পশ্চিমচৌ রাজবংশ ও বসন্ত-শরত আর যুদ্ধমান যুগ
 

       সিয়া রাজবংশ ও সাং রাজবংশের পর চৌ রাজবংশ ছিল চীনের প্রাচীনকালের তৃতীয় রাজবংশ । আনুমানিক খ্রীষ্টপুর্ব১০২৭ অব্দে চৌ রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয় ।চৌ রাজবংশ ৭৭০বছর স্থায়ী ছিল । খ্রীষ্টপুর্ব ২৫৬ অব্দে ছিন রাজবংশ চৌ রাজবংশকে নিশ্চিহৃ করে ।চৌ রাজবংশ পশ্চিম চৌ রাজবংশ ও পুর্ব চৌ রাজবংশে বিভক্ত ।দেশের পুর্বাঞ্চলে চৌ রাজবংশের রাজধানীর স্থানান্তর ছিল দুই রাজত্বকালের সীমারেখা ।পুর্ব চৌ রাজবংশ বসন্ত-শরত্ যুগ আর যুদ্ধমান যুগে বিভক্ত । 

পশ্চিম চৌ রাজবংশের জন্ম হয় আনুমানিক খ্রীষ্টপুর্ব ১০২৭ অব্দে এবং খ্রীষ্টপুর্ব ৭৭১ অব্দে তার বিলুপ্তি ঘটে । পশ্চিম চৌ রাজবংশ স্থায়ী ছিল প্রায় ২৫৭ বছর।চৌ রাজবংশের প্রথম রাজা চৌউ রাজধানী গাওয়ে (বর্তমান শানসি প্রদেশের ছাং আন শহরের উত্তর পশ্চিম দিকে ) স্থানান্তরিত করার পর যুক্ত বাহিনী নিয়ে সাং রাজবংশ আক্রমণ করেন এবং চৌ রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত করেন।রাজকুমার চৌছেং শৈশবে সিংহাসনে আরোহন করেন ।বয়স কম বলে রাজশাসনের ক্ষমতা তাঁর ছিল না ।তাঁর চাচা চৌগংতান তাঁর পক্ষ থেকে রাজসভা পরিচালনা করেন।দেশের পরিস্থিতি স্থিতিশীল হওয়ার পর চৌগংতান সৈন্যবাহিনী নিয়ে পুর্বাঞ্চলের রাজদ্রোহ দমন করেন ।অত:পর তাঁর পরিচালনায় সামরিক অভিযানে অর্জিত সাফল্য পাকাপোক্ত করার অনেকগুলো গুরুত্বপুর্ণ পদক্ষেপ নেয়া হয়। রাজা চৌছেং ও চৌখাং যত বছর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন ,ইতিহাসে সেই সময়পর্বকে সুশৃংখলার যুগ বলে আখ্যায়িত করা হয় । 

চৌ রাজত্বকালেরশাসনব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল। রাজার আদেশে রাজ্যের জমি নয় ভাগে ভাগ করা হত।আট ভাগ জমি প্রজাদের মধ্যে বন্টন করা হত ।বাকী এক ভাগ জমিও প্রজাদের চাষ করতে দেয়া হত তবে উত্পন্ন্ শস্য রাজভান্ডারে জমা দিতে হত ।রাজপরিবার ও রাজকর্মচারীদের অধিকার ও সম্পত্তি উত্তরাধিকারসুত্রে গ্রহন করা হত ।রাজ্যের কোনো অনুষ্ঠানে কি সংগীত বাজাতে হয় তা কড়াকড়িভাবে নির্ধারন করা হয়েছিল । 

চীনের বসন্ত- শরত্ যুগ খ্রীষ্টপুর্ব ৭৭০ অব্দ থেকে খ্রীষ্টপুর্ব ৪৭৬ অব্দ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল । অর্থনৈতিক বিকাশ ও লোকসংখ্যা বৃদ্ধির সংগে সংগে বড় বড় রাজ্যের মধ্যে আধিপত্য নিয়ে প্রচন্ড সংগ্রামের সুত্রপাত হয় ।সেই যুগে সামাজিক অবস্থারও বিরাট পরিবর্তন ঘটে ।কৃষি ক্ষেত্রে প্রথম লোহার কৃষি- যন্ত্র তৈরী করা হয়, গরু দিয়ে জমি কর্ষন ক্রমশই প্রচলিত হয় ,জলসেচের ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় ,ফলে কৃষি উত্পাদনের পরিমান বৃদ্ধি পায় । 

চীনের জানা ইতিহাসের প্রথম মহান চিন্তাবিদ ও শিক্ষাবিদ কনফুশিয়াসের জন্ম হয় ব্সন্ত- শরত্ যুগের শেষভাগে ।অতীতের সংস্কৃতি ও ধ্যানধারনার সারসংকলন করার ভিত্তিতে ব্সন্ত- শরত্ যুগের শেষভাগের অস্থির সামাজিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে তিনি নৈতিক সমস্যা , সামাজিক সমস্যা ও রাজনৈতিক সমস্যা সম্পর্কে তত্ত্বের দিক থেকে তার সম্যক দৃষ্টিভংগী প্রকাশ করেন এবং প্রাচীন কনফুশিয়ান মতবাদ প্রবর্তন করেন । 

পুর্ব চৌ রাজবংশের পর যুদ্ধমান যুগ (খ্রীষ্টপুর্ব ৪০৩ অব্দ থেকে খ্রীষ্টপুর্ব ২২১ অব্দ পর্যন্ত) ছিল রাজাদের আধিপত্য ও ভুমি নিয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চালানোর যুগ । বসন্ত-শরত্ যুগের মত যুদ্ধমান যুগের পরিস্কার সীমা ছিল না ।আজকাল অভ্যাসবশত:খ্রীষ্টপুর্ব ৪০৩ অব্দে চাও রাজ্য 、হান রাজ্য ও ওয়েই রাজ্যের প্রতিষ্ঠাকে যুদ্ধমান যুগের সুচনা বলে গন্য করা হয় । খ্রীষ্টপুর্ব২২১ অব্দে ছিন রাজবংশ ছটি রাজ্য ধ্বংস করে। সেই বছরই যুদ্ধমান যুগের সমাপ্তি বলে ধরে নেয়া হয় । 

যুদ্ধমান যুগে চীনে বিরাট পরিবর্তন ঘটে । ছোটো ও মাঝারি রাজ্যগুলো একে একে বিলুপ্ত হয় ।বাকি সাতটি রাজ্য অর্থাত ছি রাজ্য、ছু রাজ্য 、 ওয়েই রাজ্য、 ইউয়ান রাজ্য 、হান রাজ্য ও চাও রাজ্য ছিল যুদ্ধমানযুগের প্রধান রাজ্য। প্রতিটি রাজ্যে অল্পবিস্তর সংস্কার চালানো হয় । তবে ছিন রাজ্যের সংস্কার সর্বাপেক্ষা গভীর ও প্রভাবশালী । 

যুদ্ধমান যুগে বছরের পর বছর যুদ্ধ সংঘটিত হয় । কিনতু
তা চীনের প্রাচীন সংস্কৃতির বিকাশে এতটুকু বাধা সৃস্টি করতে পারে নি । সমাজে তখন নতুন বুদ্ধিজীবী মহল আবির্ভুত হয় ।তাঁদের আয়ত্ত করা নানা প্রকারের বিদ্যা তাঁদের পরিচয়ের প্রধান নিদর্শন । বুদ্ধিজীবীদের বিদ্যাচর্চা কৃষ্টির সমৃদ্ধি তরান্বিত করে।চীনের প্রাচীন চিন্তাধারা ও সংস্কৃতি ইতিহাসের প্রথমশিখরে আরোহণ করে।কনফুশিয়াস ও মেনশিয়াসকে প্রতিনিধি করে গড়ে ওঠা কনফুশিয়ান সম্প্রদায় , লাউশিয়াস , জুয়াংশিয়াস, ও লিয়েশিয়াসকে প্রতিনিধি করে গড়ে ওঠা দাও সম্প্রদায়,হানফেইকে প্রতিনিধি করে গড়ে ওঠা আইন সম্প্রদায় , মুশিয়াসকে প্রতিনিধি করে গড়ে ওঠা মু সম্প্রদায় উত্তরসুরীদের বিশেষ শ্রদ্ধা পেয়েছে ।এই সব সম্প্রদায়ের আবির্ভাবে যুদ্ধমান যুগের চিন্তাবিদ মহলে “শত ফুল ফোটা আর শত মতবাদের প্রতিযোগিতা চালানোর ” উত্সাহব্যঞ্জক দৃশ্য দেখা দেয় ।তাঁদের তত্ত্ব শুধু যে তদানীন্তন রাজনীতি ও অর্থনীতির বিকাশে প্রেরনা যুগিয়েছে তা নয় , তার গভীর প্রভাবের জের আজো রয়েছে । এটা চীনের চিন্তাধারার ইতিহাসের একটি অক্ষয় অধ্যায় ।
 

খ্রীষ্টপুর্ব ২৩০ অব্দে ছিন রাজ্যের রাজা ইনজেন চীনদেশের একীকরণ বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা শুরু করেন ।নয় বছরের মধ্যে তিনি অন্য ছয়টি রাজ্য অধিরকার করে চীনদেশের একীকরণ বাস্তবায়নের লক্ষ্য অর্জন করেন । ফলে চীনের ছয় শো বছর স্থায়ী বিভক্তির অবসান ঘটে ।