সম্প্রতি চীনের সামাজিক বিজ্ঞান অ্যাকাডেমির উদ্যোগে বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতি গবেষণালয় পেইচিংয়ে আয়োজন করে 'এক অঞ্চল, এক পথ' এবং বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমারের মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ" শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলন। এতে অংশগ্রহণকারী বিশেষজ্ঞরা চারটি দেশের মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ ও বাস্তব সহযোগিতা জোরদার করা এবং অভিন্ন উন্নয়ন বাস্তবায়নের কথা বলেন। তারা বলেন, আঞ্চলিক সহযোগিতা একটি স্বল্পোন্নত দেশকে বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে সাহায্য করে।
বাংলাদেশের দ্য ইন্সটিটিউট অব পলিসি, অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড গভরন্যান্স-এর গবেষক মাকসুদুল এ এম মন্ডল সম্মেলনে বলেন, "বাংলাদেশের কেবল ৩০ শতাংশ সড়ক পিচঠালা। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রতি ১০০ জনে মাত্র একজন ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পান। চীনের ইয়ুন নান ছাড়া 'বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ামার অর্থনৈতিক করিডোর'-সংলগ্ন অন্য অঞ্চলগুলোতে মাথাপিছু বিদ্যুত ব্যবহারের বার্ষিক পরিমাণ ৩০০ কিলোওয়াটেরও কম। বাংলাদেশের ৪০ শতাংশ অঞ্চলের মানুষ বিদ্যুত সুবিধা থেকে বঞ্চিত। আর মিয়ানমারের প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষের ঘরে বিদ্যুতের আলো নেই। বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমারেরমধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারে।"
সম্মেলনে ভারতের 'অব্জারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশান' (ওআরএফ)-এর প্রধান সুধেন্দ্র কুলকার্নি বলেন, 'এক অঞ্চল, এক পথ' প্রকল্পের মাধ্যমে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ স্থাপিত হবে। 'বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর' পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অগ্রগতিও খুব তাত্পর্যপূর্ণ। প্রস্তাবিত করিডোর সংলগ্ন অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ প্রচুর, কিন্তু উন্নয়ন পরিস্থিতি ভালো নয়। ২০১২ সালের উপাত্ত অনুযায়ী, এ অঞ্চলের মোট বাণিজ্যের পরিমাণ এর চারটি দেশের মোট বাণিজ্যের মাত্র ৫ শতাংশ। অথচ আসিয়ানের আঞ্চলিক বাণিজ্যের পরিমাণ সংস্থার সদস্যদেশগুলোর মোট বাণিজ্যের ৩৫ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাবে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। এটাই বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমারের সমস্যা।"
কুলকার্নি আরও বলেন, বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমারের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা থেকে ভারত উপকৃত হবে। ভারতের অর্থনীতি দ্রুত উন্নত হচ্ছে। কিন্তু এ দেশের সব অঞ্চলে উন্নয়নের গতি সমান নয়। এখনও ভারতের পূর্বাঞ্চল, উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল অনুন্নত রয়ে গেছে। ঐতিহাসিক কারণে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চল অন্যান্য অঞ্চল থেকে কার্যতঃ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। কলকাতা থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা যেতে ১৬৫০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে হয়। নয়াদিল্লী থেকে আগরতলা যেতে অতিক্রম করতে হয় ২৬৩৭ কিলোমিটার পথ। অথচ বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করলে কলকাতা থেকে আগরতালার দূরত্ব নেমে আসবে মাত্র ৩৫০ কিলোমিটারে। এক্ষেত্রে ভারত বাংলাদেশের সড়কপথ ব্যবহার করতে পারে। এতে পরিবহন খরচও অনেক কমে আসবে। ভারত বাংলাদেশের চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের সুবিধাও নিতে পারে।"
প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক করিডোরটি নির্মিত হলে ভারতের উত্তর-পুর্বাঞ্চলে পর্যটকের সংখ্যা বাড়বে বলে মনে করেন কুলকার্নি। তিনি জানান, এখন প্রতি বছর ভারতের উত্তর-পুর্বাঞ্চলে বিদেশি পর্যটক আসেন ২ লাখেরও কম। বাংলাদেশে আসা বিদেশি পর্যটকের সংখ্যাও বছরে মাত্র ৬ লাখের মত। অথচ ভিয়েতনাম, মিয়ানমার ও থাইল্যাণ্ডে প্রতিবছর গড়ে বিদেশি পর্যটক আসেন যথাক্রমে ২০ লাখ, ৫০ লাখ ও ২ কোটি ৬০ লাখ।
সম্মেলনে ভারতের আরেক গবেষক সরোজ কুমার মোহান্তি বলেন, চীন ও অন্যান্যদেশের কিছু বড় কোম্পানি অবকাঠামোসহ কিছু নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নে সমঝোতাস্মারক স্বাক্ষর করেছে। ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লী, বড় শহর মুম্বাই, পূর্বাঞ্চলের নগর কলকাতা এবং দক্ষিণাঞ্চলের নগর চেন্নাইকে সংযুক্ত করে দ্রুতগতির রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প সেগুলোর অন্যতম। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতা আরও জোরদার করা সম্ভব বলেও তিনি মনে করেন।
মোহান্তি বলেন, "এ অঞ্চলের সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচক প্রমাণ করে যে, চীন ও ভারত দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। মিয়ানমার ও বাংলাদেশ কঠিন সময় অতিক্রম করে এসেছে। এখন এ দুটি দেশেও বিনিয়োগ দ্রুত বাড়ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ অঞ্চলের প্রতি বিশ্বের মনোযোগ বেড়েছে। এ অঞ্চলের দেশগুলো আঞ্চলিক উন্নয়নের ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। দেখা যাচ্ছে, মিয়ানমার ও বাংলাদেশে আঞ্চলিক বিনিয়োগ বাড়ছে। বিশেষ করে এ দুটি দেশে চীন ও ভারতের বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমারের মোট জিডিপি ২০০০ সালে বিশ্বের মোট জিডিপির ১২ শতাংশে ছিল, ২০১৫ সালে এটা ২৫ শতাংশে পৌঁছেছে; বৃদ্ধির হার অতি দ্রুত।"
সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য বিশেষজ্ঞ মনে করেন, চীনের প্রস্তাবিত 'এক অঞ্চল, এক পথ' কৌশল সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর জন্য সুন্দর ভবিষ্যত সৃষ্টি করবে। শ্রীলংকার নীতি গবেষণালয়ের গবেষক নিপুনি পেরেরা বলেন, তার দেশের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, 'এক অঞ্চল, এক পথ' সংলগ্ন দেশগুলো হচ্ছে শ্রীলংকাররফতানি ও আমদানির মূল বাজার। ২০১৪ সালে শ্রীলংকার ৬৯ শতাংশ রফতানিবাণিজ্য হয় এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের সাথে। সে বছর এ তিনটি অঞ্চল থেকে ৯২ শতাংশ আমদানিও সম্পন্ন করে দেশটি। পেরেরা মনে করেন, 'এক অঞ্চল, এক পথ' একটি অত্যন্ত ভালো প্লাটফর্ম। এটা শ্রীলংকার শিল্প উন্নয়নের সহায়ক হবে।
শ্রীলংকার নীতি গবেষণালয়ের আরেক গবেষক জানাকা উইজয়াসিরি-ও মোটামুটি একই অভিমত প্রকাশ করলেন। তিনি বলেন, "দীর্ঘকাল ধরে এশিয়ার রাজনীতি ও অর্থনীতির ওপর ইউরোপ ও পশ্চিমা দেশগুলোর প্রভাব ছিল সিদ্ধান্তমূলক। বিংশ শতাব্দীতে এশিয়া ঔপনিবেশিক শাসন ও সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন থেকে মুক্ত হওয়ার পর নিজের ভাগ্য নিজেই লিখতে শুরু করে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে এশিয়ার উত্থান ঘটে। কিন্তু এশিয়ার বেশ কিছু দেশ এখনও অনুন্নত রয়ে গেছে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশ। একবিংশ শতাব্দীতে দুটি বিষয় এশিয়ার পরিবর্তন ত্বরান্বিত করছে। একটা হচ্ছে বিশ্বায়ন, আরেকটা হচ্ছে আঞ্চলিক সহযোগিতা। আমাদের সহযোগিতার মাধ্যমে এ অঞ্চলের নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হবে। এ সহযোগিতা সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে সমৃদ্ধ করবে, এতদঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে এবং এশীয় সংস্কৃতি পুনরুত্থানেও সহায়ক হবে।"
সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বিশেষজ্ঞরা একমত হন যে, আর্থনীতিক উন্নয়ন এতদঞ্চলের সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নয়নের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। তারা মনে করেন, উন্নয়ন হচ্ছে নিরাপত্তার ভিত্তি। যত উন্নত হওয়া যাবে, ততই পারস্পরিক আস্থা বাড়বে। যারা নিরাপত্তার অজুহাতে অর্থনৈতিক করিডোর নির্মাণের বিরোধিতা করছেন, তারা স্পষ্টতই ভুল করছেন বলে বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করেন। (ইয়ু/আলিম)
| ||||