ছিং রাজবংশ ১৬৪৪ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৯১১ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল ।নুরহাচি নিজকে সম্রাট ঘোষনা করার দিন থেকে শেষ সম্রাট ফুইয়ের সিংহাসনচ্যুতি পর্যন্ত মোট ১২জন সম্রাট রাজত্ব করেছেন । মহাপ্রাচীরের শানহাইকুয়ান সিংদ্বার পার হয়ে চীনের মুলভুভাগে প্রবেশের সময় থেকে হিসাব করলে বলা যায় দশজন সম্রাট সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং ছিং রাজত্বকাল ছিল ২৬৮ বছর ।
বৃহততম ছিং সাম্রাজ্যের আয়তন
ছিল এক কোটি বিশ লক্ষ বর্গকিলোমিটার।১৬১৬
সালে নুরহাচি হৌজিন রাজবংশ
স্থাপন করেন ।১৬৩৬ সালে হুয়াং
থাই জি রাজবংশের নতুন নাম ছিং
ঘোষনা করেন ।১৬৪৪ সালে লি জি
জেংয়ের নেতৃত্বে কৃষক বাহিনী
মিং রাজবংশের শাসন উত্খাত করে
।সম্রাট ছুনজেন চরম হতাশায়
আত্মহত্যা করেন ।ছিং রাজবংশের
বাহিনী সেই সুযোগে মহাপ্রাচীরের
শানহাইকুয়ান সিংদ্বার পার হয়ে
চীনের মুলভুভাগে প্রবেশ করে
কৃষক বাহিনীকে পরাজিত করে ।পেইচিং
হল ছিং রাজবংশের রাজধানী ।ছিং
রাজদরবার পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন
স্থানের কৃষক বিদ্রোহ ও দক্ষিণ
চীনে মিং রাজবংশের ছিং রাজবংশ
বিরোধী বাহিনীকে নির্মুল করে
ধাপে ধাপে চীনকে একীভূত করে
।
ছিং রাজত্বকালের প্রারম্ভে
শ্রেণীদ্বন্দ্ব প্রশমনের জন্য
পতিত জমিতে চাষাবাদকে উত্সাহ
দেয়া আর রাজকর কমানো বা মওকুফ
করার নীতি কার্যকরী করা হয়
। ফলে মূল ভুভাগ ও সীমান্ত
অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নতি
সাধিত হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর
মধ্যভাগে সামন্ততান্ত্রিক অথনীতির
উন্নয়ন শীর্ষ শিখরে আরোহন করে
,চীনের ইতিহাসে এটা খাংসি-ইয়ংজেন-ছিয়ানলং
সমৃদ্ধিশালি যুগ বলে পরিচিত
।তখন কেন্দ্রীয় একনায়কত্ব বেশ
মজবুত ,সমাজ স্থিতিশীল এবং
রাষ্ট্র শক্তিশালী । অষ্টাদশ
শতাব্দীর শেষভাগে চীনের লোকসংখ্যা
প্রায় ৩০কোটিতে পৌঁছে ।
১৬৬১সালে জেন ছেং গংয়ের নেতৃত্বে
চীনের নৌ-বাহিনী তাইওয়ান প্রণালী
অতিক্রম করে ৩৮ বছর ধরে তাইওয়ান
দখলে রাখা ডাচ-উপনিবেশবাদীদের
পরাজিত করে ।পরের বছরের প্রথম
দিকে ডাচ-উপনিবেশবাদীরা আত্মসমর্পন
করে এবং তাইওয়ান চীনের কোলে
ফিরে আসে ।
ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে রাশিয়া
পুর্বদিকে সম্প্রসারনের উদ্যোগ
নেয়।ছিং রাজবংশের বাহিনী যখন
মহাপ্রাচীরের শানহাইকুয়ান সিংহদ্বার
দিয়ে চীনের মুলভুভাগে প্রবেশ
করে তখন রাশিয়া সেই সুযোগে
জোরপুর্বক ইয়াকেসা、নিপুছু ইত্যাদি
স্থান দখল করে । ছিং রাজকীয়
সরকার অনেকবার রাশিয়া সরকারের
কাছে চীনের ভুখন্ড থেকে তার
সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহারের দাবী
জানায় ।১৬৮৫ সাল ও ১৬৮৬ সালে
সম্রাট খাং সি দুবার ইয়াকেসায়
মোতায়েন রুশ বাহিনীর উপরে আক্রমন
চালাতে ছিং রাজকীয় বাহিনীকে
আদেশ দেন ।রুশ বাহিনী বাধ্য
হয়ে আলোচনার মাধ্যমে দুদেশের
পুর্বদিকের সীমান্ত সমস্যার
সমাধান করতে রাজী হয়। ১৬৮৯
সালে দুপক্ষের প্রতিনিধিরা
নিপুছু বৈঠকে বসে আনুষ্ঠানিকভাবে
প্রথম সীমান্ত চুক্তি--নিপুছু
চুক্তি স্বাক্ষর করেন ।
সম্রাট ছিয়ানলংয়ের শাসনকালের
মধ্যভাগে জুন কের উপজাতির বিচ্ছিন্নতাবাদী
শক্তি ও হুই জাতির বৃহত আর
ক্ষুদ্র হোজুর বিচ্ছিন্নতাবাদী
শক্তির অভ্যুত্থান দমন করে
সিংজিয়াংকে একীভুত করা হয় এবং
সীমান্ত অঞ্চলের অর্থনীতি ,সংস্কৃতি
ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি
সাধনের অনেকগুলো নীতি প্রনয়ণ
করা হয় ।
সম্রাট তাওকুয়াং সিহাসনে আরোহনের
পুর্বে ছিং রাজত্বকালের সাংস্কৃতিক
ক্ষেত্রে বিরাট সাফল্য অর্জিত
হয় । ওয়াংফুচি 、হুয়াংজংই、 গুইয়ানউ
ও ডাই জেনের মত অনেক চিন্তাবিদ
এবং ছাও সিয়ে জিন、 উজিংচি 、খংসাংরেন
ও সি তাও প্রমুখ বিখ্যাত সাহিত্যিক
আর শিল্পীর জন্ম হয় সেই সময়পর্বে
। ইতিহাসের গবেষনায় লক্ষনীয়
অগ্রগিত সাধিত হয় ।প্রাচীন
মুল গ্রন্থের গবেষনার ক্ষেত্রেও
একের পর এক খ্যাতনামা পন্ডিত
আবির্ভুত হন । সরকারের আর্থিক
সাহায্যে “সিখুছুয়ান শু ” ,
“ঐতিহাসিক গ্রন্থ সমগ্র” প্রভৃতি
ধারাবাহিক গ্রন্থ প্রকাশিত
হয় । বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির
ক্ষেত্রেও প্রচুর সাফল্য অর্জিত
হয় । স্থাপত্য শিল্পের কীর্তি
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ।
ছিং রাজবংশীয় আমলে চীন একটি কৃষি প্রধান দেশ ; সাংস্কৃতিক আর ভাবাদর্শের ক্ষেত্রে সামন্ততান্ত্রিক রীতিনীতি ও আচার ব্যবহার মেনে চলতে উত্সাহ দেয়া হয়।কেউ প্রবন্ধ লিখে ভিন্ন মত প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। বহির্বিশ্বের দিকে চীনের দ্বার বন্ধ ছিল , রাজদরবার ছিল আত্ম অহংকারে নিমগ্ন।
ছিং রাজত্বকালের মধ্যভাগের
পর সমাজের নানা রকমের দ্বন্দ্ব
ক্রমশই আত্ম প্রকাশ করে । ছিং
রাজপরিবার বিরোধী সংগ্রাম প্রায়
সংঘটিত হয় । “শ্বেত কমলা বিদ্রোহের
আঘাতে ছিং রাজত্বকালের ঐশ্বর্যময়
যুগের অবসান ঘটে ।
১৮৪০ সালে আফিম যুদ্ধ বাঁধে , পরবর্তীকালে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি চীনে অনুপ্রবেশ করে ।ছিং রাজদরবার ও বিদেশী হানাদারদের মধ্যে একটির পর একটি অসম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় । তথাকথিত যুদ্ধের ক্ষতিপুরণ করতে ছিং রাজকীয় সরকারকে মোটা অংকের অর্থ দিতে হয়েছে এবং কোনো কোনো স্থানের কর্তৃত্ব ছেড়ে দিতে হয়েছে ।ছিং রাজকীয় সরকার অনেক বন্দর উন্মুক্ত করতেও বাধ্য হয় । চীন ধাপে ধাপে আধা সামন্ততান্ত্রিক আধা ঔপনিবেশিক দেশে পরিণত হয় । ছিং রাজত্বকালের শেষভাগে রাজনৈতিক ব্যবস্থা কলুষিত হয়ে উঠে । রাজপরিবারের চিন্তাভাবনা জড়তাক্লিষ্ট, আত্মমর্যাদাবোধহীন দুর্বল ছিং রাজবংশ হাঁপাতে হাঁপাতে পতনোন্মুখ হতে থাকে ।জনসাধারন দুর্বিসহ দুংদুর্দশায় অতিষ্ঠ হয়ে একটির পর একটি সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ বিরোধী আন্দোলন চালান ,যেমন থাইপিংথিয়ানগুও আন্দোলন ও নিয়ান বাহিনীর বিদ্রোহ । সর্বনাশের হাত থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য শাসক শ্রেণীর ভেতরে কতকগুলো সংস্কারও সাধিত হয় ,যেমন ,বিদেশের আধুনিক অস্ত্র কেনার পদক্ষেপ নেয়া হয় এবং চান্দ্রিক উসি বত্সরে আইন সংস্কারের প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় ।রাজদরবার থেকে সমাজের নীচু স্তর পর্যন্ত সংস্কার চালানোর উদ্দেশ্য ছিল চীনকে সমৃদ্ধি ও স্বাধীনতার পথে নিয়ে যাওয়া । কিন্ত সংস্কার সবই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।অসংখ্যদেশপ্রেমিক দুর্যোগের কবল থেকে চীনা জাতিকে রক্ষা করার জন্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন । চীনের আধুনিক ইতিহাসে দেমপ্রেমের অভুতপুর্ব উত্তাল জোয়ার প্রবাহিত হতে থাকে ।১৯১১সালে সিন আই বিপ্লব ঘটে ,ছিং রাজবংশকে উচ্ছেদ করা হয় , দু সহস্রাধিকবত্সর স্থায়ী সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান ঘটায় চীনের ইতিহাস একটি নতুন যুগে প্রবেশ করে ।
|