কবিদেব লি পাই ও তার কবিতা  

       লি পাই চীনের থাং রাজত্বকালের বিখ্যাত কবি , তাঁর বিরল আত্মাভিমান আর আত্মবিশ্বাসজনিত অদ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব ,তাঁর উদ্দাম দুর্দান্ত স্বভাব এবং কাব্যসৃষ্টির রোমান্টিকতায় পূর্ণমাত্রায় প্রতিফলিত হয়েছে চীনের সমৃদ্ধিশালী থাং রাজত্বকালের সমসাময়িক বুদ্ধিজীবীদের প্রকৃতি ও মানসিকতা। 

   লি পাই’র (৭০১-৭৬২) পুর্বপুরুষ বর্তমান কানসু প্রদেশের অধিবাসী ।তবে তাঁর বংশতালিকা ও জন্মস্থান এখনও একটি গূঢ় রহস্য ।তার কবিতা থেকে জানা যায় , তাঁর পরিবার অবস্থপন্ন ছিল এবং পরিবারের সবাই শিক্ষিত ছিলেন । তিনি ছেলেবেলায় নানা ধরনের প্রচুর বই পড়েছিলেন ।এ ছাড়া তিনি অসি চালনায় নিপুণ ছিলেন । জ্ঞান-পিপাসা মেটানোর আশায় বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেছিলেন তিনি।অনন্য মেধার আলোকে তিনি অল্পকালে অগাধ জ্ঞান অর্জন করে কবিতা রচনায় প্রতিষ্ঠিত হন । তখনকার যোগাগোগ ব্যবস্থা ও মুদ্রণ-প্রকৌশল ছিল অনুন্নত , কিন্তু কাব্যসৃষ্টির অভিজ্ঞতা বিনিময় আর লেখকদের মধ্যে পরস্পরকে কবিতা দানের প্রথার জন্য তরুণ বয়সেই লি পাই সুখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন । 

  পড়াশোনা করে রাজপরীক্ষায় উত্তীর্ন হয়ে রাজকর্মচারীর পদে অধিষ্ঠিত হওয়াই ছিল প্রাচীনকালের শিক্ষিতদের জীবনের লক্ষ্য । তরুণ বয়সে লিপাইও রাজকর্মচারী হয়ে দেশের জন্য কীর্তি স্থাপন করতে আগ্রহী ছিলেন । তাই তিনি রাজধানী ছাং আনে যান । কাব্যাঙ্গনে তাঁর সুনাম এবং রাজদরবারের খ্যাতনামা পারিষদদের সুপারিশের দরুন খ্রীষ্টীয়৭৪২ সালে লিপাই রাজকীয় একাডেমীর সদস্য হন ।জীবনযাত্রার এই সময়পর্বে তিনি চরম তৃপ্তি বোধ করতেন । 

  লিপাইয়ের অহংকার ছিল সহজাত ।তিনি সরকারী মহলের ক্ষয়িষ্ণু রীতিনীতিতে অত্যন্ত অসস্তুষ্ট । তাঁর প্রত্যাশা: সম্রাট তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করবেন যাতে তিনি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁর ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন । কিন্তু তদানীন্তন সম্রাট তাঁকে শুধু রাজসভার কবি বলে গণ্য করতেন । রাজদরবারের প্রভাবশালী পারিষদরা মাঝে মাঝে তাঁর বিরুদ্ধে অহেকুত অভিযোগ তোলেন ।ফলে সম্রাট আর তাঁকে বিশ্বাস করেন না । রাজদরবারের প্রতি হতাশ নিয়ে লিপাই রাজধানী ছাং আন ছেড়ে পুনরায় সারাদেশে পরিভ্রমন করেন এবং কবিতা রচনা ও মদ্যপানে আত্মতৃপ্ত হতে থাকেন । 

  পরিভ্রমনে লিপাইয়ের জীবনের বেশীর ভাগ সময় অতিবাহিত হয়। তিনি অতিরঞ্জন , উপমা ইত্যাদি কাব্যালংকার ব্যবহার করে প্রাকৃতিক দৃশ্যের উপরে বহু কবিতা লিখেছিলেন ‘ সিচুয়ানের দুর্গম গিরি পথ’ নামক কবিতার চরণ: সিচুয়ানের গিরি পথে হেটে যাওয়া আকাশে উঠার চেয়ে কঠিন ;’ ‘ মদ খাওয়ানো ’ নামক কবিতার শ্লোক: আপনি কি দেখেছেন , হোয়াংহো নদীর পানি আকাশ থেকে নেমে সমুদ্র -পানে ছুটে গেল ” ;‘লুসান পর্বতের জলপ্রপাত ’ নামক কবিতার শ্লোক: উড়ন্ত ঝর্না তিন হাজার মিটার উচ্চ থেকে ঝাঁপ দেয় ,যেন ছায়াপথ গগন থেকে মর্ত্যে পড়ে গেল ’, হাজার হাজার বছর ধরে পাঠ করতে শোনা যায় । 

   লিপাইয়ের লেখা নয় শতাধিক কবিতা ও ষাটটিরও বেশী প্রবন্ধএখনো চীনে প্রচলিত ।তাঁর কবিতা বিচিত্র কল্পনায় অপূর্ব এবং সজীব প্রকাশভংগীর বলিষ্ঠতায় অপরূপ , পরবর্তী যুগের উপরে তাঁর কবিতার প্রভাব সুদূরপ্রসারী ।