1106yin
|
শ্রীলংকার ১০০ রুপির নোটের এক পাশে একটি বড় ধরনের প্রকল্পের ছবি রয়েছে। এটা হলো দেশটির বিখ্যাত লাকভিজায়া কয়লা বিদ্যুত্ কেন্দ্র, পুত্তালাম। এ প্রকল্পটি শ্রীলংকার প্রথম কয়লা বিদ্যুত্ কেন্দ্র। পাশাপাশি শ্রীলংকার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ধরনের প্রকল্প এটি। এ ছাড়া পুত্তালাম কয়লা বিদ্যুত্ প্রকল্পটি চীন ও শ্রীলংকার বৃহত্তম সহযোগিতামূলক প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম। চায়না মেশিনারি ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন বা সিএমইসি এ বিদ্যুত্ কেন্দ্রটি নির্মাণ করে। এ প্রকল্পে সহায়তায় চীনের এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক ১৩০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তা দিয়েছে।
রাজধানী কলোম্বোর উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে ১৩০ কিলোমিটার দূরে কালপিটিয়া উপদ্বীপে সংবাদদাতা ১শ' রুপির ওপর ছাপানো ওই দৃশ্যটি দেখেন। সেখানে তিন দিকে সমুদ্র। পুত্তালাম বিদ্যুত্ কেন্দ্রের তিনটি লাল-সাদা বিরাট ধোঁয়াপথ এবং সাদা রঙের বেজ স্টেশনটি নীল সমুদ্র এবং পরিষ্কার আকাশের পটভূমিতে বেশ আকর্ষণীয়। সংবাদদাতা এটা দেখে খুবই আশ্চর্য হন যে, ঘটনাস্থলে যন্ত্রপাতির শব্দ ছাড়া কারখানার কোনো ধোঁয়া তেমন একটা দেখা যায় না অথবা দূষণের কোনো গন্ধ পাওয়া যায় না।
পুত্তালাম বিদ্যুত্ কেন্দ্রের অপারেশন ও মেইনটেনেন্স ইউনিটের ম্যানেজার জাং তিংমিং সংবাদদাতাকে বলেন,
বিদ্যুত্ কেন্দ্রটি সম্পূর্ণ পশ্চিমা দেশের পরিবেশ সংরক্ষণের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নির্মিত। বর্তমান ডিজাইন এবং আমরা প্রথম শ্রেণীর পরিবেশ সংরক্ষণ কোম্পানির 'ইলেকট্রিক ধুলো সংগ্রাহক' ব্যবহার করে ৯৯.৫ শতাংশ ধূলিকণা নিয়ন্ত্রণ করে থাকি। এ ছাড়া আমাদের জ্বালানি গ্যাস নির্গমন নিয়ন্ত্রণের একটি বিশেষ ব্যবস্থা আছে। এর মাধ্যমে ধূলিকণার পর্যবেক্ষণ এবং সালফার ডাই-অক্সাইড নির্গমন পর্যবেক্ষণ করা হয়। এই বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে সারা বছর ধোঁয়া বা গ্যাসের নির্গমন পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
২০০৭ সালে আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংরক্ষণ মানদণ্ড অনুযায়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত্কেন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এর মোট বিদ্যুত্ উত্পাদন ক্ষমতা হলো ৯ লাখ কিলোওয়াট। গত বছর চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং শ্রীলংকা সফরে তত্কালীন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাক্সের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিদ্যুত্ কেন্দ্রটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন।
বিদ্যুত্ কেন্দ্র প্রকল্প বিভাগের বাণিজ্যিক শাখার ম্যানেজার ছি লিন সংবাদদাতাকে জানান, পুত্তালাম গ্রিডে সংযুক্ত হওয়ার আগে, শ্রীলংকায় শুধু জ্বালানি তেল, বায়ুবিদ্যুৎ ও জলবিদ্যুৎ-এই তিন ধরনের বিদ্যুৎ উত্পাদন হতো। বায়ুবিদ্যুৎ ও জলবিদ্যুৎ পুরোপুরি প্রাকৃতিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় এর উৎপাদন আশানুরূপ ছিল না। তাই কয়লা বিদ্যুতের অনুপস্থিতিতে তেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেশি খরচ হয়। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সার্বিক কার্যক্রম শ্রীলংকার জ্বালানি চাহিদার বেশ খানিকটা পূরণ করেছে এবং জনগণের মাথাপিছু বিদ্যুত্ ব্যবহারের পরিমাণ বেড়েছে।
ছি লিন বলেন,
প্রকল্পের কার্যক্রম চালু হওয়ার পর এর মোট বিদ্যুত্ উত্পাদন শ্রীলংকার মোট ব্যবহৃত বিদ্যুতের ৫০ শতাংশ দখল করবে। কখনও কখনও তা ৬০ শতাংশও হয়ে যেতে পারে। এ পর্যন্ত বিদ্যুত্ কেন্দ্রের তিনটি উৎপাদন সেটের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ১ হাজার গিগাওয়াট পৌঁছেছে। যা শ্রীলংকার জ্বালানি চাহিদা পূরণ করছে। অন্যদিকে শ্রীলংকার মাথাপিছু বিদ্যুত্ ব্যবহার পরিমাণ বেড়েছে। ২০০৮ সালের শেষ নাগাদ শ্রীলংকার মাথাপিছু বিদ্যুত্ ব্যবহারের পরিমাণ শুধুমাত্র ৪১৫ কিলোওয়াট ঘণ্টা ছিল। পাশাপাশি ২০০৬ সালে চীনের মাথাপিছু বিদ্যু্ত ব্যবহার পরিমাণ ২১৪৯ কিলোওয়াট ঘণ্টা ছিল। বিদ্যু্ত কেন্দ্রের কার্যক্রম চালু হওয়ার পর বর্তমানে পিক-আওয়ারে বিদ্যুত্ ব্যবহারের চাপ আগের ১৮০০ মেগাওয়াট থেকে বেড়ে ২১০০ মেগাওয়াটে পৌঁছেছে।
পুত্তালাম বিদ্যুত্ প্রকল্পের আগে সিলন বিদ্যুৎ ব্যুরোর বড় ধরনের লোকসান হয় ও দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির মুখে পড়ে। তবে এ বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণের কারণে অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে। এ সম্পর্কে মালিক পক্ষের প্রতিনিধি পুত্তালামের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ইন্দ্রাসিরি গাল্লাগে বলেন,
তখন শ্রীলংকায় গৃহযুদ্ধ ছিল। নিরাপত্তার কারণে অনেক দেশ প্রকল্প চালু করেনি। বিদেশিরা শ্রীলংকায় আসতে চাইত না। কিন্তু চীন সরকারের সমর্থনে বিদ্যুত্ প্রকল্পটি শুরু হয়। তখন আমাদের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ বিদ্যুত্ উত্পাদন জ্বালানি তেলের উপর নির্ভরশীল ছিল। সুতরাং সে সময় উত্পাদিত বিদ্যুতের খরচ ছিল অনেক বেশি। এতে দীর্ঘদিন ধরে সিলন বিদ্যুত্ ব্যুরোর অনেক অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণের পর, আমাদের জ্বালানির দাম কমে যায়, ফলে বিদ্যুতের দামও আগের চেয়ে কম হয়। কোম্পানি লাভবান হওয়া শুরু করেছে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত্ কেন্দ্রে প্রতি ওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদনের মূল্য ৫.৫ থেকে ৬ রুপি । কিন্তু জ্বালানি তেলে প্রতি ওয়াট বিদ্যুতের মূল্য হয় কমপক্ষে ২৫ রুপি !
গত বছরের সেপ্টেম্বরে বিদ্যুত্ কেন্দ্রটি পুরোপুরি চালু হওয়ার পর থেকে ১২০ বিলিয়ন রুপি বা প্রায় ৯০ কোটি মার্কিন ডলার অর্থ সংগ্রহ করে। যা প্রাথমিকভাবে বিনিয়োগকৃত পুঁজি সংগ্রহ করতে পেরেছে। মালিকপক্ষকে লাভবান করার পাশাপাশি বিদ্যুত্ কেন্দ্রের নিকটকর্তী জনসাধারণের জীবনযাপনও অভূতপূর্ব পরিবর্তন হয়েছে। ইন্দ্রাসিরি বলেন,
প্রকল্প তৈরির আগে এখানকার রাজপথের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। অনেক অধিবাসী বিদ্যুত্ ব্যবহার করতে পারত না। প্রকল্পটি এ অঞ্চলের উন্নয়ন ডেকে এনেছে। বিদ্যুত্ কারখানা তৈরির সময় ছয় শতাধিক স্থানীয় অধিবাসীর কর্মসংস্থান হয়েছে। এখনও আড়াইশ'র বেশি মানুষ এখানে বিভিন্ন ধরনের সেবার সঙ্গে জড়িত রয়েছে। বিদ্যুত্ কেন্দ্রের নির্মাণ জনসাধারণের জন্য যেমন কল্যাণকর হয়েছে তেমনি আগের অনুন্নত এলাকাটি দেশের অন্যান্য জায়গার মতো উন্নত হয়ে উঠছে।
ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ইন্দ্রাসিরি সংবাদদাতাকে বলেন, সিলন বিদ্যুত্ ব্যুরোর সঙ্গে নির্মাণকারী কর্তৃপক্ষ সিএমইসি'র বেশ ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। বিদ্যুত্ কেন্দ্রটি নির্মাণ ছাড়াও চীন শ্রীলংকার শ্রমিকদের জন্য পেশাগত প্রশিক্ষণ ও কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশনা দিয়ে থাকে। চীনা কোম্পানি নিজের সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা এবং চমৎকার প্রযুক্তি দিয়ে পুত্তালাম কেন্দ্রটি সুষ্ঠুভাবে চালু রেখেছে এবং শ্রীলংকার বিদ্যুত্ চাহিদা পূরণে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করছে।
(প্রেমা/তৌহিদ)