তাইওয়ান সমস্যার সূত্রপাত


   তাইওয়ান দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর আইনের দিক থেকে এবং বাস্তবেও চীনের কাছে ফেরত্ দেয়া হয়েছে । পরে আবার তাইওয়ান সমস্যা দেখা দিয়েছে, তার কারণ চীনের কুওমিনতাং পার্টির বাধানো গৃহযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত, কিন্তু আরও গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো বিদেশী শক্তির হস্তক্ষেপ।

তাইওয়ান সমস্যা এবং কুওমিনতাংয়ের বাধানো গৃহযুদ্ধ

  চীনের জাপানী হামলা প্রতিরোধ যুদ্ধকালে চীনের কুওমিনতাং পার্টি চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে হানাদার জাপানের আগ্রাসন বিরোধী জাতীয় যুক্তফ্রণ্ট গড়ে তুলে জাপানী সাম্রাজ্যবাদীদের আগ্রাসী আক্রমণ প্রতিরোধ করে । হানাদার জাপান-বিরোধী প্রতিরোধ যুদ্ধটি জয়যুক্ত হবার পর চিয়াং কাইশেকের নেতৃত্বাধীন কুওমিনতাং গোষ্ঠি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট হয়ে সারা দেশ জুড়ে গৃহযুদ্ধ বাধায় । চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে চীনা জনগণ তিন বছরের বেশি সময় মুক্তিযুদ্ধ চালান। তখনকার কুওমিনতাং গোষ্ঠির অনুসৃত গণবিরোধী নীতির দরুন সারা দেশের বিভিন্ন জাতির জনগণ এই গোষ্ঠি ঘৃণা করে, ফলে কুওমিনতাং পার্টির “ চীন প্রজাতন্ত্র” (বা রিপাবলিক অব চায়না) সরকার উত্খাত করা হয় । ১৯৪৯ সালের ১লা অক্টোবর চীন গণ প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তা চীনের একমাত্র বৈধ সরকার হয়ে দাঁড়ায় । কুওমিনতাং গোষ্ঠির কিছু সৈন্য বাহিনী এবং সরকারী কর্মকর্তা সরে গিয়ে তাইওয়ান আঁকড়ে ধরে বসে। তাঁরা তখনকার মার্কিন সরকারের সমর্থনে তাইওয়ান প্রণালীর দু’ তীরের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করেন।

তাইওয়ান সমস্যায় মার্কিন সরকারের দায়িত্ব

  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তত্কালীন বিশ্বে পরস্পর-বিরোধী দুটো শিবির বিদ্যমান--পূর্ব শিবির এবং পশ্চিমা শিবির। এই পরিস্থিতিতে মার্কিন সরকার তার তথাকথিত বিশ্ব রণনীতি এবং নিজদেশের স্বার্থ রক্ষার কথা বিবেচনা করে কুওমিনতাং গোষ্ঠির বাধানো গৃহযুদ্ধকে সমর্থন করার জন্য অর্থ, সমরসজ্জা এমন-কি লোকবল যুগিয়ে দেয় এবং চীনা কমিউনিষ্ট পার্টিকে ধ্বংস করার অপচেষ্টা করে । কিন্তু মার্কিন সরকার শেষ পর্যন্ত তার এই উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারে নি।

  চীন গণ প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবার পর মার্কিন সরকার নয়াচীনের বিরুদ্ধে কোণঠাসা করা এবং খর্ব করা বা নিবৃত্তিমূলক নীতি অবলম্বন করে । কোরিয়া যুদ্ধ দানা বেঁধে উঠার পর যুক্তরাষ্ট্র চীনের নিছক অভ্যন্তরীণ ব্যাপার--তাইওয়ান প্রণালীর দু’ তীরের মধ্যকার সম্পর্কের ব্যাপারে সশস্ত্র হস্তক্ষেপ করে । ১৯৫০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর তাইওয়ান প্রণালীতে আগ্রাসী মূর্তিতে অনুপ্রবেশ করে এবং মার্কিন ১৩ নম্বর বিমানবহর তাইওয়ানে মোতায়েন করা হয়। ১৯৫৪ সালের ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তথাকথিত “যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তি” স্বাক্ষর করে চীনের তাইওয়ান প্রদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের “রক্ষণাবেক্ষণের” অধীনে রাখে। মার্কিন সরকারের অব্যাহতভাবে চীনের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার ভুল নীতি অনুসরণের ফলে তাইওয়ান প্রণালী অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী উত্তেজনাময় বৈরী পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। তার পর থেকে তাইওয়ান সমস্যা চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এক গুরুতর বিবাদ হয়ে দাঁড়ায়।

  আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির বিকাশ ও পরিবর্তন এবং নয়াচীনের শক্তিশালী হবার সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র তার চীননীতির পুনর্বিন্যাস শুরু করে । দুদেশের সম্পর্কে ক্রমেই “বরফ গলে যাওয়ার” পরিস্থিতি দেখা দেয়। ১৯৭১ সালের অক্টোবর ২৬তম জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ২৭৫৮ নম্বর প্রস্তাব গৃহিত হয়, তাতে জাতিসংঘে চীন গণ প্রজাতন্ত্রের যাবতীয় বৈধ অধিকার পুনর্প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং তাইওয়ান প্রশাসনের “প্রতিনিধিকে” বহিষ্কার করা হয়। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মার্কিন প্রেসিডেণ্ট নিকসন চীন সফর করেন, সাংহাইয়ে চীন-মার্কিন যুক্ত ইস্তাহার প্রকাশিত হয়। ইস্তাহারটিতে জোর দিয়ে বলা হয় , “মার্কিন পক্ষ ঘোষণা করে : যুক্তরাষ্ট্র উপলব্ধি করেছে যে, তাইওয়ান প্রণালির দুই তীরের সকল চীনা লোক মনে করেন, শুধু একটাই চীন আছে, তাইওয়ান চীনের একটি অংশ। মার্কিন সরকার এই মতাধিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো আপত্তি করে না।”

  ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বর মার্কিন সরকার চীন সরকারের উপস্থাপিত কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার তিনটি মূলনীতি গ্রহণ করে, অর্থাত্: যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ান প্রশাসনের সঙ্গে তার “কূটনৈতিক সম্পর্ক” ছিন্ন করে, “যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তি” বাতিল করে এবং তাইওয়ান থেকে (মার্কিন) সৈন্য প্রত্যাহার করে। ১৯৭৯ সালের ১লা জানুয়ারি চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। চীন-মার্কিন কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত যুক্ত ইস্তাহারে ঘোষণা করা হয় : “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বীকার করে যে, চীন গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার হচ্ছে চীনের একমাত্র বৈধ সরকার। এই অবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ তাইওয়ানের জনগণের সঙ্গে সাংস্কৃতিক, বাণিজ্যিক ও অন্যান্য বেসরকারী সম্পর্ক বা যোগাযোগ বজায় রাখবেন”, “ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের মতাধিষ্ঠানকে স্বীকৃতি দেয় , অর্থাত্ শুধু একটি চীন আছে এবং তাইওয়ান চীনের ভূভাগ ”। 

  দু:খের কথা এই যে, চীন -মার্কিন কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মাত্র তিন মাস পরেই মার্কিন কংগ্রেসে তথাকথিত “ তাইওয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক আইন” গৃহীত হয়, এবং তা মার্কিন প্রেসিডেণ্টের স্বাক্ষরদানের মাধ্যমে বলবত্ হয় । এই “ তাইওয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক আইন”টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি অভ্যন্তরীণ আইন হিসেবে অনেক ক্ষেত্রে “ চীন-মার্কিন কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার যুক্ত ইস্তাহার” এবং আন্তর্জাতিক আইনের মূলনীতি লংঘন করেছে । মার্কিন সরকার এই “সম্পর্ক আইন” অনুযায়ী অব্যাহতভাবে তাইওয়ানের কাছে অস্ত্র বিক্রী করে , চীনের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে এবং চীনের মূলভূখণ্ডের সঙ্গে তাইওয়ানের পুনরেকত্রীকরণে বাধা দিতে থাকে ।

  দেবে এবং একটা সময়পর্বের পর অবশেষে এই সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান করবে। কিন্তু আসলে দীর্ঘকাল ধরে মার্কিন সরকার শুধু যে নিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত ইস্তাহারে লিপিবদ্ধ ধারাগুলো পালন করে নি তা নয়, উপরন্তু অনবরতই এই যুক্ত ইস্তাহার লংঘনের আচরণ করেছে। ১৯৯২ সালের সেপ্টেম্বরে মার্কিন সরকার এমন-কি তাইওয়ানের কাছে অতি উন্নত মানের ১৫০টি এফ-১৬ জঙ্গী বিমান বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে । মার্কিন সরকারের এই আচরণ চীন-মার্কিন সম্পর্কের উন্নয়ন ও তাইওয়ান সমস্যা সমাধানের পথে নতুন অন্তরায় ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে।

  উপরোক্ত তথ্য থেকে প্রতীয়মান হয়, তাইওয়ান সমস্যা যে এখনও সমাধান করা হয় নি, তার জন্য মার্কিন সরকার দায়ী ।