী মহল আর রাজনীতি এড়িয়ে যান । বার্ধক্যকালে ‘থাও হুয়া ইউয়ানের চিত্র’নামে তাঁর লেখা একটি প্রসিদ্ধ প্রবন্ধে ইউটোপিয়ান সমাজ চিত্রিত হয়েছে ।‘থাও হুয়া ইউয়ানের চিত্র’এ বলা হয়েছে , একজন জেলে ভুল করে থাও ইউয়ানে প্রবেশ করে আবিষ্কার করেন যে , সেখানে যারা থাকেন তাদের পূর্বপুরুষরা যুদ্ধ-বিগ্রহ এড়ানোর জন্য থাও ইউয়ানে আত্মগোপন করেন । তাদের বংশধরদের মধ্যে কেউ থাও ইউয়ান থেকে বেরোয় নি । বাইরে কি ঘটেছে তাদের লেশমাত্র জানা নেই । তারা সরল , পরিশ্রমী , নিশ্চিন্তে নির্ঝঞ্ঝাট জীবন যাপন করেন ।‘ থাও হুয়া ইউলানের চিত্র ’এ যে কাল্পনিক আনন্দধাম বর্ণিত হয়েছে তাতে অবিরাম যুদ্ধে দু:খক্লিষ্ট মানুষদের সুখশান্তির প্রত্যাশা রূপ লাভ করেছে । 

  থাও ইউয়ান মিং মাত্র শতাধিক কবিতা ও দশাধিক প্রবন্ধ রেখে গেছেন । কিন্তু চীনের সাহিত্যের ইতাহাসে তাঁর স্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । পূর্ব জিন রাজত্বকালে কাব্যচর্চার বাঁধাধরা নিয়ম সমসাময়িক কবিদের কড়াকড়িভাবে মেনে চলতে হত । অনেক কবি বাক্যালংকারের অভিসারী । থাও ইউয়ান মিংই প্রথম পল্লীগ্রামের নতুন বিষয়বস্তু বেছে সহজ ভাষায় কবিতা লিখেছেন । তিনি চীনের ঐতিহ্যিক প্রাচীন কাব্যের সরলতার বাহক । তাঁর কবিতা প্রাণ-প্রাচুর্য্যে ভরপুর , ভাষা সহজ ,সাবলীল আর বেগবান । প্রাচীনকালের কবিতার সরলতা যে কত উচু স্তরে আরোহন করতে পারে চিহ্ন ফলকের ন্যায় থাও ইউয়ান মিংয়ের কবিতা তার সীমা চিহ্নিত করেছে ।