হান রাজবংশ
 

       খ্রীষ্টপূর্ব ২০৬ অব্দ থেকে খ্রীষ্টীয় ৮ অব্দ পর্যন্ত চীনের ইতিহাসে পশ্চিম হান রাজবংশ স্থায়ী ছিল । লিউ বাং হান রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা । জাং আন ছিল রাজধানী ।  

  সাত বছর ক্ষমতায় থাকাকালে সম্রাট লিউ বাং কেন্দ্রীয় একনায়কত্ব জোরদার করে প্রজাদের মঙ্গল সাধনের অনেকগুলো রাজনৈতিক নীতি প্রনয়ণ করেন । ফলে তাঁর শাসন ব্যবস্থা বেজায় সুসংবদ্ধ হয় । খ্রীষ্টপূর্ব ১৫৯ অব্দে সম্রাট লিউ বাংয়ের মৃত্যুর পর সম্রাট হুই সিংহাসনে আরোহণ করেন । কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রকৃতপক্ষে সম্রাট লিউ বাংয়ের পত্নী -- সম্রাজ্ঞী লু জির হাতে ছিল ।সম্রাজ্ঞী লু জি মোট ১৬ বছর ক্ষমতায় ছিলেন ,তিনি চীনের ইতিহাসে অল্প সংখ্যক নারী শাসকের অন্যতম ছিলেন । খ্রীষ্টপূর্ব ১৮৩ অব্দে সম্রাট ওয়েন সিংহাসনে আরোহন করেন । তিনি ও তাঁর পুত্র সম্রাট চিং(খ্রীষ্টপূর্ব ১৫৬ অব্দ থেকে খ্রীষ্টপূর্ব১৪৩ অব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন ) অব্যাহতভাবে প্রজাদের মঙ্গল সাধনের নীতি কার্যকরী করে প্রজাদের রাজকর হ্রাস করেন । ফলে হান সাম্রাজ্যের অর্থনীতি প্রাণবন্তভাবে বিকশিত হয় । 

  সম্রাট ওয়েন ও সম্রাট চিংয়ের রাজত্বকালে হান রাজবংশের প্রতিপত্তি ক্রমশই বেড়ে যায় । খ্রীষ্টপূর্ব১৪১অব্দে সম্রাট উ সিংহাসনে আরোহণ করেন ।তাঁর শাসনামলে তাঁর প্রেরিত জেনারেল ওয়ে ছিং ও হো ছু পিং যে উপজাতি হিউংনু পরাজিত করেন তাতে পশ্চিম হান সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয় এবং উত্তর চীনের অর্থনৈতিক আর সাংস্কৃতি বিকাশ নিশ্চিত হয় । বার্দ্ধক্যে সম্রাট উ সামরিক অভিযান বন্ধ করে কৃষি উন্নয়নের বহু কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করেন ।ফলে পশ্চিম হান সাম্রাজ্যের অর্থনীতি অবিরাম বিকশিত হয় । পরবর্তীকালে সম্রাট জাও অব্যাহতভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন , ফলে পশ্চিম হান সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধি শিখরে উপনীত হয় । 

   সম্রাট জাও ও সম্রাট সুয়ান ৩৮ বছর ধরে প্রজাদের মঙ্গল সাধনের নীতি কার্যকরী করায় পশ্চিম হান রাজবংশের জাতীয় শক্তি যথেষ্ট বেড়ে যায় । কিন্তু সমসাময়িক স্থানীয় সম্প্রদায়ের শক্তিও বৃদ্ধি পায় এবং তা হান রাজবংশের শাসনের পক্ষে গুরুতর বিপদের আশঙকার সৃষ্টি করে । খ্রীষ্টীয় ৮ অব্দে ওয়াং মাং সিংহাসন কুক্ষিগত করে এবং চীনে পশ্চিম হান রাজবংশের শাসনের অবসান ঘটে ।  

  চীনের ইতিহাসে পশ্চিম হান সাম্রাজ্য চীনের অপেক্ষাকৃত শক্তিশালি সাম্রাজ্যগুলোর অন্যতম । পশ্চিম হান রাজত্বকালে জনহিতকর নীতি অনুসরণের সুবাদে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল ছিল , জনসাধারণ সুখী জীবন যাপন করতেন ,অন্নবস্ত্রের অভাব ছিল না । সম্রাট উ মন্ত্রী তংছংসু উত্থাপিত কনফুসিয়ানের মতবাদ ব্যতীত অন্য সব মতবাদ নিষেধ করার প্রস্তাব গ্রহণ করেন। এরপর কনফুসিয়াসের মতবাদ চীনের যাবতীয় রাজবংশের শাসনের মূল তত্ত্বে পরিণত হয় । 

   রাজনৈতিক ও অর্থনেতিক স্থিতিশীলতার দরুন হান রাজত্বকালে হস্তশিল্প 、বানিজ্য、 শিল্পকলা、এবং প্রকৃতি-বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয় । বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের সংগে সংগে ধাতু ঢালাই শিল্প ও বস্ত্র বয়ন শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা হস্তশিল্পের উত্পাদন-হার বিরাটভাবে বৃদ্ধি পায় । হস্তশিল্পের উন্নয়নে বানিজ্য দ্রুত সমৃদ্ধ হয়ে উঠে । রেশম পথ খোলায় পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোর সংগে চীনের কূটনৈতিক আর বানিজ্যিক আদান প্রদানের সুত্রপাত ঘটে । 

  খ্রীষ্টীয় ২৫ অব্দ থেকে খ্রীষ্টীয় ২২০ অব্দ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল । লিউ সিউ পূর্ব হান রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা । 

  ২৫ খ্রীষ্টাব্দে লিউ সিউ লুলিন বাহিনীর সহায়তায় সিংহাসন হরনকারী ওয়াং মাংকে পরাজিত করে সিংহাসন দখল করেন ।তাঁর রাজবংশের নাম হান রাখা হল ও লোইয়াংকে রাজধানী করা হয় । ক্ষমতাসীন হওয়ার দ্বিতীয় বছর সম্রাট লিউ সিউ ওয়াং মাংয়ের অনুসৃত পুরনো নীতি বাতিলের আদেশ দেন । তাঁর আদেশ অনুসারে ছয় জন মন্ত্রীর উপরে শাসনের ভার ন্যস্ত করা হয় ,পুরনো রাজকর্মচারীদের কুশাসনের সংস্কার করা হয় , ছয় জন মন্ত্রীর মধ্যে শাসনের ভার বন্টন করা হয় এবং সেনাপতি , হস্তশিল্প ও নির্মান প্রকল্প বিষয়ক প্রশাসক এবং জনকল্যান ও ভুমি বিষয়ক প্রশাসকের ক্ষমতা খর্ব করা হয় : সরকারী দাসত্ব- প্রথা রহিত করা হয় ;জমির উপরে জরীপ চালানো হয়। ফলে জনসাধারণের জীবনে ক্রমশই স্বাচ্ছন্দ্য আসে ।খ্রীষ্টীয় প্রথম শতাব্দীর মধ্যভাগে সম্রাট কুয়াং উ , সম্রাটমিং ও সম্রাট জাংয়ের পরিচালিত সংস্কারের সুবাদে পূর্ব হান রাজবংশীয় আমলে হানরাজবংশের লুপ্ত প্রতিপত্তি ধাপে ধাপে পুনরোদ্ধার করা হয় । 

  পূর্ব হান রাজবংশের প্রথম দিকে রাজশাসন পাকাপোক্ত হওয়া এবং কেন্দ্রীয় সরকার ও স্থানীয় সরকারের ঐক্য জোরদার হওয়ায় সারাদেশ স্থিতিশীল হতে থাকে ,অর্থনীতি , সংস্কৃতি,বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মান পশ্চিম হান রাজত্বকালের চেয়ে অধিক উন্নত হয় ।খ্রীষ্টীয় ১০৫ অব্দে ছাই লুন কাগজ তৈরীর প্রযুক্তির যে উন্নতি সাধন করেন তাতে চীনে বাঁশের পাতের উপরে শব্দ লেখার ইতিহাসের অবসান ঘটে ।চীনের চারটি আবিষ্কারের মধ্যে অন্যতম আবিস্কার হিসেবে কাগজ তৈরীর প্রযুক্তি আজ পর্যন্ত প্রচলিত । প্রকৃতি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেপ্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীদের প্রতিনিধি হিসেবে জাংহেং সর্বোচ্চ কীর্তি স্থাপন করেন ।তিনি জ্যোতিষ্কের স্থিতি নির্ণয়কারী যন্ত্র,ভূকম্পের স্থাননির্ণয়কারী যন্ত্র প্রভৃতি বৈজ্ঞানিক গবেষণার পরিমাপক যন্ত্র উদ্ভাবন করেন । এই ছাড়া পূর্ব হান রাজত্বকালেরশেষভাগে চীনের লিখিত ইতিহাসে বিখ্যাত চিকিত্সক হুয়া তুও প্রথম চেতনানাশক ঔষুধ ব্যবহার করে রোগীর অস্ত্রোপচার করেন ।