তিব্বতী চিকিত্সাবিদ্যা


      তিব্বতী চিকিত্সাবিদ্যার সংক্ষিপ্ত কথা

       চীনা চিকিত্সাবিদ্যার অংশ হিসেবে, তিব্বতী চিকিত্সা ব্যবস্থা ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে। তিব্বতী জাতির লোকদের বসবাস আছে এমন সব জায়গায় যেমন তিব্বত, ছিং হাই, সিছুয়ান আর কানসু প্রদেশগুলোতে মূলতঃ তিব্বতী চিকিত্সা ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। দক্ষিণ এশিয়ার ভারত আর নেপালেও তিব্বতী চিকিত্সা একটি অন্যতম চিকিত্সা ব্যবস্থা।  

       দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের ছিংহাই-তিব্বত মালভূমিতে তিব্বতী চিকিত্সাবিদ্যার জন্ম হয়। ওই অঞ্চলেই তা প্রতিষ্ঠিত। ছিংহাই-তিব্বত মালভূমি একটি হিম-শীতল অঞ্চলে অবস্থিত। যোগাযোগ ব্যবস্থার পশ্চাত্পদতার কারণে বহিঃবিশ্বের সঙ্গে তার সংশ্রব দুষ্কর বলে তিব্বতী চিকিত্সাবিদ্যা বাইরে তেমন বিস্তৃত হয় নি। 

       এই অঞ্চলে ভেষজ উদ্ভিদ ও বন্য প্রাণীর প্রকার বৈচিত্র্য সীমিত বলে তিব্বতী চিকিত্সা ব্যবস্থায় ব্যবহৃত উপকরণের উত্স প্রধানতঃ শীত-সহিষ্ণু উদ্ভিদ ও প্রাণী। অক্সিজেনের অভাব আছে এমন সুউচ্চ মালভূমিতে এসব উদ্ভিদ ও প্রাণী থাকে।

তিব্বতী চিকিত্সাবিদ্যার মূল তত্ত্ব

       দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট তিব্বতী ওষুধের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে।

  সান ইন তত্ত্ব 

      তিব্বতী তত্ত্ব অনুসারে, মানবদেহে তিনটি উপাদান আছে, যেগুলোকে বলা হয় লোং, ছিবা এবং পেই গেন। মানবদেহে সাত ধরণের জিনিষ আছেঃ খাদ্যের নির্যাস, রক্ত, মাংস, চর্বি, হাড় ইত্যাদি। আরও আছে তিন ধরণের দেহ-নিঃসৃত পদার্থঃ প্রস্রাব, মল আর ঘাম। শরীরের উপরোক্ত তিনটি উপাদানের উপর নির্ভর করে সাতটি জিনিষ ও তিনটি দেহ-নিঃসৃত পদার্থের পরিবর্তন। সাধারণতঃ এগুলো সমন্বিত সহাবস্থানে থাকে। যদি এক বা একাধিক উপাদানের অতিপ্রতিক্রিয়া বা তিরোধান ঘটে, তবে শরীরে ‘লোং’, ‘ছিবা’ আর ‘পেইগেন’ রোগাক্রান্ত হয়। কাজেই রোগীকে এই তিনটি বিষয়ের ভিত্তিতে চিকিত্সা করতে হয়।

      ‘লোং’ ধারণাটি চলত্শক্তিকে নির্দেশ করে। এটি হান চিকিত্সাবিদ্যার ‘ফং’ আর ‘ছি’র সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ , তবে চেয়েও এর ধারণা আরও উদার। ‘ছিবা’র অনুবাদ করা হয়েছে ‘তান’ বা ‘হুও’ হিসেবে, যা হান চিকিত্সাবিদ্যায় উত্তপ্ততার মতো। ‘ছিবার’ প্রধান কাজ হল শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা বজায় রাখা, পাকস্থলীকে কর্মক্ষম রাখা ইত্যাদি। ‘পেইগেন’ থুথুর মতো কিছুটা, তবে তার চেয়েও ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। শরীরের ভেতরে তরলীকরণের সঙ্গে এর সম্পর্ক আছে।  

     তিব্বতী তত্ত্বে, রোগের কারণ হচ্ছে ‘লোং’, ‘দিবা’আর ‘পেইগেনের’ সমন্বয়হীনতা। এতে শরীর অসুস্থ হয়। কাজেই এই চিকিত্সা পদ্ধতির উদ্দেশ্য এই তিনটি উপাদানকে সমন্বিত অবস্থায় ফিরিয়ে আনা।

  হিউম্যান এ্যানথ্রপোটমী ও শারীর বিজ্ঞান 

      তিব্বতীরা হিউম্যান এ্যানথ্রপোটমী এবং শারীর বিজ্ঞান সম্বন্ধে খুব ভাল জানেন। তিব্বতী চিকিত্সাবিদ্যায় মনে করা হয়, মানবদেহের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো হচ্ছেঃ হৃত্পিণ্ড, যকৃত্, প্লীহা, ফুসফুস আর বৃক্ক এবং পাকস্থলী, পিওথলি, তিনটি আন্ত্র-গহ্বর , ক্ষুদ্র ও বৃহদন্ত্র আর মূত্রথলি। প্রাচীন যুগে তিব্বতী ডাক্তাররা সামন্ত সম্রাটদের সম্পর্ককে অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যাবলী বর্ণনার ক্ষেত্রে রূপক হিসেবে ব্যবহার করতেন। উদাহরণস্বরূপ, হৃত্পিণ্ড হচ্ছে মাঝখানে উপবিষ্ট একজন রাজার মতো, ফুসফুস হচ্ছে মন্ত্রী, যকৃত্ আর প্লীহা হচ্ছে রাজার উপ-পত্নী এবং বৃক্ক হচ্ছে মেরুদত্তের মতো ইত্যাদি ইত্যাদি।

      এতে বোঝা যায়, প্রাচীণকালে তিব্বতী ডাক্তারদের মানবদেহ সম্পর্কে সম্যক ধারণা ছিলো।  

তিব্বতী চিকিত্সাবিদ্যার বিশেষ চিকিত্সা পদ্ধতি

  ওষুধ মেশানো গোসল

     তিব্বতী চিকিত্সা ব্যবস্থার ওষুধ-মিশ্রিত স্নান বা গোসলের চমত্কার বৈশিষ্ট্য আছে। এ ধরণের চিকিত্সায় নানা ধরণের স্প্রিং ব্যবহৃত হয়, যেমন সালফার স্প্রিং, এলুমিনাথীট স্প্রিং, লাইমস্টোনসহ বিভিন্ন পদার্থের তৈরী স্প্রিং ইত্যাদি।  

     দু’ধরণের ওষুধ মেশানো গোসল আছে। জলীয় গোসল আর ওষুধ-প্যাক গোসল। জলীয় গোসলে উপরোক্ত স্প্রিংগুলো মাংসপেশী বা হাড়ের তথাকথিত “উত্তপ্ততার” চিকিত্সা করা যায়। আর ওষুধ-প্যাক গোসলে ওষুধের উপকরণগুলো মিশিয়ে সেদ্ধ করে একটি উপযুক্ত ব্যাগে ভরতে হবে, তারপর শরীরের রোগাক্রান্ত অংশে ব্যাগটি রাখতে হবে।

  বমনোদ্রেককারী ব্যবস্থা

এই ধরণের পদ্ধতিতে রোগীকে ওষুধ খাইয়ে বমি করানো হয়। অতিভোজন, বিষক্রিয়া বা এ ধরণের সমস্যায় এই পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। এর শক্তিশালী পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে বলে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, দুর্বল, গর্ভবতী আর শিশুদের জন্যে এই পদ্ধতি অনুপযুক্ত। যদি পেটে বিষক্রিয়া ঘটেছে অনেক আগে, তাহলে এই পদ্ধতি কার্যকর হবে না।