ইতিহাসের খুটিনাটি


তাইওয়ানের অনাবাদী জমির আবাদ

  তাইওয়ান চীনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ । ভৌগোলিক দিক থেকে দেখতে গেলে, অতিপ্রাচীনকালে তাইওয়ান চীনের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল । পরে পৃথিবীর কিছু স্থলভাগের উত্থানপতনের প্রক্রিয়ায় তাইওয়ান প্রণালী জায়গাটির আগেকার স্থলভাগের অংশ সাগরের পানিতে ডুবে গেছে বলে তাইওয়ান একটি সামুদ্রিক দ্বীপে পরিণত হয়েছে। তাইওয়ানের বিভিন্ন স্থানে পর্যায়ক্রমে আবিষ্কৃত পুরাকীতি নিদর্শন ,যেমন পাথরের জিনিসপত্র, কালো রংয়ের মাটির পাত্র, রঙিন মাটির পাত্র ইত্যাদিতে প্রমাণিত হয়েছে , প্রাগৈতিহাসিক যুগে তাইওয়ানের সংস্কৃতি চীনের মূলভূখণ্ডের সঙ্গে একসূত্রে গাঁথা ছিল।

  প্রাচীন ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী , ২৩০ সালে চীনের উ রাজ্যের রাজা সুন ছুয়েনের পাঠানো দশ হাজার সৈন্য বিশিষ্ট একটি নৌবাহিনী সেনাপতি ওয়েই ওয়েন এবং চু কোচির নেতৃত্বে তাইওয়ান দ্বীপে পৌঁছেছিল । এটাই চীনের মূল ভূখণ্ডের অধিবাসীদের উন্নত সংস্কৃতি ও প্রযুক্তি দিয়ে তাইওয়ানের উন্নয়ন সাধনের শুরু। ষষ্ঠ ও সপ্তম শতাব্দীতে চীনের সুই রাজবংশের আমলে সম্রাট সুই ইয়াংতি তিন তিন বার তাইওয়ানে পরিদর্শন , সফর আর স্থানীয় জনতার সঙ্গে দেখাসাক্ষাত্ করা এবং সহানুভূতি ও আশীর্বাদ জানানোর জন্য কর্মকর্তাদের পাঠিয়েছেন। তার পর থাং এবং সোং রাজবংশের ছ’ শো বছরে মূলভূখণ্ডের অধিবাসীরা , বিশেষ করে ফুচিয়েন প্রদেশের ছুয়েনচৌ, চাংচৌ এলাকার জনগণ নানা কারণে তাইওয়ান এবং তাইওয়ানের নিকটবর্তী ফেংহু দ্বীপপূঞ্জে স্থানান্তরিত হয়েছেন এবং অনাবাদী জমি আবাদ করেছেন। ১৩৩৫ সালে চীনের ইউয়ান রাজবংশের আমলে আনুষ্ঠানিকভাবে ফেংহু দ্বীপপূঞ্জ এবং তাইওয়ানকে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সীমানার অন্তর্ভুক্ত করেছে, তাইওয়ানে ইউয়ান রাজবংশের প্রশাসনিক সংস্থা “স্যুনচিয়েনসি”-এর সদরদফতর তাইওয়ানের আওতাধীন ফেংহু দ্বীপপূঞ্জে স্থাপিত ছিল, এই সদরদফতর থেকে ফেংহু দ্বীপপূঞ্জ আর তাইওয়ান দ্বীপের বেসামরিক প্রশাসন কার্যকরী করা হয়। এটাই তাইওয়ানে চীনের রাজনৈতিক ক্ষমতা সংস্থা প্রতিষ্ঠার শুরু । 

  মিং রাজবংশের আমলে চীনের মূলভুখণ্ডে ও তাইওয়ান দ্বীপের জনগণের মধ্যকার যোগাযোগ আরও বেড়েছে । মিং বংশের সম্রাটের পাঠানো বিরাট নৌবহর চেং হোর পরিচালনায় অনেকবার দক্ষিণপূর্ব এশিয়া এবং ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল সফর করেছে, এই সব নৌ-অভিযাত্রার পথে তারা তাইওয়ানে যাত্রা-বিরতি করেছিল এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য কারুশিল্পজাত দ্রব্য এবং কৃষিপণ্য নিয়ে গিয়েছিল । ১৬২৮ সালে ফুচিয়েন প্রদেশে ভীষণ খরা হয়েছিল বলে স্থানীয় জনগণের বেঁচে থাকাই মুশকিল ছিল। ফূচিয়েন প্রদেশের অধিবাসী চেং চিলোংয়ের উদ্যোগে সংগঠিত কয়েক ডজন হাজার দুর্গত জনগণ তাইওয়ানে স্থানান্তরিত হয়ে অনাবাদী জমি আবাদ করে। এই থেকে তাইওয়ানের ব্যাপক উন্নয়নের যুগ শুরু হয়।

চেং ছেংকোং তাইওয়ান মুক্ত করেন 

  ১৬তম শতাব্দীতে সুন্দর ও সমৃদ্ধ তাইওয়ান দ্বীপের ওপর পশ্চিমা উপনিবেশবাদীদের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে । স্পেন, পর্তুগাল প্রভৃতি পশ্চিমা শক্তি পর্যায়ক্রমে তাইওয়ানের ওপর আগ্রাসী তত্পরতা চালিয়ে সেখানকার সম্পদ লুঠ করে , ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালায় এমনকি সৈন্য পাঠিয়ে ভূভাগ জবরদখল করে । ১৬৪২ সালে নেদারল্যাণ্ডের উপনিবেশবাদীরা তাইওয়ানের উত্তরাংশস্থ স্পেনের ঘাঁটি দখল করে ফেলে, তখন থেকে তাইওয়ান নেদারল্যাণ্ডের উপনিবেশে পরিণত হয়।

  নেদারল্যাণ্ডের উপনিবেশবাদীরা তাইওয়ান দখলকালে তাইওয়ানী জনগণকে নিষ্ঠুরভাবে শোষণ করে । তাইওয়ানী জনগণ অবিরামভাবে নেদারল্যাণ্ডের জবরদখলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালায় । ১৬৬২ সালে জাতীয় বীর চেং ছেংকোং তাইওয়ানী জনগণের সহায়তায় তাইওয়ান থেকে ডাচ দখলদারদের তাড়িয়ে দেন । পরে চেং ছেংকোং রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যান । তাঁর ছেলে চেং চিং এবং নাতী চেং খোশুয়াং পর পর তাইওয়ান শাসন করেন । চেং পরিবারের তিন পুরুষ তাইওয়ানে সুশাসন করেন, চিনিশিল্প আর লবণশিল্প উন্নয়নে উত্সাহ দান করেন, শিল্প ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা এবং বাণিজ্য উন্নয়ন , শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা, স্থানীয় কাওশান জাতির অধিবাসীদের কৃষির পদ্ধতির উন্নতি সাধন ইত্যাদি সুব্যবস্থা অবলম্বন করেন। এই সব ব্যবস্থার কল্যাণে তাইওয়ানের অর্থনীতি ও সংস্কৃতির দ্রুত উন্নয়ন হয় । এটা তাইওয়ানের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়নের সময়পর্ব। ইতিহাসে এটা “ মিং রাজবংশের চেংদের আমল” নামে সুপরিচিত।

ছিং রাজবংশের প্রথম দিকে তাইওয়ান চীনের ভূখণ্ডের অন্তর্ভুক্ত

  ১৬৮৩ সালে চীনের ছিং রাজবংশের খাং শি সম্রাটের আমলে ছিং রাজ সরকার তাইওয়ানকে আক্রমণ করতে সৈন্য পাঠালে তাইওয়ানের শাসক চে খোশুয়াং সদলবলে আত্মসমর্পণ করেন । ছিং রাজবংশীয় সরকার তাইওয়ানকে একটি বিভাগ এবং তিন জেলা হিসেবে গণ্য করে এবং তা ফুচিয়েন প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করে। ফলে তাইওয়ান পুনরায় চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের একীভূত শাসনাধীনে আসে । রাজনীতি, অর্থনীতি , সংস্কৃতি , শিক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে চীনের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে তাইওয়ানের আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং তা একটি একীভূত রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয় ।

  ১৮৮৫ সালে ছিং সরকার তাইওয়ানকে একটি প্রদেশে পরিণত করে এবং লিউ মিংছুয়েন তাইওয়ান প্রদেশের প্রথম গভর্নর নিযুক্ত হন। লিউ মিংছুয়েনের আহবানে ফুচিয়েন এবং কুয়াংতোং প্রভৃতি স্থানের বাসিন্দারা তাইওয়ানে স্থানান্তরিত হয় এবং ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালায়। যথাক্রমে জমি আবাদের সাধারণ ব্যুরো, টেলিগ্রাফ সাধারণ ব্যুরো, রেলপথ সাধারণ ব্যুরো, সমরসজ্জা ব্যুরো, বাণিজ্য ব্যুরো, খনি ও তেল সম্পদ ব্যুরো, কাঠশিল্প ব্যুরো ইত্যাদি সরকারী সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় । কামানের দুর্গ নির্মাণ করা হয়, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুসংবদ্ধ করা হয়, বিজলী তার স্থাপন করা হয় , ডাক ও টেলিগ্রাফ প্রতিষ্ঠিত হয়, রেলপথ নির্মাণ করা হয়, খনি সম্পদ উন্নয়ন করা হয়, বাণিজ্যিক জাহাজ নির্মাণ করা হয় এবং শিল্প ও বাণিজ্যের উন্নয়ন সাধন করা হয়, চীনা ঐতিহ্যিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পাশ্চাত্য ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান(স্কুল কলেজ) প্রতিষ্ঠা করা এবং শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নয়নের ব্যবস্থা নেয়া হয়।

জাপানের দখলের সময়পর্ব

  উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে জাপান তার সংস্কার আন্দোলন সম্পন্ন করার মাধ্যমে ধনতান্ত্রিক উন্নয়নের পথে প্রবেশ করে । ১৮৯৪ সালে জাপান চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বাধায়। এটা ইতিহাসে ১৮৯৪ সালের চীন-জাপান যুদ্ধ নামে পরিচিত। চীনের ছিং রাজ সরকার পরাজিত হয় এবং ১৮৯৫ সালে জাপানের সঙ্গে শিমোনোসেকি চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়। এটা দেশের অধিকারহরণের এক অপমানজনক চুক্তি ,যা অনুযায়ী, তাইওয়ান দ্বীপ এবং ফেংহু দ্বীপপূঞ্জকে জাপানের দখলে ছেড়ে দেয়া হয় । ফলে তাইওয়ান জাপানের উপনিবেশে পরিণত হয় এবং ৫০ বছর স্থায়ী জাপানী দখল শুরু হয়।

  জাপান তাইওয়ান দখল করার পর থাইপেই শহরে গভর্নর-দফতর স্থাপন করে। এটাই তাইওয়ানে জাপানী শাসনের সর্বোচ্চ সংস্থা । তা’ছাড়া জাপানী পক্ষ তাইওয়ানের বিভিন্ন স্থানে থানা স্থাপন করে পুলিশ শাসন প্রবর্তন করে এবং তাইওয়ানে ঔপনিবেশিক শাসন ও “জাপানের রাজকীয় শিক্ষা” প্রবর্তন করে। একই সময়ে জাপান নিজ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে প্রথম দিকে তাইওয়ানকে তার কৃষি উন্নয়ন ও কৃষিজাত দ্রব্য প্রক্রিয়াকরণের একটি ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করেছে , তাতে তাইওয়ানের প্রক্রিয়াকরণ শক্তি ও পরিবহণ ব্যবস্থার ক্রমোন্নতি হয় । দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধকালে জাপান তার সমরবাদী দক্ষিণমুখী আগ্রাসী অভিযানের জন্য তাইওয়ানে সামরিক বিষয় -সংক্রান্ত বিভিন্ন শিল্পের উন্নয়ন করেছে।

পুনরুদ্ধার এবং বিভক্তি

  ইতিহাসের বাস্তব তথ্য অনুযায়ী দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধকালে আন্তর্জাতিক চুক্তি পুনরায় তাইওয়ানকে চীনের ভূখণ্ডের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে । ১৯৪৩ সালের ১ ডিসেম্বর চীন, যুক্তরাষ্ট্র, আর ব্রিটেন তিন দেশের যৌথভাবে স্বাক্ষরিত “কায়রো ঘোষণায়” লিপিবদ্ধ করা হয় : “জাপান যে সব চীনা ভূখণ্ড জবরদখল করেছে, যেমন মাঞ্চুরিয়া, তাইওয়ান, ফেংহু দ্বীপপূঞ্জ ইত্যাদি চীনকে ফেরত দেয়া হয়।” ১৯৪৫ সালের ২৬ জুলাই চীন , যুক্তরাষ্ট্র , ব্রিটেন তিন দেশ এবং পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশগ্রহণে স্বাক্ষরিত “ পোট্স্ড্যাম ইস্তাহারে”পুনরায় ঘোষিত হয় যে, “ কায়রো ঘোষণায় লিপিবদ্ধ ধারাগুলো অবশ্যই কার্যকরী করতে হবে।”

  ১৯৪৫ সালের ১৫ আগষ্ট জাপান ঘোষণা করে যে, সে “পোটস্ড্যাম ইস্তাহারের” ভেতরকার ধারাগুলো গ্রহণ করে এবং বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করে। একই বছরের ২৫ অক্টোবর চীনসরকার থাইপেই শহরে তাইওয়ান প্রদেশের জাপানী বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে । কিন্তু তাইওয়ানের পুনরুদ্ধারের পর তত্কালীন চীনের ক্ষমতাসীন কুওমিনতাং পার্টির কর্তৃপক্ষ অতি ভুল নীতি অবলম্বন করে, তাইওয়ানের জনগণের ওপর সামরিক একনায়কত্বের শাসন চালায়। এই প্রশাসনের দুর্নীতির দরুণ তাইওয়ানী জনগণের সঙ্গে তাদের বিরোধ তীব্রতর হয়ে উঠে । ১৯৪৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তাইওয়ানী জনগণ কুওমিনতাং প্রশাসনের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থান করেন । কুওমিনতাং সরকারের সমাবেশিত প্রচুর সৈন্য চিলোং বন্দরে অবতরণ করে রক্তক্ষয়ী দমন অভিযান চালিয়ে ৩০ হাজার লোককে নিহত করে ।এটা ইতিহাসে “ ২৮শে ফেব্রুয়ারি” ঘটনা নামে সুপরিচিত।

  ১৯৪৯ সালের ১লা অক্টোবর চীনা জনগণ চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে কুওমিনতাং সরকারকে উত্খাত করেন এবং নয়াচীনের জন্ম হয় । চীনের মূলভূখণ্ড মুক্ত হবার প্রাক্কালে কুওমিতাংয়ের নেতা চিয়াং কাইশেক এবং কুওমিতাংয়ের সৈন্যবাহিনী ও সরকারের আংশিক লোকজন তাইওয়ানে পালিয়ে যান । তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা ও সমর্থন-পুষ্ট হয়ে তাইওয়ানে তাঁদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হন । ফলে তাইওয়ান পুনরায় মাতৃভুমির মূলভুখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।