থাং রাজত্বকালের সুউজ্জ্বল কাব্যসৃষ্টি 

       চীনের ইতিহাসে থাং রাজবংশ একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ রাজবংশ । থাং রাজত্বকালে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সামাজিক স্থিতিশীলতা বিরাজমান ছিল । সংস্কৃতি ও শিল্পকলার ক্ষেত্রে উজ্জ্বল সাফল্য অর্জিত হয়েছিল । বিশেষ করে প্রাচীন কাব্যসৃষ্টি শীর্ষস্তরে উপনীত হয়েছিল ।কাব্যসৃষ্টি তখনকার সামাজিক আর সাংস্কৃতিক তত্পরতার অন্যতম প্রধান অঙ্গ । রাজপরীক্ষায় প্রবন্ধের পরিবর্তে কবিতা লিখতে হত। সাহিত্য গ্রন্থ“থাং রাজত্বকালের কবিতা সমগ্র ” তে দু হাজার তিন শোরও বেশী কবির প্রায় ৫০ হাজার কবিতা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে । 

  থাংরাজত্বকালের কাব্যসৃষ্টির গতিপথ প্রথম ভাগ , ঐশ্বর্যময় যুগ , মধ্য যুগ আর শেষ যুগে বিভক্ত । 

  থাং রাজত্বকালের প্রথম ভাগে(৬১৮ সাল-৭১২ সাল)চারজন কৃতী কবি ওয়াং বো , ইয়াং জিয়োং , লু জাও লিন ও লো বিন ওয়াংয়ের প্রচেষ্টায় কাব্যছন্দের মাত্রা ধার্য করা হয় এবং ছন্দোবদ্ধ কবিতার কাঠামোর ভিত্তি স্থাপিত হয় । থাং রাজত্বকালের কাব্য ক্রমশই নিজস্ব রূপ ধারণ করে । রাজপরিবারের বিলাসিতার বদলে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন থেকে কবিতার বিষয় সংগৃহীত হয় । কোমলতার বদলে সাবলীলতা ও প্রাণচঞ্চলতা হয়েছে কাব্যধারার প্রধান বৈশিষ্ট্য।ছেন জি আং থাংরাজত্বকালের প্রথম ভাগের শ্রেষ্ঠ কবি । তিনি বাস্তব জীবন প্রতিফলনকারী উত্তম ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার পক্ষপাতী ।তার তেজদৃপ্ত ও সরল কবিতা থাং রাজত্বকালের কাব্যসৃষ্টির পথ সুগম করেছে । 

  খ্রীষ্টীয় ৭১২ অব্দ থেকে ৭৬২ অব্দ পর্যন্ত থাংরাজত্বকালের ঐশ্বর্যময় যুগ । এই সময়পর্বের কাব্য সর্বাধিক প্রাচুর্যময় এবং কাব্য-কীর্তি শীর্ষস্তরে আরোহন করে। কবিতার বিষয় বিচিত্র, কাব্যরীতি নানান ধরনের । কবিদের মধ্যে কেউ প্রকৃতির স্তুতি গাইতেন ,কেউ সীমান্ত এলাকার চিত্র আকঁতেন ,কেউ বীরত্বের কীর্তন করতেন , কেউ বা হতাশার নি:শ্বাস ফেলতেন । রোমান্টিক পরিমন্ডলে কবিরা স্বাধীনভাবে কবিতা লিখতেন এবং যুক্তভাবে সৃষ্টি করেছেন কাব্যঙ্গনের অপূর্ব সৌন্দর্য যা পরবর্তী যুগে অক্ষয় স্মৃতি রেখে গিয়েছে । 

  লিপাই ,দুফু , ওয়াংওয়েই ,মেং হাও রৌয়ান , গাও শি , চিন জেন প্রমূখ এই যুগের সর্বাধিক খ্যাতনামা কবি । চিন জেন সীমান্ত এলাকার জীবন নিয়ে কবিতা রচনায় বিশেষভাবে পারদর্শী।গাও শির কবিতায় জনসাধারণের দু:খকষ্ট জীবন্তভাবে প্রতিফলিত হয়েছে । কবিগুরু দুফু ও কবিদেব লি পাই এই যুগের কাব্যাঙ্গনের প্রকৃত প্রতিনিধি। তাঁদের কবিতা পরবর্তী যুগের কাব্যসৃষ্টির উপরে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে । 

  থাং রাজত্বকালের মধ্য যুগের(৭৬২ সাল-৮২৭ সাল) সেরা কবিদের মধ্যে ছিলেন পাই জু ই ,ইউয়ান জেন ও লি হো ।পাই জু ই বিদ্রুপাত্মক কবিতা রচনায় বিশেষভাবে নিপুণ। তাঁর কবিতায় যথেচ্ছ কর আদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রুপ করা হয় , শক্তির দাপটে যুদ্ধ চালানোর বিরূদ্ধে মত প্রকাশ করা হয় ,এবং প্রতিপত্তিশালীদের অনাচারের কঠোর সমালোচনা করা হয় । তিনি যতদূর সম্ভব সহজ, বেগবান আর সজীব ভাষায় যে সব কবিতা লিখেছেন তা পাঠকদের কাছে সমাদৃত হয়েছে । 

  লি হোর আয়ু দীর্ঘ ছিল না ।তিনি মাত্র বিশাধিক বছর জীবিত ছিলেন । রাজকর্মচারী হওয়ার বন্ধুর পথে আর্থিক দুর্গতি ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী । কিন্তু তাঁর কবিতা কল্পনা, অভিনব বক্তব্য, সুক্ষ্ম চিত্র, সুন্দর শব্দ আর রঙ্গিন রোমান্টিকতায় সমৃদ্ধ , বিরহ বিধুর অনুভবে পরিপূর্ণ হলেও তাতে নিছক লালিত্যের প্রবণতা স্পষ্ট। 

  ৮২৭সাল থেকে ৮৫৯ সাল পর্যন্ত থাং রাজত্বকালের শেষভাগের কাব্যাঙ্গনে কবি লি সাং ইন ও দু মো খুবই সক্রিয় ছিলেন ।দু মোর কবিতায় সাবলীলতার সহিত কঠোরতা মিশে থাকায় তাঁর রাজনৈতিক আকাংক্ষা ও আবেগ-উচ্ছাস প্রকাশ করা সহজ হয়েছে ।লি সাং ইনের কবিতার কাঠামো নিখুঁত , ভাষা সুন্দর , কাব্যশৈলী গম্ভীর, তার কবিতায় যে হাহাকার অনুরণিত তাতে রাজকর্মচারী হওয়ার পথে নির্মম জীবনসংগ্রাম অভিব্যক্ত হয়েছে । তাঁর একটি নামহীন কবিতা প্রেমের কবিতা না রাজনীতিআশ্রিত কবিতা , তা নিয়ে চীনের কাব্য সমালোচকদের মধ্যে এখনো মতভেদ আছে ।