1209
|
২০০৭ সালের ২১ জুন, চীনের মূলভূভাগের প্রথম সংরক্ষিত অঞ্চলকে ন্যাশনাল পার্ক হিসেবে নামকরণ করা হয়। এ পার্কের নাম সাংগ্রি-লা পু তা চুও ন্যাশনাল পার্ক।
২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চীনে প্রথম বড় আকারের ওয়াইল্ডলাইফ ন্যাশনাল পার্ক অর্থাত তিব্বত ছিয়াং থাং তিব্বতি সারং ও ওয়াইল্ড ইয়াক ন্যাশনাল পার্ক তিব্বতের রাজধানী লাসায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ সংরক্ষিত প্রাকৃতিক অঞ্চলের মোট আয়তন ২৯৮ হাজার বর্গ কিলোমিটার। এ এলাকাকে বন্যপ্রাণীর সবচেয়ে সুন্দর আবাসস্থল ও শেষ স্বর্গ বলে ডাকা হয়।
এখানকার বন্যপ্রাণী সংরক্ষণকারী খা চিয়া তা মা বলেন, "আগে এখানে তিব্বতি সারংয়ের সংখ্যা ছিলো মাত্র ৩০৪০। নি মা জেলার বন বিভাগ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে এবং এখন প্রজনন ঋতুতে তিব্বতি সারংয়ের সংখ্যা এক হাজারের বেশি। আমাদের যত্নে তাদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।"
তিব্বতি সারং ছাড়া, সম্প্রতি কয়েক বছরে সরকার বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিষয়ক নানা ব্যবস্থা নিয়েছে এবং ছিয়াং থাং তৃণভূমিতে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এখানে তিব্বতি হরিণ, বন্য ইয়াক, তিব্বতি বন্য গাধা ও তুষার চিতাসহ নানা দুর্লভ ও বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণী দেখা যায়।
জানা গেছে, বর্তমানে চীনে দর্শনীয় স্থান, সংরক্ষিত প্রাকৃতিক অঞ্চল, ফরেস্ট পার্ক, জাতীয় ভূ-তাত্ত্বিক পার্কসহ নানা সংরক্ষিত অঞ্চলের আয়তন ১৭ লাখ বর্গ কিলোমিটার। যা মোট ভূভাগীয় আয়তনে তার অনুপাত ১৮ শতাংশ। চীনারা এ ১৮ শতাংশ ভূভাগীয় জমিকে সবচেয়ে সুন্দর ভূমি বলে ডাকেন।
প্রাকৃতিক পরিবেশ মানবজাতির অস্তিত্ব ও উন্নয়নের ভিত্তি। সামাজিক অর্থনীতি উন্নয়নের সাথে সাথে পরিবেশ দূষণ চীনে বিশাল একটি সমস্যায় পরিণত হয়েছে।
পরিবেশ সংরক্ষণ, দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং অবনতিশীল প্রাকৃতিক পরিস্থিতি দমন এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। ন্যাশনাল পার্কসহ সংরক্ষিত প্রাকৃতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ক চীনের নানা ব্যবস্থার অন্যতম।
চলতি বছর অনুষ্ঠিত চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি)-এর ১৮তম কেন্দ্রীয় কমিটির পঞ্চম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে 'জাতীয় অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়নের ১৩তম পাঁচসালা পরিকল্পনা প্রস্তাব' গৃহীত হয়। এ প্রস্তাব অনুযায়ী ভবিষ্যত ৫ বছরে চীনের ৫টি উন্নয়ন ধারণার অন্যতম হলো সবুজ উন্নয়ন। প্রস্তাবে বলা হয়, চীন দ্রুতভাবে সম্পদ সাশ্রয়ী ও পরিবেশ বান্ধব সমাজ নির্মাণ করবে।
চীনের পরিবেশ সংরক্ষণ মন্ত্রণালয়ের পরিবেশ ও অর্থনৈতিক নীতি গবেষণালয়ের প্রধান সিয়া কুয়াং মনে করেন, ভবিষ্যত ৫ বছরে সবুজ উন্নয়ন চীনা উন্নয়নের পথনির্দেশক চিন্তাধারা।
তিনি বলেন, "১৩তম পাঁচসালা পরিকল্পনা আমাদের অঙ্কন। পরিবেশগত সভ্যতা নির্মাণকে আরও উচ্চ একটি কৌশলগত অবস্থানে রাখতে হবে, অন্য নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। এবারের ১৩তম পাঁচসালা পরিকল্পনায় সবুজ উন্নয়নকে আত্মা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং এটি বিশ্বব্যাপী একটি উন্নত পরিকল্পনা।"
চীনে সংস্কার ও উন্মুক্ত নীতি চালু হওয়ার পর, আগের কোনো অভিজ্ঞতা না পেয়ে চীন নিজে একটি উন্নয়নের পথ খুঁজে পায়। ত্রিশ বছর পর, অর্থনীতি উন্নয়নের সাথে সাথে প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সিয়া কুয়াং বলেন, "আগে আমরা প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি করে উন্নয়ন অর্জন করেছি। কিছু সফলতা অর্জন করলেও পরিবেশের সঙ্গে তা সামঞ্জস্যহীন। এবার সবুজ উন্নয়নের ধারণা ১৩তম পাঁচসালা পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এতে প্রমাণিত হয়েছে যে, আমাদের উন্নয়নের পথনির্দেশক চিন্তাধারা আরও স্পষ্ট এবং চীনা জনগণের সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।"
২০১৩ সালে চীনা অর্থনীতি 'নতুন সাধারণ' পরিস্থিতিতে প্রবেশ করেছে। তার মানে চীনা অর্থনীতির উন্নয়ন দ্রুত গতি থেকে মাঝারি গতিতে প্রবেশ করেছে। সম্পদ ও বিনিয়োগের বদলে নবায়ন ও উদ্ভাবনের সামর্থ্য অর্থনীতি উন্নয়নের চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে।
চীনের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চলের কুয়াং তুং প্রদেশ সম্প্রতি কয়েক বছরে সবুজ উন্নয়নের ধারণা বাস্তবায়ন করেছে এবং স্থানীয় প্রাকৃতিক পরিবেশের লক্ষণীয় উন্নতি হয়েছে।
জানা গেছে, কুয়াং তুং প্রদেশে দূষিত পানি পরিশোধনের ক্ষমতা প্রতি দিন ২কোটি টন, তা সারা চীনের দূষিত পানি পরিশোধনের পরিমাণের ১৩ শতাংশ।
চীনের প্রধান ৭টি নদীর মধ্যে কুয়াং তুংয়ের নিকটবর্তী চু চিয়াং নদীর পানির মান সবচেয়ে ভালো। তা ছাড়া, বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে কুয়াং তুং প্রদেশ অগ্রগতি অর্জন করেছে।
চীনের ইকোলজি সোসাইটির সদস্য, সান ইয়াত-সেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান গবেষণালয়ের অধ্যাপক কুয়ান তুং সেং বলেন, "কুয়াং তুং প্রদেশের জিডিপি চীনে বৃহত্তম এবং দূষণ নির্গমনের পরিমাণও বেশি। তার মানে আমাদের জন্য নির্গমন কমানো কঠিন একটি কর্তব্য। ১৩তম পাঁচসালা পরিকল্পনার আওতায় সরকার পরিবেশ সংরক্ষণে বিশাল অর্থ বিনিয়োগ করবে এবং এ সুযোগে পরিবেশবান্ধব শিল্প উন্নয়ন করা উচিত আমাদের।"
আসলে চীনের প্রত্যেক পাঁচসালা পরিকল্পনায় যেমন রয়েছে পরিচালনানীতি তেমনি রয়েছে বাধ্যবাধকতানীতিও।
অর্থনীতি ও বস্তুগত জীবনের মান উন্নয়নের সাথে সম্প্রতি কয়েক পাঁচসালা পরিকল্পনায় পরিবেশ সংরক্ষণ, সম্পদ সাশ্রয়সহ গণসেবা ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতানীতি বেশি দেখা যায়।
সর্বশেষ একটি পাঁচসালা পরিকল্পনায় সবুজ উন্নয়ন সম্পর্কে নীতির অনুপাত বৃদ্ধি হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে চীনের জাতীয় উন্নয়ন ও সংস্কার কমিশনের পরিচালক সু সাও সি বলেন, "প্রথমত, নিম্ন কার্বন উন্নয়ন। আমরা আরও বেশি অজীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করবো। গত বছরে সব জ্বালানির মধ্যে অজীবাশ্ম জ্বালানির অনুপাত ১১.১ শতাংশ। তাছাড়া, কয়লা দূষণ-বিহীন ব্যবহারেও আমরা উত্সাহ দেই। দ্বিতীয়ত, সম্পদ ব্যবহারের সাশ্রয় ও কার্যক্ষম, পরিমাণ ও ক্ষমতা দু'পক্ষ থেকে নিয়ন্ত্রণ করবো। তৃতীয়ত, আমরা বাজারায়নের ব্যবস্থা নিয়ে ব্যবস্থাপনা করবো। বাজারে পানি, জ্বালানি ও জমির ব্যয় অনুযায়ী মূল্য নির্ধারণ করবো।"
সমাজ ও অর্থনীতির উন্নয়নের সঙ্গ সঙ্গে জনগণের জন্য মৌলিক চাহিদা ছাড়াও উন্নত প্রাকৃতিক পরিবেশ তাদের সুখের সূচক। পরিবেশের সঙ্গে সম্প্রীতিমূলক সহাবস্থান করা চীনের বর্তমান এবং ভবিষ্যত উন্নয়নের প্রধান প্রবণতা। চীন টেকসই উন্নয়ন এবং পরিবেশ সংরক্ষণের ওপর গুরুত্ব দেয় এবং তা আন্তর্জাতিক সমাজের ভীষণ প্রশংসা পেয়েছে।
ইতালির সাবেক প্রধানমন্ত্রী মারিও মন্তি বলেন, "আমি মনে করি, চীন বা বিশ্বের অর্থনীতি হোক না কেন সমন্বয় ও ভারসাম্য হলো টেকসই উন্নয়নের চাবিকাঠি। তাই আমি মনে করি, চীনের এর ওপর গুরুত্ব দেওয়া তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি চীনের অর্থনীতির উন্নয়ন ও পরিবেশ সংরক্ষণের মধ্যে আরও ভারসাম্য অর্জনের জন্য সহায়ক।"
৩০ নভেম্বর জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন প্যারিসে উদ্বোধন হয়েছে এবং এ সম্মেলন ১১ ডিসেম্বর শেষ হবে। এবারের এ সম্মেলনে বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশগ্রহণকারী হিসেবে চীন অন্য দেশের সঙ্গে নতুন একটি বিশ্ব চুক্তি স্বাক্ষর করবে। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় চীনের ধারণা ও পরিকল্পনা তুলে ধরেন।
সি চিন পিং বলেন, "২০৩০ সালে চীনের কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছাবে এবং যতদ্রুত সম্ভব এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা হবে। ২০০৫ সালের তুলনায় ২০৩০ সালে ইউনিট জিডিপিতে কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ পরিমাণ ৬০ শতাংশ কমাবো। এ ব্যাপারে কঠিন প্রচেষ্টা চালাতে হবে, তবে আমাদের নিজের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের দৃঢ়প্রতিজ্ঞা ও আস্থা আছে।"