চীনা চিকিত্সাবিদ্যার ইতিহাস

      চীনের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে হান জাতির চিকিত্সাবিদ্যা সবচেয়ে পুরনো ও সমৃদ্ধ, ব্যবহারিক এবং তাত্ত্বিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে। 

  চীনের মাতৃনদী হোয়াংহো অববাহিকায় চীনা চিকিত্সাবিদ্যার সূত্রপাত, যা পরে একটি বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তার বিকাশের ধারায় অসংখ্য চিকিত্সাবিদ, তত্ত্ব আর অগ্রগতি দেখা দেয়।  

  তিন সহস্রাধিক বছর আগেকার শাং রাজামলের হাড়ের উপর খোদিত দৈববাণীতে চিকিত্সা , স্বাস্থ্যবিজ্ঞান আর অসুস্থতার তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে চৌ রাজামলে ডাক্তাররা রোগ নির্ণয়ে নতুন নতুন কৌশল রপ্ত করেন। এসব কৌশল আজকাল চারটি প্রধান চিকিত্সা পদ্ধতি নামে পরিচিত। এগুলো হচ্ছেঃ পর্যবেক্ষণ, হৃত্পরীক্ষা ও ঘ্রাণবিদ্যা, প্রশ্নোত্তর এবং নাড়ী অনুভব করা ও স্পর্শানুভূতি ডাক্তাররা ওষুধ লিখে দেয়া, আকুপাংচার আর অস্ত্রোপচার ইত্যাদি নানান পদ্ধতিতে রোগীর চিকিত্সা করতেন। ছিন ও হান রাজামলে (খ্রীষ্টপূর্ব ২২১---খ্রীষ্টীয় ২২০) হোয়াং সম্রাট , অথবা সম্রাট নেইচিং এর নতুন পুস্তক দি মেডিক্যাল ক্লাসিক’এ ধারাবাহিকভাবে চীনা চিকিত্সাবিদ্যার তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এ ধরণের বই এটাই প্রথম। তৃতীয় শতাব্দিতে চাং চোংচিংয়ের লেখা “জ্বর ও অন্যান্য রোগবালাই” নামক গ্রন্থে শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা সৃষ্ট রোগবালাই নির্ণয় ও চিকিত্সার উপায় নিয়ে বিশদ বর্ণনা রয়েছে। এই গ্রন্থের অবদান হচ্ছে , তা কয়েক শতাব্দি পর ক্লিনিকাল মেডিসিনের বিকাশে সহায়তা করে। হান রাজামলে অস্ত্রোপচারের মান তুলনামূলকভাবে উন্নত পর্যায়ে পৌঁছে। “তিন রাজ্যের উপাখ্যান” বা চীনা ভাষায় “সান কুও চি” গ্রন্থে হুয়া থুও নামে একজন ডাক্তরের উল্লেখ রয়েছে, যিনি অস্ত্রোপচারের জন্যে পুরোপুরি সংজ্ঞাহীন করার পদ্ধতি ব্যবহারে সক্ষম হন।  

  ২২০ থেকে ৯৬০ খ্রীষ্টাব্দ চীনে ওয়েই, চিন , দক্ষিণ ও উত্তর রাজ এবং সুই, থাং আর উতাই রাজবংশগুলো ক্ষমতাসীন ছিল। এই সব রাজামলে নাড়ী দেখে চিকিত্সা করার পদ্ধতিতে আরও অগ্রগতি হয়। চিন রাজামলে ওয়াং শু নামে একজন ডাক্তার তার পালস্ ক্লাসিক বা “মাই চিং” গ্রন্থে একটি নাড়ী পরীক্ষার ২৪টি উপায় উল্লেখ করেন। চীনের ভেতরে ও বাইরে গ্রন্থটি দারুণ প্রভাব ফেলে। এই সময় পর্বেই চীনা চিকিত্সাবিদ্যার শ্রেণী-বিভাজন হয় এবং প্রতিটি শ্রেণীর জন্যে নতুন গ্রন্থ লিখা হয়। যেমন, আকুপাংচারের ক্ষেত্রে আকুপাংচার ও মক্সি বাশ্চন অথবা আকুপাংচারের এক দুই গ্রন্থ, অমরত্বের বড়ি বানানোর উপায় নিয়ে পাও পু যে এবং চৌ হৌ ফাং , এবং ফার্মাসীর ক্ষেত্রে লেই’র ওষুধ বানানোর কলাকৌশল বা চীনা ভাষায় “লেই কুং পাও জিউ লুন” ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। লিউ চুয়ানজি’র ভুতুড়ে উপশম পদ্ধতি বা চীনা ভাষায় “লিউ চুয়ান জি কুই ঈ ফাং” গ্রন্থটি সে আমলের অস্ত্রোপচারের ওপর একটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ। 

  অতঃপর সোং রাজামলে (৯৬০---১২৭৯ খ্রীষ্টাব্দ) ওয়াং ওয়েই ই নামে এক ভদ্রলোক আকুপাংচার শেখানোর নতুন কলাকৌশল উদ্ভাবন করেন। তিনি মানচিত্র আর মানুষের ছবি দিয়ে নিজের কৌশলগুলো ব্যাখ্যা করেন। মিং রাজামলে (১৩৬৮---১৬৪৪ সাল) ডাক্তাররা টাইফয়েড জ্বর, মহামারী ও প্লেগ রোগের মধ্যে পার্থক্য নিরূপন করতে শুরু করেন। ছিং রাজামলে, একটি নতুন গ্রন্থে বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে আলোকপাত করা হয়।  

  মিং রাজামলে চীনে পশ্চিমা চিকিত্সাবিদ্যার প্রবেশ ঘটে। এরপর লোকেরা প্রাচ্য ও পশ্চিমা চিকিত্সা পদ্ধতির সমন্বয় সাধনে ব্রতী হয়। এই প্রয়াস অব্যাহত থাকে এবং আজকের চীনা চিকিত্সাবিদ্যা হচ্ছে তারই অগ্রগতির প্রতিফলন।