প্রায় দু হাজার বছরব্যাপী দাস প্রথার অবসানের পর চীনের ইতিহাসে প্রথম কেন্দ্রীয় একনায়কত্ব সম্পন্ন সামন্ততান্ত্রিক রাজবংশের জন্ম হয় খ্রীষ্টপূর্ব ২২১ অব্দে।চীনের ইতিহাসে ছিন রাজবংশের জন্মের তাত্পর্য অত্যন্ত গভীর ।
চীনের ইতিহাসে খ্রীষ্টপূর্ব ২৫৫ অব্দ থেকে খ্রীষ্টপূর্ব ২২২ অব্দ পর্যন্ত ছিল চীনের যুদ্ধমান যুগ এবং চীনের দাস ব্যবস্থার শেষ ভাগ । তদানীন্তন অনেকগুলো ছোটো রাজ্য পরস্পরের উপরে আক্রমণ চালাতো এবং পরস্পরকে গ্রাস করতো । অবশেষে রয়েছে সাতটি অপেক্ষাকৃত বড় রাজ্য ,অর্থাত ছিন রাজ্য、 ছি রাজ্য、ছু রাজ্য 、 ওয়েই রাজ্য 、ইউয়ান রাজ্য 、হান রাজ্য ও চাও রাজ্য ।উত্তর পশ্চিম চীনে অবস্থিত ছিন রাজ্য সর্বপ্রথমে কৃষির সংস্কার ও সামরিক সংস্কার চালানোর সুবাদে দ্রুত শক্তিশালি হয়ে উঠে ।খ্রীষ্টপূর্ব ২৪৭ অব্দে মাত্র ১৩ বছর বয়স্ক ইনজেন রাজা হন ।২২ বছর বয়সে তিনি প্রত্যক্ষভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করেন এবং অন্য ছয়টি রাজ্য অধিরকার করে চীনদেশের একীকরণের রণনীতি বাস্তবায়নে হাত দেন ।তিনি যতদূর সম্ভব সামর্থ্যবানদের জড় করেন ।যার প্রতিভা আছে তাকে নিয়োগ করতে তিনি কখনো দ্বিধাবোধ করেন নি । উদাহরণ স্বরূপ ,তিনি হান রাজ্যের গুপ্তচর জেনগুওয়ের উপরে জেনগুও খাল খননের গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত করেছিলেন । জেনগুও খাল খননের পর ছিন রাজ্যের ৪০ হাজার হেক্টর লোনা ভুমি উর্বর আবাদী জমিতে পরিণত হয়, খরা ও বন্যা হলেও ভাল ফলন পাওয়া যেত ।চীনকে একীভূত করার যুদ্ধে ছিন রাজ্যের বাহিনীর জন্য সেই খালের দুপাশের গ্রামাঞ্চল থেকে পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য সরবরাহ করা হত ।খ্রীষ্টপূর্ব ২৩০ অব্দ থেকে খ্রীষ্টপূর্ব ২২১ অব্দ পর্যন্ত দশ বছরের কম সময়ের মধ্যে রাজা ইনজেন পর পর ছি রাজ্য、ছু রাজ্য 、ওয়েই রাজ্য、 ইউয়ান রাজ্য、 হান রাজ্য ও চাও রাজ্যকে দখল করে চীনের একীকরণের লক্ষ্য হাসিল করেন । চীনের ইতিহাসে রাজ্যের ভাগাভাগি সমাপ্ত হয় , কেন্দ্রীয় একনায়কত্বাধীন ছিন রাজদরবারের অভ্যুদয় ঘটে এবং ইনজেন চীনের প্রথম সম্রাট হন ।তিনি চীনের আদিম সম্রাট বলেও পরিচিত ।
রাজা ইনজেন যে চীনকে একীভূত করেন ,তা চীনের ইতিহাসে বিরাট অবদান রেখেছে এবং তার তাত্পর্য সুদুর প্রসারী । প্রথমত্ব: রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সম্রাট ইনজেন ভুমির মালিকানা দান প্রথা রহিত করে সারাদেশকে ৩৬টি বিভাগে বিভক্ত করেন ।বিভাগের নীচে থাকে জেলা ।সম্রাট স্বয়ং কেন্দ্রীয় সরকার ও স্থানীয় সরকারের কর্মচারীদের নিয়োগ ও বরখাস্ত করেন ।শাসনকর্তার পদ বংশানুক্রমিক নয় ।ছিন রাজবংশীয় আমলে প্রবর্তিত শাসন ব্যবস্থার কাঠামো চীনের দু’ সহস্রাধিক বত্সরের সামন্ততান্ত্রিক যুগে টিকে ছিল ।বর্তমান চীনের অনেক জেলার নাম ছিন রাজবংশীয় আমলেই স্থির করা হয়েছিল ।
দ্বিতীয়ত্ব: ছিন রাজবংশীয় আমলে চীন একীভূত হওয়ার ফলে এক ভাষা চালু করা সম্ভব হয়েছে ।ছিন রাজত্বকালের আগে প্রতিটি রাজ্যের নিজস্ব ভাষা ছিল।এই সব ভাষার উত্স একই হলেও এবং শব্দের বানানের যত্সামান্য পার্থক্য থাকলেও সংস্কৃতির বিস্তার আর আদানপ্রদানে তা বাধার সৃষ্টি করেছিল । চীনের একীকরণের পর ছিন রাজ্যের সিয়াও জুয়ান থি নামক হান জাতির লিখিত ভাষাকে সারা দেশের প্রচলিত লিখিত ভাষা বলে ধার্য করা হয় । অত:পর চীনের হান জাতির লিখিত ভাষার পরিবর্তন যে নিয়মমাফিক হয়, চীনের ইতিহাসের গঠন ও সংস্কৃতির বিবর্তনের পক্ষে তার তাত্পর্য অপরিমেয় ।
সম্রাট ইনজেন সারা চীন দেশে দৈর্ঘ্য、ওজন ও ঘনফলের একই মানদন্ড চালু করেন ।চীনের একীকরণের আগে লিখিত ভাষার মত ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যে দৈর্ঘ্য 、ওজন ও ঘনফলের ভিন্ন ভিন্ন মানদন্ড চালু ছিল এবং তা অর্থনীতির বিকাশে সাংঘাতিক বাধার সৃষ্টি করেছিল । সেই সংগে সম্রাট ইনজেন একই মুদ্রা ও আইনবিধি চালু করার আদেশ জারি করে গোটি দেশের অর্থনীতির উন্নয়নপথ সুগম করেন । ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থান যথেষ্ট মজবুত হয় ।
তৃতীয়ত: ভাবাদর্শের ক্ষেত্রে একচ্ছত্র শাসন সুদৃঢ় করার জন্য খৃষ্টীয় ২১৩ অব্দে সম্রাট ইনজেন ইতিহাস রচয়িতা রাজকর্মচারীদের সংরক্ষিত ছিন রাজ্যের ইতিহাস- গ্রন্থ ছাড়া অন্যান্য রাজ্যের ইতিহাসের পুস্তক এবং কনফুসিয়াসের ধ্রুপদি গ্রন্থ পুড়িয়ে দেয়ার আদেশ দেন ।যারা গোপনে এই সব বইপুস্তক সংরক্ষণ করে বা প্রকাশ করে ,তাদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করার আদেশও জারি করা হয় ।উত্তর চীনের সংখ্যালঘু জাতির নৃপতিদের আক্রমণ ঠেকানোর জন্য সম্রাট ইনজেন অতীতে ছিন রাজ্য、চাও রাজ্য ও ইউয়ান রাজ্যের নির্মিত মহাপ্রাচীর মেরামত করে পশ্চিমাঞ্চলের মরুভূমি থেকে পূর্ব উপকুল পর্যন্ত পাঁচ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ মহাপ্রাচীর গড়ে তোলার নির্দেশ দেন ।তিনি প্রায় সাত লক্ষ শ্রমজীবী নিয়োগ করে মোটা অঙকের অর্থে যে লিসান সমাধি মন্দির নির্মান করান তা বিশ্ব - উত্তরাধিকার তালিকাভুক্ত হয়েছে ।
সম্রাট ইনজেন চীনকে একীভূত করায় চীনের দীর্ঘকালীন বিচ্ছিন্নতা আর ভাগবাটোয়ারার অবসান ঘটে এবং হান জাতিকে প্রধান অঙগ করে বহু জাতি বিশিষ্ট একটি শক্তিশালি বিশাল সামন্ততান্ত্রিক সাম্রাজ্য গড়ে উঠে এবং চীনের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সংযোজিত হয় ।
|