কথিত আছে , পাঁচ হাজার বছর
আগে চীনের সম্রাট হুয়াংয়ের
পত্নী লুও জু প্রজাদের রেশমী
পোকা চাষের পদ্ধতি শিখিয়েছিলেন
।চীনের কচ্ছপের খোলের উপরে
খোদিত যে চীনা শব্দগুলো আবিস্কৃত
হয়েছে সেগুলোর মধ্যে তুঁত,
রেশমী গুটি, রেশমী সুতো এবং
রেশমী কাপড় প্রভৃতি শব্দ ছিল
। জুলাই মাস শীর্ষক চীনের প্রথম
কাব্য সংকলন “ কাব্য গ্রন্থ”এর
একটি কবিতায় বলা হয়েছে : বসন্তের
সুর্য্য উঠেছে , কোকিল গান
গাইছে , গ্রামের মেয়েরা তুঁতের
কচি পাতা সংগ্রহের জন্য হাতে
ঝুলি নিয়ে মেঠো পথে হাঁটছে
।এই কবিতা পড়ে জানা যায় যে
, প্রাচীনকালে চীনারা রেশমী
পোকা চাষ,রেশমী সুতো তোলা এবং
রেশমী কাপড় বোনার কৌশল আয়ত্ত
করেছিলেন ।
পশ্চিম হান রাজত্বকালে চীনের
পরিব্রাজক জাং ছিয়ান রেশম পথ
খোলা পর ইউরোপে চীনের রেশমজাত
দ্রব্যের রফতানি আরম্ভ হয় ।
ইউরোপীয়ানরা এই হালকা, মসৃন
, ঝকঝকে কাপড় দেখে তাকে রত্নের
মত মুল্যবান বলে মনে করতেন
।সেই সংগে বাজারে রেশমী পোষক
কেনার হিড়িকও পড়ে । কথিত আছে
, রোম সাম্রাজ্যের জুলিউস সিজার
চীনের তৈরী যে রেশমী পোষাক
পরে নাটক দেখতে যান তা প্রেক্ষাগৃহে
চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল ।ক্রিস্টোফার
কালোম্বাস নৌযাত্রায় তার নাবিকদের
আশ্বাস দিয়েছিলেন : যিনি প্রথম
নতুন মহাদেশ আবিস্কার করেন
পুরস্কার হিসেবে তাঁকে একটি
রেশমী জামা দেয়া হবে ।রেশমী
কাপড় সোনার মত দামী জিনিস ,
তদানীন্তন রোম সম্রাজ্য দামী
রেশমী কাপড় আমদানী করায় আর্থিক
ঘাটতি দেখা দেয় ।এ জন্য প্রবীন
পারিষদদের অধিবেশনে চীনের রেশমী
পোষাক আমদানী ও পরিধানের উপরে
নিষেধাজ্ঞা জারির প্রস্তাব
গৃহীত হয় ।কিন্তু সন্ভ্রান্তদের
মধ্যে যারা চীনের রেশমী পোষাক
পরতে পছন্দ করতেন তাঁরা সেই
নিষেধাজ্ঞানের প্রবল বিরোধিতা
করেন । অবশেষে সেই নিষেধাজ্ঞা
বাতিল করা হয় ।
ইউরোপীয়ানরা অতীতে জানতেন না
, চীনের রেশমী কাপড় রেশমী গুটি
থেকে সুতো তুলে বোনা হয় । তাঁরা
মনে করতেন , রেশমী সুতো ভেজা
কাঠ থেকে সংগ্রহ করা হয় । যখন
তাঁরা জানতে পেলেন , রেশমী
গুটি থেকে সুতো তুলে রেশমী
কাপড় বোনা হয় তখন তাঁরা গুটি
পোকা চাষের পদ্ধতি শেখার জন্য
যে কোনো মুল্য দিতে প্রস্তুত
হলেন ।
ষষ্ঠ শতাব্দীতে রোম সম্রাজ্যের
সম্রাট জাষ্টিননিয়ান চীন থেকে
ফিরে আসা একজন মিশনারীকে ডেকে
পাঠিয়ে তাকে আবার চীনের গিয়ে
গুটি পোকা চাষের পদ্ধতি চুরি
করার আদেশ দেন। এই মিশনারী
চীনের ইয়ুন নান প্রদেশে প্রবেশ
করে খোঁজ খবর পেলেন যে ,তুঁতের
বীজ বপন করলে বীজ থেকে পাতা
গজে আস্তে আস্তে তুঁত গাছ বড়
হবে । গুটি পোকার ডীম কোলে
রেখে এক সপ্তাহ ধরে তা দেয়ার
পর ডীম ফেটে যে ছোটোপোকা বের
হয় তাকে খাওয়াতে হয় তুঁত গাছের
পাতা । পুর্ণ বয়স্ক পোকা যে
গুটি তৈরী করে তা থেকে রেশমী
সুতো তোলা যায়।এই মিশনারী গুটি
পোকার কিছু ডীম ও তুঁতের বীজ
চুরি করে পুরস্কার পাওয়ার স্বপ্ন
দেখতে দেখতে দেশে ফিরে গেলেন
।কিন্তু তিনি যে একটা মস্ত
বড় ভুল করে ফেললেন তা হল এই
যে ,তিনি গুটি পোকার ডীম মাটিতে
বপন করেন এবং তুঁতের বীজ কোলে
রাখেন । বলা বাহুল্য, অবশেষে
তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন । পরে
সম্রাট জাষ্টিননিয়ান গুটি পোকা
চাষের পদ্ধতি চুরি করার জন্য
ধর্ম প্রচারের নামে অন্য দুজন
কর্মঠ মিশনারীকে চীনে পাঠান
।তাঁরা অতীতের শিক্ষা গ্রহণ
করে তুঁতের বীজ বপন আর রেশমী
পোকর ডীমে তা দেয়ার পদ্ধতি
সঠিকভাবে মনে রাখেন ।তুঁতের
বীজ ও রেশমী পোকর ডীম ফাকা
নড়ীর ভেতরে ভর্তি করে তাঁরা
রোমে ফিরে যান । এইভাবে রেশমী
পোকা চাষের পদ্ধতি পাশ্চাত্যে
ছড়িয়ে পড়ে।
পশ্চিমাঞ্চলের ভ্রমন কাহিনী
শীর্ষক চীনের রাজত্বকালে চীনের
পরিব্রাজক সন্ন্যাসী হিউয়েন
সাংয়ের লেখা ভ্রমন বৃত্তান্তে
পাশ্চাত্যে রেশমী পোকা চাষের
পদ্ধতির বিস্তার সম্পর্কে ভিন্ন
মত প্রকাশিত হয়েছে ।হিউয়েন
সাংয়ের রচনায় বলা হয়েছে , চুসাতাননা
নামে পশ্চিমাঞ্চললের একটি ছোটো
রাজ্য রেশমী পোকা চাষের পদ্ধতি
শিখাতে সমকালিন “পুর্ব রাজ্য”কে
যে অনুরোধ করে “পুর্ব রাজ্য”
তা প্রত্যাখ্যান করে । রেশমী
পোকার ডীম ও তুঁতের বীজ যাতে
চোরাইপথে বিদেশে না যায় তার
জন্য “পুর্ব রাজ্য” সীমান্তে
মাল পরীক্ষার ব্যবস্থা জোরদার
করে । চীনের পন্ডিদের গবেষনায়
জানা যায় , “পুর্ব রাজ্য” ছিল
উত্তর ওয়েই রাজ্য। চুসাতাননা
রাজ্যের রাজা যখন দেখলেন ,তাঁর
অনুরোধ“পুর্ব রাজ্য” কোনোক্রমে
গ্রহণ করবে না তখন তিনি একটি
নতুন উপায় ঠাওরালেন । দু রাজ্যের
বন্ধুত্বপুর্ণ সম্পর্কোন্নয়নের
নামে তিনি পুর্ব রাজ্যের সংগে
বৈবাহিক বন্ধন স্থাপনের প্রস্তাব
উত্থপান করলেন । তাঁর এই প্রস্তাব“পুর্ব
রাজ্য” গ্রহণ করল।পুর্ব রাজ্যের
রাজকুমারীকে আনার আগে চুসাতাননা
রাজ্যের রাজার দূত রেশমী পোকার
ডীম ও তুঁতের বীজ সংগে নিয়ে
যেতে গোপনে রাজকুমারীকে অনুনয়
করলেন ।উদার মনা রাজকুমারী
রাজী হলেন।পুর্ব রাজ্য থেকে
রওয়ানা হওয়ার আগে রাজকুমারী
রেশমী পোকার ডীম ও তুঁতের বীজ
টুপিতে ভেতরে লুকিয়ে রাখলেন
। সীমান্ত অতিক্রমনের সময়ে
রাজকর্মচারীরা তাঁর জিনিষপত্র
তন্ন তন্ন করে পরীক্ষা করলেন
।কিন্তু তাঁর টুপি পরীক্ষা
করার সাহস তাঁদের ছিল না।এইভাবে
রেশমী পোকার ডীম ও তুঁতের বীজ
চুসাতাননা রাজ্যে নিয়া যাওয়া
হলো এবং পরে রেশমী পোকা চাষের
পদ্ধতি পাশ্চাত্যে ছড়িয়ে পড়ল
।
হ্যাংগেরিয়ানবংশোদ্ভুত বৃটিশ
পরিব্রাজক স্টানইন চীনের সিনজিয়াংয়ে
প্রাচীনকালের কাঠে খোদাই করা
যেএকটি ছবি আবিস্কার করেছিলে
তা থেকে পশ্চিমাঞ্চলের ভ্রমন
কাহিনীর এই বিবরনের সত্যতার
প্রমান পাওয়া গেছে ।ছবির মাঝখানে
দামী পোষাক পরিহিত একজন অভিজাত
নারী , তাঁর দুপাশে দুজন পরিচারিকা
, বামদিকের পরিচারিকা দক্ষিন
হাতের আঙ্গুল দিয়ে অভিজাত নারীর
টুপি দেখাচ্ছে।এই অভিজাত নারীই
পুর্ব রাজ্যের রাজকুমারী যার
প্রচেষ্টায় রেশমী পোকার ডীম
ও তুঁতের বীজ পাশ্চাত্যে চলে
গেছে ।
|