কবিগুরু দু ফু ও তাঁর কবিতা  

       চীনের সাহিত্যের ইতিহাসে বিশ্ব বিখ্যাত কবি লি পাই ও কবিগুরু দু ফুকে থাং রাজত্বকালের(৬১৮-৯০৭) দুজন প্রতিনিধিত্বকারী কবি বলে আখ্যায়িত করা হয় । 

  দু ফু খ্রীষ্টীয় ৭১২ অব্দে জন্ম গ্রহণ করেন । তিনি নামকরা কবি দু সেন ইয়ানের নাতি । শিশু বয়সেই দু ফু অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছিলেন ,পড়াশোনায় তাঁর আগ্রহের অন্ত ছিল না । সাত বছর বয়সে তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেন। বড় হয়ে তিনি চিত্রাঙ্কন , লিপিকলা , সংগীত , অসি-চালনা ও  অশ্ব চালনায়  পারদর্শী হয়ে উঠেন । তরুণ বয়সে নিজের প্রতিভার উপর দুফুর অগাধ আস্থা ছিল ।১৯ বছর বয়সে মনে উচ্চাকাংক্ষা নিয়ে সারাদেশে ভ্রমণ করে তার রোমান্টিক জীবনযাত্রা আরম্ভর হয় । তখন ছিল থাং রাজবংশের সমৃদ্ধিশালী সময়পর্ব । বহু প্রসিদ্ধ পর্বত আর নদী ভ্রমণ করে তার প্রচুর জ্ঞান অর্জিত হয় ।ভ্রমণকালে তিনি থাই পর্বত দর্শন নামক যে কবিতা লিখেছিলেন তার দুটো পঙক্তি:“সর্বোচ্চ শৃঙ্গে উঠলে , সমস্ত পর্বত পায়ের নীচে দেখা যায়” ,যুগ যুগ ধরে চীনাদের মুখে মুখে শোনা যায় ।  

  অসংখ্য বুদ্ধিজীবীর মত দু ফুও রাজকর্মচারী হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন । তিনি বছরের পর বছর রাজপরীক্ষা দিতেন এবং সমাজের হোমরাচোমরাদের নামে তাঁর কাব্য উত্সর্গ করতেন ।কিন্তু আপ্রাণ চেষ্টা করলেও তাঁর রাজকর্মচারি হওয়ার স্বপ্ন পূর্ণ হলো না । প্রৌঢ় বয়সে তিনি রাজধানী ছাং আনে আর্থিক কষ্টে অসহনীয় জীবন যাপন করেছেন । সম্ভ্রান্ত রাজকর্মচারীদের বিলাসী জীবন ও হাড়কাঁপানো শীতে অনাহারে মরে যাওয়া গরীবদের লাশ দেখে তিনি লিখেছিলেন দুটো মর্মস্পর্শী শ্লোক:লাল দরজার অন্তরাল থেকে ভেসে আসে পঁচা মাংস ও মদের দুর্গন্ধ,পথের ধারে পড়ে আছে আড়ষ্ট মরদেহ । রাজকর্মচারীপদ না পাওয়ার হতাশায় এবং জীবনকৃচ্ছতায় দুফু শাসকদের অনাচার ও জনসাধারণের দুর্গতির উপর নজর রেখে ক্রমে ক্রমে জনহিতৈষী কবিতে পরিণত হন । 

  খ্রীষ্টীয় ৭৫৫ অব্দে ৪৩ বছর বয়সী দু ফু দৈবক্রমে একজন সাধারণ রাজকর্মচারী হওয়ার সুযোগ পান । কিন্তু মাত্র একমাস পর যুদ্ধ বাঁধে । যুদ্ধ চলাকালে দুফু ঘন ঘন স্থানান্তরিত হতেন এবং অসহ্য কষ্ট সহ্য করতেন । বাস্তব সমাজের স্বরূপ পরিস্কারভাবে দেখতে পেয়ে তিনি ‘সি হাও গ্রামে সৈন্য সংগ্রহ ’, ‘ তংগুয়ান দুর্গে জেনারেলের সঙ্গে দেখা ’ , ‘সিন আনে নতুন সৈন্যদের যাত্রা ’ , ‘ বর-কন্যার বিরহ’ ‘ স্ত্রীর কাছ থেকে বৃদ্ধ সৈন্যের বিদায় নেয়া’ , ‘পুনরায় যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার মুখে পুরনো সেনার হাহাকার’ প্রভৃতি যে কবিতা লিখেন তাতে জনগণের প্রতি গভীর মমত্ববোধ ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রতিভাত হয়েছে ।  

  খ্রীষ্টীয় ৭৫৯ অব্দে শাসকশ্রেণীর প্রতি বুক-ভরা নিরাশায় দু ফু পদত্যাগ করেন। তখন ছাং আনে অভূতপূর্ব খরা চলছিল , দারুন অভাবে তাঁর দিন আর চলে না । দুফু বাধ্য হয়ে সপরিবার দক্ষিণ পশ্চিম চীনের ছেংতু শহরে চলে যান । বন্ধুদের আর্থিক সাহায্যে তিনি সেখানে ঋষির মত চার বছর কাটিয়েছিলেন । আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে তিনি “শরত্কালের প্রবল বাতাসে ভাংগা কুঁড়ে ঘর নামে যে কবিতা লিখেছিলেন তাতে তাঁর পরিবারের দুর্দশা বর্ণিত হয়েছে এবং তাঁর মত গরীব মানুষদের প্রতি সহানুভুতি জানানো হয়েছে । এই কবিতায় তিনি বলেছেন ,তিনি অন্তরের অন্ত:স্থল থেকে কামনা করেন , সারা দেশের গরীবদের জন্য হাজার হাজার পাকা বাড়ী নির্মাণ করা হবে , তিনি তাঁর কবিতায় আত্মত্যাগের বিনিময়ে সকল গরীব বুদ্ধিজীবীর সুখ-শান্তি আনয়নের প্রবল ইচ্ছাও ব্যক্ত করেন । নির্মল দরদ- ভরা- এই কবিতায় তাঁর চরিত্রের মহত্ত্ব প্রকাশ পেয়েছে । 

   খ্রীষ্টীয় ৭৭০ অব্দে ৫৯ বছর বয়সী দু ফু দারিদ্র্য ও ব্যাধির নিপীড়নে যাত্রাপথে মৃত্যুবরণ করেন । তিনি পরবর্তী যুগের জন্য রেখে গেছেন এক হাজার চারশতাধিক কবিতা । থাংরাজ বংশ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সমৃদ্ধি থেকে যে পতনের দিকে এগুচ্ছিল সেই বিশাধিক বছরের সমাজের চেহারা তাঁর কবিতাগুলোতে জীবন্তভাবে চিত্রিত হয়েছে। তাঁর কাব্য-সৃষ্টির ক্ষেত্র মহাকাব্যের মত বিশাল। তাঁর একাধিক স্টাইলের কবিতায় ঘটনা-বর্ণনা , ভাবাবেশ ও মন্তব্য অঙ্গাঙ্গিভাবে মেশানো হয়েছে । কবিতার বিষয়বস্তু যেমন ব্যাপক তেমনই গভীর। ভাব নির্মল ও প্রগাঢ়।শিল্পের দিক থেকে বিচার করে দেখা যায় , তিনি প্রাচীন কাব্যধারার বিশিষ্টত্ব আহরণের ভিত্তিতে বহুমুখী নতুনত্ব প্রবর্তন করেছেন । বিষয়বস্তু ও কাব্যাকৃতির দিক থেকে তিনি যে কাব্যসৃষ্টির ক্ষেত্র প্রসারিত করেছেন তা পরবর্তী যুগের উপরে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে ।