《যুদ্ধে সুনফুসিয়ার রণনীতি ও কৌশল》যেমন চীনের প্রাচীনকালের সর্বাপেক্ষা মহান সামরিক তত্ত্ব বিষয়ক গ্রন্থ, তেমনই পৃথিবীতে সর্বাপেক্ষা ব্যাপক প্রভাব বিস্তারকারী চীনের প্রাচীন গ্রন্থগুলোর অন্যতম। এই গ্রন্থে বিবৃত রণনীতি ও দার্শনিক চিন্তাধারা সমরবিদ্যা、 রাজনীতি 、অর্থনীতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা হয় ।আড়াই হাজার বছর আগে রচিত 《যুদ্ধে সুনফুসিয়ার রণনীতি ও কৌশল》পৃথিবীতে সবচেয়ে আগে রচিত একটি সামরিক তত্ত্ব বিষয়ক গ্রন্থ ।উইরোপের ক্লাউসেয়িটসের রচিত 《 যুদ্ধ প্রসংগে 》র চেয়ে দু হাজার তিন শো বছর আগে এই বিখ্যাত গ্রন্থ রচিত হয়েছে ।
《 যুদ্ধে সুনফুসিয়ার রণনীতি ও কৌশল》এর রচয়িতা সুন উ চীনের বসন্ত-শরত যুগের মহান সমরবিদ । চীনের ইতিহাসে তাঁকে দিকবিজয়ী সমরবিশারদ ও অজেয় জেনারেল বলে আখ্যায়িত করা হয় ।
বসন্ত-শরত যুগে যুদ্ধের দুর্যোগ এড়ানোর জন্য সুন উ উ রাজ্যে পালিয়ে যান । উ রাজ্যের রাজা তাঁকে সেনাপতিপদে নিয়োগ করেন ।তিনি তিরিশ হাজার সৈন্য নিয়ে যে ছু রাজ্যের দু লক্ষ সেনাকে পরাজিত করেন তাতে অন্যান্য রাজ্যের অধিপতিরা ভীতসন্ত্রস্ত হন । সুন উ বসন্ত-শরত যুগের শেষভাগ আর পুর্ববর্তী কালের যুদ্ধের অভিজ্ঞার সারসংকলন করে 《যুদ্ধে সুনফুসিয়ার রণনীতি ও কৌশল》 রচনা করেন । তিনি এই গ্রন্থে যুদ্ধের সার্বজনিন নিয়মগুলো বিবৃত করেন এবং পুর্ণাংগ সামরিক তত্ত্ব প্রবর্তন করেন ।
১৩ অধ্যায় বিশিষ্ট এই গ্রন্থের
চীনা শব্দসংখ্যা ছয় হাজারেরও
বেশী । প্রতিটি অধ্যায়েরএকটি
প্রধান বিষয় আছে ।উদাহরণস্বরুপ:
পরিকল্পনা নামক অধ্যায়ে যুদ্ধ
শুরু করা যায় কিনা তা আলোচিত
হয়েছে ।এই অধ্যায় রাজনীতি আর
অর্থনীতির সংগে যুদ্ধের ঘনিষ্ঠ
সম্পর্ক বিশ্লেষণ করা হয়েছে
এবং উল্লেখ করা হয়েছে যে রাজনীতি、আবহাওয়া、
ভৌগোলিক পরিবেশ ,সেনাপতি ও
জেনারেল এবং আইন ব্যবস্থাই
যুদ্ধের জয়পরাজয় নির্দ্ধারণের
পাঁচটি মৌলিক উপাদান । তবে
রাজনীতিই প্রধান উপাদান । যুদ্ধ
নামক অধ্যায়ে কীভাবে লড়াই পরিচালনা
করতে হয়, তা বর্ননা করা হয়েছে
। আক্রমণ নামক অধ্যায়ে শত্রুদেশের
উপরে আক্রমণ চালানোর কলাকৌশল
বর্ননা করা হয়েছে । সুন মনে
করতেন , যতদুর সম্ভব কম মুল্যের
বিনিময়ে বৃহততম সাফল্য অর্জনের
প্রয়াস চালাতে হবে , এমন কি
যুদ্ধ না করে বিজয় লাভে সচেষ্ট
হতে হবে এবং খামোখা জোরপুর্বক
আক্রমণের দ্বারা শত্রুপক্ষের
শহর দখল করা ও দীর্ঘস্থায়ী
যুদ্ধের দ্বারা শত্রুদেশকে
পরাভুত করা সমীচিন নয় । এই
লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনি রণকৌশল
প্রয়োগ করে বিজয় লাভের উপরে
বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করতেন
। তিনি উল্লেখ করেন : সামরিক
অভিযান চালানোর শ্রেষ্ঠ উপায়
হলো , রাজনীতির দ্বারা বিজয়
অর্জন করা , তা সম্ভব না হলে
কূটনৈতিক উপায়ে বিজয় অর্জনের
প্রচেষ্টা চালাতে হবে ,তাও
যদি সম্ভব না হয় তবে বিজয় অর্জনের
জন্য শক্তি প্রয়োগ করা হবে
, নিকৃষ্ট উপায় হলো শত্রুপক্ষের
শহরের উপরে আক্রমন চালানো ।আক্রমন
চালানোর জন্য শুধু নিজের শক্তি
জানলে চলবে না ,শত্রুপক্ষের
অবস্থাও জানা দরকার।গুপ্তচরবৃত্তি
নামক অধ্যায়টিতে সুন উ উল্লেখ
করেছেন ,শত্রুপক্ষের অবস্থা
জানার জন্য নানা রকমের গুপ্তচর
কাজে লাগিয়ে বিস্তারিত গুপ্ততথ্য
সংগ্রহ করতে হবে । 《 যুদ্ধে
সুনফুসিয়ার রণনীতি ও রণকৌশল》গ্রন্থে
অনেক মুল্যবান দার্শনিক দৃষ্টিভংগী
অন্তর্নিহিত রয়েছে । যেমন ,নিজের
আর শত্রুপক্ষের অবস্থা গভীরভাবে
জানলে শত যুদ্ধে শত বিজয় লাভ
করা যায় , এই বাক্য এখনো চীনাদের
মুখে মুখে প্রচলিত ।
দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভংগীতে পরিপূর্ণ এই গ্রন্থে যুদ্ধের সংগে সম্পর্কিত অনেকগুলো দ্বন্দ্ব-সংশ্লিষ্ট দুপক্ষের বিরোধ ও রুপান্তর নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে । যেমন নিজ পক্ষ ও শত্রু পক্ষের মধ্যকার দ্বন্দ্ব , বাস্তবতা ও আত্মমুখীনতার মধ্যকার দ্বন্দ্ব, অত্যধিক ও স্বল্পের মধ্যকার,সবল ও দুর্বলের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, আক্রমণ ও আত্মরক্ষার মধ্যকার দ্বন্দ্ব, অনুকুল ও প্রতিকুলেরমধ্যকার দ্বন্দ্ব ইত্যাদি । এই সব দ্বন্দ্বআর দ্বন্দ্ব-সংশ্লিষ্ট দুপক্ষের রুপান্তরের শর্ত গবেষণার ভিত্তিতে সুন উ যুদ্ধের রণনীতি ও রণকৌশল প্রনয়ণ করেছেন ।তাঁর দ্বান্দ্বিক মতবাদ চীনের দ্বান্দ্বিক চিন্তাধারার বিকাশের ইতিহাসে গুরুত্বপুর্ণ স্থান অধিকার করেছে । তাঁর এই গ্রন্থে সমাবেশিত রণকৌশল ও সমর পদ্ধতি যুগ যুগ ধরে চীনের সমরবিশারদরা প্রয়োগ করেছেন । একাধিক রণকৌশল ও কাহিনী চীনে সর্বজনবিদিত । এই গ্রন্থের সামরিক বিদ্যা আর দার্শনিক মতবাদ ,সুগভীর দার্শনিক চিন্তাভাবনা , পরিবর্তনশীল রণনীতি আর রণকৌশল এবং অফুরন্ত শিল্পরস বিশ্বের সামরিক চিন্তাধারার ক্ষেত্রেও ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে এবং সুনাম অর্জন করেছে ।
《যুদ্ধে সুনফুসিয়ার রণনীতি ও রণকৌশল》ইংরেজী ভাষা 、রুশ ভাষা 、জার্মান ভাষা、জাপানী ভাষা প্রভৃতি ২৯টি বিদেশী ভাষায় অনুদিত হয়েছে । পৃথিবীতে এই গ্রন্থের হাজারখানেক সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে । অনেক দেশের সামরিক কলেজের পাঠ্যক্রমে এই গ্রন্থকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ।খবরে প্রকাশ, ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়ে যুদ্ধরত দুপক্ষে একাগ্র চিত্তে এই গ্রন্থ পড়ে যুদ্ধ পরিচালনায় সুন উ’র সামরিক মতবাদ প্রয়োগ করেছে ।《যুদ্ধে সুনফুসিয়ার রণনীতি ও রণকৌশল》সমাজ ও বানিজ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হয় । চীন ও বিদেশের বহু শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও শিল্পপতিরা ব্যবস্থাপনা ও পণ্য ক্রয়বিক্রয়ে সুন উয়ের রণনীতি ও রণকৌশল প্রয়োগ করে সুফল পেয়েছেন ।
|