রক্ষিতা ইয়াংয়ের পাত্তার রহস্য
 

      রক্ষিতা ইয়াংয়ের নাম ইয়ু হুয়ান । তিনি প্রথমে থাং রাজবংশের সম্রাট সিয়ানজংয়ের ছেলে লিমাওয়ের রক্ষিতা ছিলেন ।সম্রাট সিয়ান জং একদিন তাঁর রূপে মোহিত হয়ে তাঁকে রাজপ্রাসাদের দক্ষিণ ভবনে নিয়ে যান এবং তাঁকে থাইজেন নামক উপাধি দেন । দক্ষিণ ভবনের নাম বদলে যায় থাইজেন ভবন ,পরে তিনি থাইজেন ভবন ছেড়ে রাজপ্রাসাদের অন্যএকটি ভবনে বাস করেন।সম্রাট সিয়ান জংয়ের অনুগ্রহে তিনি সম্রাজ্ঞীর মত বিশেষ সুযোগ সুবিধা পেতেন। তখন সম্রাট সিয়ান জংয়ের বয়স ৫৬ বছর।রক্ষিতা ইয়াং ইয়ু হুয়ানের বয়স মাত্র ২২ বছর । 

  রক্ষিতা ইয়াং শুধু সুন্দরীই ছিলেন না , নৃত্যসংগীতেও পারদর্শী এবং বাকপটু ছিলেন। সবার সংগে তাঁর ব্যবহার ছিল মধুর । কথিত আছে , সম্রাট সিয়ান জং একদিন পালকশোভিত রংগীন জামা নামে তাঁর রচিত একটি সংগীতের সুরলিপি রক্ষিতা ইয়াংকে দিলেন । একবার পড়ে তিনি গাইতে গাইতে নেচে উঠলেন , এক দৃষ্টিতে তাঁকে দেখতে দেখতে সম্রাট সিয়ান জংয়ের মনে হয় ,কোনো পরী স্বর্গ থেকে মর্ত্যে নেমে এলেন ।তাঁকে অমুল্য রত্ন মনে করে সম্রাট সিয়ান জং তাঁকে আরো গভীরভাবে ভালোবাসতে শুরু করলেন । ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখিত আছে , সম্রাট সিয়ান জং সানসিয়াংইয়ের নুয়ের পাহাড় আরোহন করে দেবলোকের ন্যায় সুন্দর স্থানে দাঁড়িয়ে হঠাত শুনতে পেলেন স্বর্গের একটি সংগীত । রাজপ্রাসাদে ফিরে তিনি তা লিখে রাখলেন এবং তাতে ভারতীয় সংগীতের সুর মিশিয়ে দিলেন।এর নাম নিয়েছেন পালকশোভিত রংগীন জামা ।এই কথা মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত : শরত কালের একদিন সম্রাট সিয়ান জং ও রক্ষিতা ইয়াং তামিং ভবনে থাইইয়ে পুকুরের শ্বেতপদ্ম দেখছিলেন ।সম্রাট সিয়ান জং রক্ষিতা ইয়াংকে লক্ষ্য করে বললেন , সুকুমার শ্বেতপদ্মের রুপ আছে, কিন্তু লাবন্য নেই । আমার ফুল তুমি আমার কথা বুঝো , তোমার সংগে তুলনা করা যায় এমন ফুল নেই । তত্পরে《 আমার কথা বোঝা ফুল 》পরিণত হয়েছে সুন্দরীদের প্রশংসায় ব্যবহৃত একটি প্রবাদ ।  

  রক্ষিতা ইয়াংয়রের সুবাদে তাঁর বংশের সবাই সম্রাটের অনুদান পেয়েছে। তাঁর তিন বোনকে দেয়া হয়েছে রানীর মর্যাদা ।তাঁর একাধিক ভাই হয়েছেন রাজকর্মচারী ।তাঁর আপন ভাই ইয়াং চাওকে সম্রাট নাম দিয়েছেন ইয়াং গুও জং।পরে তিনি প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন এবং রাজসভার যাবতীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন।সম্রাট সিয়ান জং রুপসী আর সুগন্ধ মদ নিয়ে বিলাসী জীবন যাপন করতেন। তদানিন্তন রাজনীতি ক্রমশই ক্ষয়িঞ্চু হয়ে যায় । সমাজের দ্বন্দ্বগুলো দিন দিন তীব্র আকার ধারন করে ।অবশেষে জেনারেল আন লু সান যে রাজদ্রোহ করেন তাতে দেশব্যাপী গোলযোগের সুত্রপাত হয় ।রাজধানি জাং আনের পতনের পর সম্রাট সিয়ান জং সি চুয়ান প্রদেশের অভিমুখে পালিয়ে যান । মাহুইইয়ে পৌঁছতে না পৌঁছতে রাজকীয় বাহিনী সম্রাট সিয়ান জংয়ের হুকুম অমান্য করে ঘৃনার পাত্র ইয়াং গুও জংকে হত্যা করে এবং রক্ষিতা ইয়াং ইয়ু হুয়ানকে হত্যা করতে সম্রাট সিয়ান জংকে বাধ্য করে । অগত্যা সম্রাট সিয়ান জং খোজা গাও লি সির মাধ্যমে রক্ষিতা ইয়াং ইয়ু হুয়ানকে আত্মহত্যা করার হুকুম দেন । পান্থশালার পুজাঘরের সামনে একটি পিচ গাছের তলায় যখন রক্ষিতা ইয়াং ইয়ু হুয়ানকে গলা টিপে হত্যা করা হয় তখন তাঁর বয়স মাত্র ৩৮ বছর । কথিত আছে ,তাঁর লাশ নিয়ে যাওয়ার সময়ে তাঁর পা থেকে যে একটি জুতা খসে পড়ে তা কুড়িয়ে নেয় একজন বৃদ্ধা । পরে কোনো পথিক সেই জুতা দেখতে চাইলে টাকা খরচ করতে হত ।বৃদ্ধাটি এই জন্য ধনী হয়ে উঠেছিলেন । 

  রক্ষিতা ইয়াং ইয়ু হুয়ানের মৃত্যু সম্বন্ধে অনেক কিংবদন্তী আজো শোনা যায়। কেউ কেউ মনে করে , রক্ষিতা ইয়াং ইয়ু হুয়ান আত্মহত্যা করেন নি । অন্য একজন মেয়েই ইয়াং ইয়ু হুয়ান সেজে মৃত্যু বরন করে । চীনের ধ্রুপদি সাহিত্যকর্ম《লাল ভবনের স্বপ্ন》’ র বিখ্যাত গবেষক ইয়ু পিং পোও এই মত পোষণ করেন । তাঁর মতে , তখন যাকে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে সে অন্ত:পুরের একজন বাঁদী ।রক্ষিতা ইয়াং ইয়ু হুয়ান দীর্ঘ দুস্তর পথ অতিক্রম করে জাপানে পালিয়ে যান । ইয়াং গুও জংয়ের পুত্রবধু ও নাতি ইয়াং হুয়ানও তাঁর সংগে ছিল । এমন জনশ্রুতিও আছে যে , ইয়াং ইয়ু হুয়ান জাপানে অবস্থানকালে নাকি রাজদরবারের একটি অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করে দিতে জাপানের সম্রাটকে সাহায্য করেছিলেন । জাপানে এখনো নাকি রক্ষিতা ইয়াং ইয়ু হুয়ানের দুটো কবর আছে । 

  ১৯৬৩ সালে জাপানের একজন মেয়ে টিভি দর্শকদের সামনে তাঁর বংশতালিকা দেখিয়ে দাবী করেছেন যে,তিনি ইয়াং ইয়ু হুয়ানের বংশধর । জাপানের খ্যাতনামা চলচ্চিত্র তারকা ইয়ামাগুজি মোমোয়াও সগৌরব ঘোষনা করেছেন ,তিনি ইয়াং ইয়ু হুয়ানের বংশধর । 

  জাপানে আরেকটি জনশ্রুতি হল এই যে , রাজকীয় বাহিনীর সেনাপতি জেন সিয়ান লি ইয়ান ইয়ু হুয়ানকে গ্রেফতারের পর তাঁর সৌন্দর্যে মুদ্ধ হলেন ।তাই তাঁকে হত্যা করার আদেশ অগ্রাহ্য করেন । কিভাবে তাঁকে বাঁচানো যায় তা নিয়ে গোপনে খোজা গাও লি সির সংগে আলোচনা করা হয় ।তাঁরা ফন্দি এঁটে ইয়ান ইয়ু হুয়ানের পোষাক পরিহিত একজন বাঁদীকে হত্যা করেন । খোজা গাও লি সি মেকী ইয়াং ইয়ু হুয়ানের লাশ গাড়িতে চাপিয়ে সেনানিবাসে যান । তন্ন তন্ন করে লাশ সনাক্ত করার পর সেনাপতি জেন সিয়ান লি সবার সামনে ঘোষনা করেন ,লাশটি ইয়ান ইয়ু হুয়ানের । আসল ইয়াং ইয়ু হুয়ান সেনাপতি জেন সিয়ান লির বিশ্বস্ত দেহরক্ষীদের সাহায্যে দক্ষিনাঞ্চলে পালিয়ে যান । সাংহাইয়ের অদুরে জাহাজে চড়ে সমুদ্র পাড়ি দেন এবং জাপানের ইয়ামা গাজি জেলার নাগাজি মহকুমায় অবতরণ করেন । 

  সম্রাট সিয়ান জং জেনারেল আন লু সানের পরিচালিত রাজদ্রোহ দমন করার পর ফাংসিকে জাহাজে করে বিদেশে গিয়ে ইয়ান ইয়ু হুয়ান খোঁজার হুকুম দেন । ফাংসি জাপানের ইয়াং ইয়ু হুয়ানের সন্ধান পান এবং সংগে নিয়া যাওয়া সম্রাট সিয়ান জংয়োর উপহার-- দুটো বৌদ্ধের মুর্তি ইয়াং ইয়ু হুয়ানের হাতে দিয়ে দেন । প্রতিদানে ইয়াং ইয়ু হুয়ান তাঁর জেড পাথরের কাঁটা নিয়ে যেতে ফাংসিকে অনুরোধ করেন । এই দুটো বৌদ্ধের মুর্তি এখনো জাপানের নাগাজি মহকুমার একটি আঙ্গিনায় সংরক্ষিত । ইয়াং ইয়ু হুয়ান মারা যাওয়ার পর তাঁকে আঙ্গিনায় সমাহিত করা হয় । পরে তাঁর কবরের উপরে পাথর দিয়ে পাঁচটি প্যাগোডা নির্মিত হয় । তাঁর কবরের সামনে যে দুটো কাঠের ফলক পোঁতা রয়েছে তার একটিতে পাথরের প্যাগোডা নির্মানের ইতিহাস লেখা রয়েছে। অন্যটিতে লেখা রয়েছে: রক্ষিতা ইয়াং ইয়ু হুয়ানের কবর --থাং রাজবংশের ষষ্ঠ সম্রাট সিয়ান জংয়ের অনুগ্রহপ্রাপ্ত রক্ষিতা ইয়াং ইয়ু হুয়ান রোমান্টিক কাহিনী, রহস্য ও কিংবদন্তী সমেত । রক্ষিতা ইয়াং ইয়ু হুয়ানের কবরের সামনে পুজা করা জাপানীদের সখ ।তাঁরা মনে করেন , পুজা করলে দম্পতির মিষ্টি বাচ্চা পাওযা যাবে ।জানা গেছে , জাপান ইয়াং ইয়ু হুয়ানের সমাধিস্থল পর্যটনের স্থান হিসেবে দর্শকদে রজন্য খোলার প্রস্তুতি নিচ্ছে ।