ইতিহাসে চীনের পাঁচটি ঐশ্বর্যময় যুগ
 

      দুই সহ্স্রাধিক বত্সরস্থায়ী চীনের সামন্ততান্ত্রিক সমাজে যে একাধিক শ্রেষ্ঠ যুগ আবির্ভুত হয়েছিল ইতিহাস-গ্রন্থে সেগুলোকে ঐশ্চর্যময় যুগ বলে অভিহিত করা হয়।যেমন পশ্চিম হান রাজত্বকালে সম্রাট ওয়েন ও সম্রাট চিং সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার সময়ে চীন সমৃদ্ধ ছিল এবং সম্রাট উয়োর শাসনামলে পশ্চিম হান সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধি শীর্ষশিখরে উপনীত হয় ।থাং রাজবংশের সম্রাট লি সি মিংয়ের শাসনকালে সমাজে সুশৃংখলা পুনর্প্রতিষ্ঠিত হয় , সম্রাট লি লং জির শাসনামলে খাই ইউয়ান নামক ঐশ্বর্যময় যুগের জন্ম হয় । মিং রাজবংশের সম্রাট জু দি ও সম্রাট জু জাশের শাসনকাল এবং ছিং রাজবংশের সম্রাট সুয়ান হুয়া এ ও সম্রাট ইন জেনের রাজত্বকালও ঐশ্চর্যময়যুগ বলে পরিচিত । যুদ্ধমান যুগেও স্বল্পকালেরসমৃদ্ধি পরিলক্ষিত ছিল ।তবে শুধু খাই ইউয়ান নামক ঐশ্চর্যময় যুগ ও ছিং রাজত্বকালের খাং-চিয়ান নামক ঐশ্বর্যময় যুগ চীনা ভাষার দুটো বিশেষ্যে পরিণত হয়েছে ।

চীনের পাঁচটি ঐশ্বর্যময় যুগের প্রতিটি যুগ পুর্ববর্তী যুগের গোলযোগের অবসানের পর নব রাজবংশ উত্থানের প্রক্রিয়ায় সমৃদ্ধির শীর্ষে পৌঁছে ।ছিন রাজবংশের ধ্বংসাবশেষের উপরে পশ্চিম হান সামন্ততান্ত্রিক রাজবংশ প্রতিষ্ঠিতহয় । প্রায় ১৭০ বছর কৃষি উন্নয়ন সাধনের বহুমুখী ব্যবস্থা নেয়ার পর ঐশ্বর্যময় যুগ দেখা দেয় । সুই রাজত্বকালের শেষদিকে গোলোযোগ সমাপ্ত হওয়ার পর বন্ধুর পথে সুশাসনের দিকে এগুতে এগুতে প্রায় একশো বছর অতিবাহিত হয় এবং অবশেষে থাং রাজবংশের খাং-চিয়ান ঐশ্বর্যময় যুগ আবির্ভুত হয় । মিং রাজত্বকলে স্থানীয় অধিপতিদের পরাভূত করা এবং ইউয়ান রাজবংশের শাসকদের মহাপ্রাচীরের বাইরে তাড়িয়ে দেয়ার পর দেশের একীকরণ বাস্তবায়িত হয় , অর্ধ শতকের কঠোর প্রচেষ্টায় সম্রাট জু দি ও সম্রাট জু জানের রাজত্বকালে ঐশ্বর্যময় যুগ দেখা দেয়।সম্রাট সেনজংয়ের শাসনকালের মধ্যভাগে হট্টগোলের লক্ষণ অনবরত দৃষ্টিগোচর হয়। সম্রাট সিজং ও সম্রাট ছংজেনের শাসনকালে ভয়াবহ হট্টগোল ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে । ছিং রাজবংশের সৈন্যবাহিনীর মহাপ্রাচীর অতিক্রমনের আগ পর্যন্ত প্রায় অর্ধ শতাব্দি ধরে হট্টগোল স্থায়ী ছিল ।মধ্যচীনে ছিং রাজশাসন কায়েমের পর লি জি ছেং ও জাং সিয়ান জংয়ের নেতৃত্বাধীন কৃষক বিদ্রোহী বাহিনী উত্খাত করতে এবং দক্ষিণ চীনে মিং রাজবংশের অবশিষ্ট শক্তি নির্মুল করতে সময় লেগেছে বিশ বছর । ছিং রাজবংশ ছিল মিং রাজত্বকালের শেষভাগে দারুন গোলমালের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত একটি নতুন রাজবংশ । আরো প্রায় ৭০ বছর কেটে যাওয়ার পর দেশব্যাপী গোলোযোগ সামাজিক সুশৃংখলায় রুপান্তরিত হয় । যুদ্ধমান যুগের অবস্থা কিছুটা পৃথক । তখন সাতটি রাজ্য বিরাজ করছিল বলে সর্বত্রই উচ্ছৃঙখলতা চোখে পড়ে । বস্তুত: বসন্ত -শরত যুগে ধর্ম ও সামাজিক রীতির অবনতি ঘটে , দীর্ঘকালীন যুদ্ধে ছোটো ছোটো রাজ্য বিলুপ্ত হয় এবং বাকী সাতটি রাজ্য নিয়ে নতুন রাজনৈতিক কাঠামো সৃষ্টি হয় ।সাতটি রাজ্যের স্থিতিশীলতা অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ দিনের ।অবশেষে ছিন রাজ্য অন্য ছটি রাজ্য অধিকার করায় সামাজিক সুশৃংখলা চরমে পৌঁছে । 

শক্তিশালি একীভূত দেশ , সমৃদ্ধশালি অর্থনীতি , স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সমাজের দীর্ঘকালীন শান্তি ও বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতিই সকল ঐশ্বচর্যময় যুগের অভিন্ন বৈশিষ্ট্য । 

বসন্ত -শরত যুগে কনফুসিয়াসের চোখে ধর্ম ও সামাজিক রীতির অবনতি হল সমাজের বিশৃংখলার নামান্তর ।তবে এতে প্রতিপন্ন হয়েছে যে , পুরনো সমাজ ব্যবস্থা ধ্বংসের অভিমুখে এবং নতুন সমাজ ব্যবস্থা আসন্ন । যুদ্ধমান যুগের প্রথম দিকে লিখুই ওয়ে রাজ্য এবং উছি ছু রাজ্যে সংস্কার শুরু করেন ।যুদ্ধমান যুগের মধ্য আর শেষ ভাগে সংস্কারের সুবাদে ছিন রাজ্য, হান রাজ্য,ছি রাজ্য, চাও রাজ্য ও ইয়ান রাজ্যও শক্তিশালি হয়ে উঠে । বিশেষ করে ছিন রাজ্যে সাংইয়াং অপেক্ষাকৃত গভীর সংস্কার অভিযান চালানোর ফলে অন্য ছটি রাজ্যের চেয়ে ছিন রাজ্য অধিক শক্তিশালি হয়ে উঠে । সাতটি রাজ্যের সংস্কার অল্পবিস্তর হলেও সম্পূর্ণভাবে বা মোটামুটি সমাজ ব্যবস্থা সংস্কারের কাজ সম্পন্ন হয় এবং সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা দাস ব্যবস্থার স্থলাভিষিক্ত হয় । 

পশ্চিম চৌ রাজত্বকালে রাজপরিবারের সদস্যদের ভুমির মালিকানা দান করা হত। বসন্ত -শরত যুগে ছোটো রাজ্যগুলোর পারস্পরিক আগ্রাস চলতে থাকে।যুদ্ধমান যুগে টিকে ছিল মাত্র সাতটি রাজ্য । পরবর্তী যুগে দেশের বিভক্তির সংগে এর মৌলিক পার্থক্য ছিল । ছিন রাজত্বকালের পুর্বগামী সিয়া , সাং ও চৌ রাজত্বকালে চীনদেশ প্রকৃতপক্ষে একীভুত ছিল না ।তবে সিয়া , সাং ও চৌ রাজবংশের রাজাকে কেন্দ্র করে বংশীয় জোট প্রতিষ্ঠিত হয় ।তাই যুদ্ধমান যুগকে বিভক্তির ফলশ্রুতি বলা যায় না ।বসন্ত -শরত যুগে অনেকগুলো ছোটো রাজ্য একত্রীত হতে হতে যে যুদ্ধমান যুগের সাতটি রাজ্যে পরিণত হয়েছে তা একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। সাতটি রাজ্য যে অবশেষে ছিন রাজ্যে পরিবর্তিত হয় এবং ছিন রাজবংশের প্রথম সম্রাট ইনজেন কেন্দ্রীয় একনায়কতন্ত্র প্রবর্তন করেন তা বসন্ত -শরত যুগ ও যুদ্ধমান যুগের ইতিহাস বিকাশের ফল্শ্রুতি । 

প্রথম সম্রাট ইনজেন ভুমির মালিকা দান প্রথা রহিত করে সারাদেশে বিভাগ ও জেলা এই দুই স্তরের প্রশাসন চালু করেন । তিনি স্বয়ং কেন্দ্র সরকারের প্রধান।তিনিই প্রথমে বসন্ত -শরত যুগে পন্ডিতদের কল্পিত দেশের একীকরণকে বাস্তবে পরিণত করেন । এরপর সমাজ বিকশিত হয়েছে কিনা একীকরণ ও বিভক্তি হল তা বিচারের অন্যতম মাপকাঠি । অবশ্য এই কথা বলা যায় না যে , একীকরণ মানেই ষোলো আনা নির্ভুলতা এবং বিভক্তি মানেই ষোলো আনা অপরাধ।যখন কোনো রাজবংশ ক্ষয়িষ্ণু হয়ে যায় ,উত্পাদন শক্তির বিকাশ বিঘ্নিত হয়,এমনকি পশ্চাদ্ধাবন করে এবং জনসাধারণ দু:খদুর্দশায় নিমজ্জিত হয় তখন কৃষক বিদ্রোহ যে তার “একীকরণ” ভেংগে দেয় তা একান্ত প্রয়োজন ।তখন তার প্রশংসা করে বলতে হবে যে ,এটা একটি ভাল ব্যাপার ।এই দৃষ্টিভংগী যে সঠিক তার প্রমান পাওয়া যায় চীনের কৃষক বিদ্রোহের ইতিবাচক ভুমিকার স্বপক্ষে চেয়ারম্যান মাও জে তংয়ের বক্তব্য থেকে । কিন্তু বিভক্তি একদিন না একদিন একীকরণে রুপান্তরিত হয়,এটা চীনের ইতিহাসের বিকাশের একটি নিয়ম।চীনদেশের একীকরণ সর্বদাই যে সমর্থিত হয় , তার কারন তা সমাজের উত্পাদন ও জনসাধারণের স্বার্থের অনুকুল এবং তা শান্তিময় সামাজিক পরিবেশ বয়ে আনে।সুতরাং দেশের একীকরণ কী মাত্রায় বাস্তবায়িত হয়, তা ঐশ্বর্যময় যুগ যাচাইয়ের গুরুত্বপূর্ণ মানদন্ড ।পশ্চিম হান রাজত্বকালে সম্রাট ওয়েন ( খ্রীষ্টপুর্ব ১৭৯ অব্দ থেকে খ্রীষ্টপুর্ব ১৫৭অব্দ পর্যন্ত), সম্রাট জিন(খ্রীষ্টপুর্ব ১৫৬ অব্দ থেকে খ্রীষ্টপুর্ব ১৪১অব্দ পর্যন্ত )এবং সম্রাট উ (খ্রীষ্টপুর্ব ১৪০ অব্দ থেকে খ্রীষ্টপুর্ব ৮৭অব্দ পর্যন্ত) সাম্রাজ্য সম্প্রসারনের উদ্যোগ নেন । উত্তর দিকে সাম্রাজ্য বিস্তারিত করতে হুনদের সংগে যে যুদ্ধ বাঁধে তা অর্ধ শতাব্দী ধরে চলেছিল এবং অবশেষে হুনদের মরুভুমির উত্তরাঞ্চলে তাড়িয়ে দেয়া হয় ,ফলে হুনদের দখলকৃত মরুভুমির দক্ষিণাঞ্চল ও হোয়াংহো নদীর উত্তর দিকে কানসু প্রদেশের বিস্তীর্ন অঞ্চল হান সাম্রাজ্যভুক্ত হয় ।পশ্চিম দিকে সামরিক অভিযান চালালে ইয়ুমেনকুয়ানের পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণ সিনজিয়াং যা পশ্চিমদেশ বলে পরিচিত তা সবই হান সাম্রাজ্যভুক্ত হয়।পুর্বদিকে যে সামরিক অভিযান চালানো হয় তাতে কোরিয় জাতির শাসকরা পরাজিত হয় এবং তাদের শাসিত লিয়াওতং অঞ্চলের কিছু অংশ হান রাজবংশের শাসনাধীনে আনা হয় ।দক্ষিণ,দক্ষিণ পশ্চিম আর দক্ষিণ পুর্ব দিকে সামরিক অভিযান চালানোর ফলে বর্তমান কুয়াংতং , ইয়ুননান ,জেজিয়াং ও ফুচিয়ান প্রদেশের উপজাতি অধ্যুষিত এলাকা হান সাম্রাজ্যভুক্ত হয় । প্রকৃতপক্ষে সম্রাট উয়ের শাসনকালে হান সাম্রাজ্য ছিন সাম্রাজ্যের চেয়েও বড় ছিল। 

হান সাম্রাজ্যর তুলনায় থাং সাম্রাজ্য অধিক বিস্তৃত ছিল ।তবে চীনের ইতিহাস-গ্রন্থে হান সাম্রাজ্য ও ছিন সাম্রাজ্য দুটো সমতুল্য সাম্রাজ্য বলে উল্লেখিত।থাং রাজত্বকালে উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে তুর্ক উপজাতিকে পরাজিত করে সেখানে থাং রাজদরবারের স্থানীয় সরকারের অফিস খোলা হয় ।উত্তর পুর্বাঞ্চলে কোরিয় জাতির সৈন্যবাহিনীকে চুড়ান্তভাবে পরাস্ত করে সেখানেও থাং রাজদরবারের স্থানীয় সরকারের অফিসভবন নির্মিত হয় । হেইলংজিয়াং অঞ্চলে থাং রাজদরবারের প্রদেশ পর্যায়ের প্রশাসকের কার্যালয়ও খোলা হয় । 

হান ও থাং রাজত্বকালে অভুতপুর্ব একীকরণ বাস্তবায়িত হয় ।হান ও থাং রাজত্বকাল চীনের আয়তন বৃদ্ধির দুটো গুরুত্বপুর্ণ ঐতিহাসিক যুগ । 

মিং রাজবংশের সম্রাট জুদি ও সম্রাট জুজানের শাসনকালে উত্তর ও উত্তর পশ্চিম দিকে ইউয়ান রাজপরিবারের বংশধরদের উপরে হামলা চালিয়ে মরুভুমির দক্ষিণাঞ্চল আর উত্তরাঞ্চলকে মিং সাম্রাজ্যভুক্ত করা হয় । কেন্দ্র সরকার- নিয়ন্ত্রিত দক্ষিণাঞ্চল ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল অর্থাত বর্তমান ইয়ুন নান 、গুইচৌ ও সিচুয়ান প্রদেশ স্থানীয় উপজাতির অধিপতিদের শাসন করতে দেয়া হয়।উত্তর পুর্বাঞ্চল অর্থাত বর্তমানের খাই ইউয়ান থেকে সিং আন পর্বতমালার উত্তরাঞ্চল পর্যন্ত এবং পুর্বদিকের খুউ(বর্তমানখুইয়ে দ্বীপ ) পর্যন্ত বিস্তীর্ন অঞ্চলে কয়েকটি জেলা নিয়ে সামরিক এলাকা গঠিত হয় । সামরিক এলাকাগুলোর সেনাপতি প্রাদেশিক শাসকদের অধীনে থাকেন ।প্রতিবেশী দেশ যেমন ভিয়েতনাম 、 সিয়াম ও কোরিয়া সবই মিং রাজদরবারের আনুগত্য স্বীকার করত।সম্রাট জুজানের মৃত্যুর পর মহাপ্রাচীরের উত্তারাঞ্চল ও উত্তর পশ্চিমাঞ্চল আবার মঙ্গোলিয় জাতির নিয়ন্ত্রনে চলে যায় । মিং রাজদরবার ও মঙ্গোলিয় রাজদরবারের মধ্যে কখনো কখনো যুদ্ধ বাঁধে কখনো কখনো আবার শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয় । মিং সাম্রাজ্য কিঞ্চিত সংকোচিত হয় । সাম্রাজ্যের বিশালতা আর একীকরণের মাত্রার দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায় যে , ইউয়ান সাম্রাজ্য ব্যতিত শুধু ছিং রাজবংশের সম্রাট ইয়োংজেন ও চিয়ানলংয়ের শাসনকালে ছিং সাম্রাজ্য হান ও থাং সাম্রাজ্যের চেয়ে অধিক বিস্তীর্ন ছিল ।সম্রাট ইয়োংজেন বলেছিলেন: প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত বিশাল ছিং সাম্রাজ্য অদ্বিতীয় । একীভূত চীনের পূর্ব,পশ্চিম,দক্ষিণ আর উত্তর দিকে ছিং রাজদরবারের প্রভাব ও প্রতিপত্তি অতুলনীয় ।বস্তুত: ২৪ চিয়ানলং -অব্দীতে পশ্চিমাঞ্চলের জেনগিরের উপজাতির সৈন্যবাহিনীকে পরাভূত করা হয় এবং ছিংহাই প্রদেশ, দক্ষিণ আর উত্তর সিনজিয়াং এবং তিববত কেন্দ্রীয় সরকারের শাসনাধীনে আনা সম্ভব হয় । পশ্চিম দিকে ছিং সাম্রাজ্য বারকেস হ্রদের পুর্বতীর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল ।উত্তর দিকে মঙ্গোলিয়ার মরুভুমির দক্ষিনাঞ্চল আর উত্তরাঞ্চলে প্রদেশ আর জেলা পর্যায়ের শাসন ব্যবস্থা চালু করা হয় । দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে সহস্রাধিক বত্সর বলবত হওয়া দাসত্ব- প্রথা রহিত করা হয় ।উত্তর পুর্ব দিকে হেইলংজিয়া নদীর উত্তরাঞ্চল এবং বাইরের সিং আন পর্বতমালার দক্ষিনাঞ্চল ছিং সাম্রাজ্যভুক্ত । পুর্বদিকে উসুলিজিয়া নদীর পুর্বধার থেকে সমুদ্রের তীর পর্যন্ত বিস্তীর্ন অঞ্চল ছিং সাম্রাজ্যভুক্ত। দক্ষিনপুর্বদিকে তাইওয়ান দ্বীপ এবং দক্ষিণ দিকে নানসা দ্বীপপুঞ্জ ছিং সাম্রজ্যভুক্ত হয় । ছিং রাজদরবার প্রদেশগুলোর প্রশাসক নিয়োগ করে এবং প্রতিটি প্রদেশে সরকারী বাহিনী মোতায়েন করে।চীনের সত্যিকারের বৃহত একীকরণ তখনই বাস্তবায়িত হয় ।পঞ্চশটিরও বেশী জাতি থাকে কেন্দ্রীয়সরকারের শাসনাধীনে । সম্রাট খাংসি মহাপ্রাচীর মেরামত করার যে পরিকল্পনা পরিহার করেন ,তাতে ২০০০ হাজার বছর ধরে মহাপ্রাচীরের উত্তরাঞ্চলকে বিদেশ বলে গণ্য করার চিরাচরিত ধারনাকে চীনাদের মন থেকে মুছে ফেলা হল । ফলে মহাপ্রাচীরের দক্ষিণনাঞ্চল আর উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জাতির জনগণের একই পরিবারের সদ্স্য হওয়ার স্বপ্ন সফল হল । এটা আধুনিক চীনের অবয়ব আর বহু জাতি বিশিষ্ট চীনদেশ পত্তনের ভিত্তি স্থাপন করেছে।(উল্লেখ্য: বর্তমান চীনের আয়তন সম্রাট খাংসি ও সম্রাট চিয়ানলংয়ের শাসনামলে ছিং সাম্রাজ্যের এক চতুর্থাংশমাত্র )
 

চীনের প্রতিটি ঐশ্বর্যময় যুগে মহা একীকরণের সুবাদে দীর্ঘকালীন সামাজিক সুশৃংখলা বিরাজমান ছিল , বছরের পর বছর কৃষি উত্পাদন বৃদ্ধির কারনে সরকারের গুদাম খাদ্যশস্যে পরিপুর্ণ , খাদ্যশস্যের চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেশী ছিল । সম্রাট উয়োর শাসনামলে ষাট বছর ধরে শান্তি বিদ্যমান ছিল , রাষ্ট্রের গুদাম খাদ্যশস্যে ভরা ।থাং রাজবংশের সম্রাট লি লং জির শাসনামলে প্রজাদের গোলায় কয়েক বছরের মজুত খাদ্যশস্য ছিল । মিং রাজবংশের সম্রাট জু দি ও সম্রাট জু জানের শাসনকালে খাম্যশস্যের অভাব ছিল না । ছিং রাজবংশের সম্রাট খাংসির শাসনকালে দেশের পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য মজুত করা হত । ৫০খাংসি-অব্দী থেকে তিন বছরের মধ্যে এক এক প্রদেশে কেন্দ্রীয় সরকারের এক সপ্তাহের রাজস্ব মওকুফ করা হত । প্রতি বছর স্থানীয় সরকারও কৃষকদের রাজস্ব মওকুফ করে ।সম্রাট খাংসির শাসনকালে মওকুফ করা রাজকরের পরিমান ছিল মোট ১৪ কোটি লিয়াং (মুদ্রার একক) রোপ্য ।সম্রাট ছিয়ানলংয়ের রাজত্বকালে চীনদেশ অভুতপুর্ব সমৃদ্ধ , রাজকোষের মজুত অর্থ রেকর্ড সৃষ্টি করে । সারাদেশে পরপর চার বার যে রাজস্ব মওকুফ করা হয় তার মোট পরিমান ১২ কোটি লিয়াং রৌপ্য। রাজধানী ও সৈন্য বাহিনীর জন্য জলপথে স্থানীয় সরকারের সরবরাহ করা খাদ্যশস্য যে তিনবার কমিয়ে দেয়া হয় তার মোট পরিমান ছিল আনুমানিক পাঁচ লক্ষ টন । রাজকোষে মজুত অর্থের পরিমান সাধারনত ছয় কোটি থেকে সাত কোটি লিয়াং রৌপ্য,সর্বোচ্চ রেকর্ড ছিল আট কোটি লিয়াং রৌপ্য । যুদ্ধের সময়ে প্রচুর সামরিক ব্যয় হলেও রাজকোষে ন্যুনতম মজুত অর্থের পরিমান ছিল দু কোটি থেকে তিন কোটি লিয়াং রৌপ্য এবং সর্বোচ্চ পরিমান ছিল ছয় কোটি লিয়াং রৌপ্য ।