Web bengali.cri.cn   
চীনের কুয়াংচৌ ও শেনচেন শহর: যেখানে হারিয়েছে মন নদী, টাওয়ার,পার্ক, রেলপথ আর বিমানবন্দরে-২
  2015-10-10 17:30:12  cri

চীন আন্তর্জাতিক বেতার (সিআরআই)-এর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েই প্রকাশ করছি চীনের কুয়াংচৌ শহর ভ্রমণ নিয়ে আমার অনুভূতি।

গত ২১ সেপ্টেম্বর ৫ দিনের এক সফরে সিআরআই থেকে কুয়াংচৌ যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিলো আমার। সঙ্গে ছিলেন সিআরআই বাংলা বিভাগের আমার সহকর্মী উপ-পরিচালক ছাওয়াইয়ানহুয়া সুবর্ণা এবং সিআরআই শ্রীলংকা বিভাগের দু'জন সাংবাদিক। এদের মধ্যে একজন চীনা ও আরেকজন শ্রীলংকান।

আসলে সিআরআইতে চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার জন্য মনটা সবসময়ই উদগ্রীব থাকে। অপেক্ষায় থাকি কখন সেই সুযোগ হবে; কখন সুযোগ হবে বিশাল চীনের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করার।

আমি ব্যক্তিগতভাবে ভীষণ ভ্রমণপিপাসু। যখনই সময় পাই তখনই বেড়িয়ে পড়ি ঘুরে বেড়ানোর জন্য। আমি বিশ্বাস করি ভ্রমণে যে অভিজ্ঞতা তৈরি হয় তা জীবনকে করে তোলে পরিপূর্ণ ও পরিপক্ক। জীবনের বহুতল বাস্তবতার বিভিন্ন পরিস্থিতি মোকাবিলায় অভিজ্ঞতা এক বিশাল যাদু হিসেবে কাজ করে।

নোবেল বিজয়ী বিখ্যাত আইরিশ নাট্যকার স্যামুয়েল বেকেটের 'ওয়েটিং ফর গডো' নাটকে পোজো নামের একটি চরিত্র আছে। আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম তখন আমি এ নাটকটিতে অভিনয় করেছিলাম। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন অনেক নাটকে অভিনয় করেছি। তবে আমার দৃষ্টিতে ওয়েটিং ফর গডো নাটকে আমার যে অভিনয় তা আমি এখনও ভুলতে পারি না। এ কথা বলছি এ কারণে যে, পোজো চরিত্রটির একটি বিখ্যাত সংলাপ আছে যা আমার জীবনের দর্শনের সাথে খুব ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। পোজো বলেন, "জীবনে যতবেশি লোকের সাথে পরিচয় হয় আমার, ততবেশি খুশি হই আমি"। আমার জীবন যেন এরকমই । আমিও প্রতিনিয়ত বিভিন্ন লোকের সাথে পরিচিত হতে চাই, বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়াতে চাই। আর এর মধ্য দিয়েই তৈরি হয় আমার সত্যিকার মানসিক বিকাশ। কারণ আমি তখন একদিকে বিভিন্ন মানুষ এবং বিভিন্ন জায়গা সম্পর্কে যেমন জানতে পারি, তেমনি জানতে পারি তাদের রীতিনীতিও।

আসলে আমার এবার কুয়াংচৌ ভ্রমণ ছিলো অনেকটাই অপ্রত্যাশিত। অপ্রত্যাশিত বলছি এ কারণে যে, হঠাত করেই আমি এ সুযোগটি পেয়ে যাই।

আমি তখন বাসায় বসে কাজ করছিলাম, হঠাত আমার সহকর্মী সুবর্ণা আপু আমাকে ফোন করেন। তিনি বলেন, খুব সম্ভবত বাইরে যাওয়ার একটি সুযোগ হতে পারে আমার । আমি তখন বললাম কোথায়? সুবর্ণা আপু জানালেন সম্ভবত কুয়াংচৌ বা ফুচিয়েন। আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে সরাসরি বলে দিলাম আমি যাওয়ার জন্য একদম প্রস্তুত। তারপর অফিসে গিয়ে সুবর্ণা আপুকে আমার পাসপোর্টের কপি দিলাম। সম্ভবত একদিন পরেই তিনি জানালেন, আমরা ২১ তারিখ রওয়ানা হবো। জানতে পারলাম আমাদের সঙ্গে যাচ্ছেন শ্রীলংকা বিভাগের দু'জন। একজনের নাম সাদিশা (চীনা), আরেকজনের নাম দিলশান (শ্রীলংকান) ।

সাদিশা এবং দিলশান আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমি সময় পেলেই তাদের সঙ্গে গল্প করি, আড্ডা মারি, সময় কাটাই। তাই তাদের নাম শুনে আরও খুশি হলাম। শুরু হলো তাদের সঙ্গে যোগাযোগ।

তারা বললেন, নি:সন্দেহে আমাদের এ ভ্রমণ আমাদের কাছে হবে অনেক মজার, অনেক আনন্দের।

আমি তখন অনেকের কাছেই জানতে চাইলাম বিমানে পেইচিং থেকে কুয়াংচৌ যেতে কত সময় লাগে? জানতে পারলাম তিন ঘণ্টার মতো সময় লাগে বিমানে।

আসলে বিমানে ভ্রমণ করাটা এক সময় হয়তো আমার কাছে স্বপ্নের মতো ছিলো। যা আমি আজ কোনো ধরনের লাজ লজ্জা ছাড়াই স্বীকার করছি। কারণ সত্যকে স্বীকার করার মানসিকতা আমি সবসময়ই পোষণ করি। অবশ্য সিআরআই আমার সেই স্বপ্ন পূরণ করেছে অনেক আগেই । কারণ সিআরআই আমাকে চাকরি দিয়েছে। আর তখন আমাকে বিমানে করেই ঢাকা থেকে পেইচিংয়ে আসতে হয়েছে।

যাইহোক, ২০ সেপ্টেম্বর রাতে লাগেজ গুছিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম সকালের। সকাল ৬টায় সিআরআই থেকে গাড়িতে করে আমাদের যেতে হবে পেইচিং বিমানবন্দরে।

যথারীতি ৬টার আগেই সিআরআইয়ের গেটে পৌঁছলাম। এরপর একেএকে সবাই আসলেন। আমাদের গাড়িও প্রস্তুত। উঠে বসলাম গাড়িতে বিমানবন্দরের উদ্দেশে। পেইচিংয়ের স্নিগ্ধ, শান্ত ভোরবেলাকে অতিক্রম করে গাড়ি ছুটে চলেছে। জানালা দিয়ে বাইরের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করছি । উপভোগ করছি সকালের পেইচিংকে। এভাবে পৌঁছলাম বিমানবন্দরে। বিমানবন্দরে নেমে সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে অপেক্ষা করছি বিমানের । সুবর্ণা আপু আমাদের সবার জন্য নাস্তা এবং কফির ব্যবস্থা করলেন। বসে বসে কফি পান করছি আর বাইরে তাকিয়ে দেখছি বিমানগুলোকে।

নির্দিষ্ট সময়ে আমরা বিমানে চড়ে বসলাম। আমার মধ্যে তখন অন্য এক ধরনের অনুভূতি। ভাবলাম একসময় বিমানে ওঠা আমার জন্য ছিলো স্বপ্নের মতো, আর এখন আমি সুযোগ পেলেই বিমানে করে বিভিন্ন জায়গায় যেতে পারি। মনের গভীরে সিআরআইয়ের প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা বোধ জাগ্রত হচ্ছিল। প্রকাশ করতে পারছিলাম না। বারবার মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জের সেই যমুনা পাড়ের ছেলে আমি এখন বিমানে করে ঘুরে বেড়াই অফিসের কাজে। আর এসব কিছুই সম্ভব হয়েছে সিআরআইয়ের কারণে। আবারও জীবনের সমস্ত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম সিআরআইয়ের প্রতি।

আমাদের বিমান উড়ে চলেছে কুয়াংচৌর উদ্দেশে। বিমানের ছোট্ট জানালা দিয়ে বার বার বাইরে তাকাচ্ছি । দেখছি মেঘের ওপর দিয়ে উড়ে চলছে আমাদের বিমান। শহরগুলোকে মনে হচ্ছে পাখির ছোট্ট বাসার মতো । কখনও কখনও নিচে পাহাড়ের চূড়াগুলোকে দেখা যাচ্ছে ছোট্ট ঢিবির মতো । এভাবে সবকিছু দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছলাম কুয়াংচৌ বিমানবন্দরে। সেখানে তখন বৃষ্টি হচ্ছিল। আমরা বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে যাত্রা শুরু করলাম শহরের উদ্দেশে, যেখানে আমাদের থাকার হোটেল।

বিমানবন্দর থেকে মূল শহর বেশ দূরে । আমরা গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি চলা শুরু করলো। বাইরে তখন বৃষ্টি। আমার কাছে হঠাত কুয়াংচৌ শহরটাকে পরিচিত মনে হলো, তবে জানিনা কেন। মনে হলো বাংলাদেশের সিলেট বা পার্বত্য অঞ্চলের কোনোদিকে যাচ্ছি আমরা । রাস্তার দু'পাশে সারিসারি গাছ। দূরে দালানকোঠা। গাছগুলোকে দেখে মনে হচ্ছিলো বৃষ্টিতে তারা নিজেদেরকে ভিজিয়ে নিচ্ছে। আমি সুবর্ণা আপুকে বললাম, এ জায়গাটা দেখতে বাংলাদেশের সিলেট বা পার্বত্য অঞ্চলের মতো । তিনিও আমার সাথে একমত পোষণ করলেন।

এখানে উল্লেখ করতে চাই যে, আমার সহকর্মী সুবর্ণা আপু একসময় বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার ওপর লেখাপড়া করেছেন এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত চীন দূতাবাসে কাজ করেছেন। তাই বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা তার আছে। যাইহোক কুয়াংচৌ শহরের প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী দেখতে দেখতে মনে হলো এটি একটি সবুজ প্রকৃতির শহর।

অনেক অনেক আগে এই শহরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ইতিহাসও অনেক দীর্ঘ। অনেকের কাছে এই শহর 'ক্যান্টন' নামেও পরিচিত। দক্ষিণ চীনের কুয়াংতং প্রদেশের রাজধানী হলো এই কুয়াংচৌ শহর। বিখ্যাত 'পার্ল রিভার'-এর পাশে এই শরটি অবস্থিত। এর অদূরেই চীনের হংকং এবং ম্যাকাও।

চীনের ব্যবসা-বাণিজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে এই শহরের রয়েছে ব্যাপক পরিচিতি। বাংলাদেশসহ অনেক দেশের লোকজন ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য এখানে নিয়মিত যাতায়াত করেন।

আসলে শহরের পরিবেশ দেখলেই বোঝা যায় এটা ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ একটি শহর। তুলনামূলকভাবে এই শহর অনেক ব্যস্ত। পুরো শহর সুউচ্চ দালানকোঠা আর সবুজ গাছগাছালির এক মিলিত অবস্থান। শহর জুড়ে ছোট ছোট টিলা আর তাতে নানান রকমের গাছ। শহরের মাঝখান দিয়ে ছুটে চলা রাস্তাগুলোতে সবসময়ই মানুষের আনাগোনা। সবাই ব্যস্ত নিজ নিজ কাজে।

আমরা গাড়িতে করে মূল শহরে প্রবেশ করলাম। গাড়ি থেকে নেমে কিছুদূর হেঁটে সোজা হোটেলে। হোটেলে পৌঁছার কিছুক্ষণ পর বেড়িয়ে পড়লাম খাবারের উদ্দেশে। খাবার খেয়ে রওয়ানা দিলাম আমাদের পূর্বনির্ধারিত কাজে।

সিআরআই থেকে রওয়ানা হওয়ার আগেই আমাদের কর্মসূচি তৈরি করা হয়েছিলো । তাই সেখানকার প্রতিটি দিন ছিলো আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

যাইহোক, প্রথমদিন আমাদের কাজ ছিলো সেখানকার সান ইয়াত-সেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সাক্ষাতকার নেওয়া। আগে থেকেই তাদের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করেছিলাম।

তবে বৃষ্টি আমাদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু কি আর করা! কর্মসূচি অনুযায়ী আমাদের কাজ শেষ করতেই হবে। আমরাও চ্যালেঞ্জ নিলাম। আমরা বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তারা জানালেন, বৃষ্টির কারণে সবার মিলিত হতে একটু সময় লাগবে তাই আমরা যেন একটু দেরিতে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই।

আমরা সাবওয়ে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি কোনো একটি পার্কে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। তখনও বৃষ্টি হচ্ছে । সুবর্ণা আপু বললেন, এখানে 'ইউয়েশিয়ু পার্ক' নামে একটি পার্ক আছে, আগে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। আমরা সেই পার্কে পৌঁছলাম। তখন সময় বিকেল ৫টা। ব্যস্ত রাস্তার পাশে বিশাল এলাকাজুড়ে এই পার্ক অবস্থিত। পার্কের সামনের রাস্তায় ভীষণ ব্যস্ততা থাকলেও ভিতরের পরিবেশ একদম শান্ত, নি:স্তব্দ । টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে। আমার কাছে কোনো ছাতা ছিলোনা। পার্কের গেট থেকে একটি ছাতা কিনলাম। এরপর প্রবেশ করলাম পার্কে। ভিতরে প্রবেশ করেই একটি লেক চোখে পড়লো আমাদের ।

আমি এবং সুবর্ণা আপু লেকের পাড়ে গেলাম। লেকের পানিতে টিপ টিপ বৃষ্টির ফোটা মনে হচ্ছিল বুদবুদ তৈরি করছে। আর সোনালী রঙের মাছগুলো দল বেধে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

দীর্ঘদিন পর এ ধরনের দৃশ্য চোখে পড়লো আমার। আসলে আমার জীবনের সাথে এ ধরনের দৃশ্য ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত রয়েছে। আমি গ্রামে বড় হয়েছি। গ্রামের ধুলাবালি, পুকুর,নদী-নালার পানি আমার রক্তের সাথে মিশে আছে। তাই এ ধরনের দৃশ্য দেখলে আমি স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। আমার মন চঞ্চল হয়ে ওঠে গ্রামের জন্য।

সুবর্ণা আপু বললেন, এই পার্কে 'ফাইভ গোটস স্ট্যাচু' আছে। আগে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। তবে বৃষ্টি এবং সময়ের অভাবে আমরা সেদিন তা দেখতে পাইনি। আমরা পার্কে কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে রওয়ানা হই সান ইয়াত-সেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে।

আনুমানিক ৭ টার দিকে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে আমরা সেখানে অধ্যয়নরত ৩ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সাক্ষাতকার নেই। তারপর সেখান থেকে বের হয়ে আমরা চলে যাই বিখ্যাত 'পার্ল রিভার' পাড়ে। 'পার্ল রিভার' পাড় ঘেঁষে সান ইয়াত-সেন বিশ্ববিদ্যালয়টি অবস্থিত।

পার্ল রিভারের দিকে যাওয়ার সময়ই এই নদীর অপরূপ দৃশ্য চোখে পড়ছিলো। নদীকে ঘিরে চোখ জুড়ানো আলোর ঝলকানি। নদীর দুই পাড়ে অসাধারণ আলোকসজ্জা, যা কেবল চোখে দেখলেই বিশ্বাস করা যায়।

নদীর পাড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গল্প করছেন, কেউ কেউ শরীর চর্চা করছেন, কেউ কেউ হয়তো নদীর কাছে জীবনের গল্প বলছেন, আবার কেউ কেউ হয়তো এখানে দাঁড়িয়ে তার জীবনের হারানো স্মৃতিকে খুঁজে ফিরছেন। হয়তো হাজার রকমের ঘটনার সাক্ষী হয়ে নীরবে বয়ে চলেছে এই নদীটি।

নদীর দু'পারের আলোকসজ্জা নদীর পানিতে প্রতিফলিত হয়ে যেন পানির নিচে আরেকটি শহর তৈরি করছে। ওপরে বয়ে চলছে ছোট ছোট জাহাজ। তাতেও আলোকসজ্জা । দেখে মনে হয় রঙিন এক নদী, যা মনের গভীরে তৈরি করে বিশাল এক অবর্ণনীয় গল্প। আসলে চীন যে কতটা সুন্দর ও বৈচিত্র্যময় তা চীনের নানান শহর না দেখলে কেবল কল্পনাই থেকে যাবে। হয়তো কোনো কোনো দৃশ্য কল্পাকেও ছাড়িয়ে যায়। যেমন পার্ল রিভারের দৃশ্য। পার্ল রিভারের এই অপরূপ দৃশ্যকে সঙ্গে নিয়ে অবশেষে ক্লান্তি, রাত আর বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ফিরে আসি আমাদের হোটেলে।

পরদিন সকালে আমরা যাই কুয়াংচৌ কেন্দ্রীয় রেলওয়ে অফিসে। কুয়াংচৌ রেলপথ ব্যবস্থা সম্পর্কে সাক্ষাতকার নেওয়াটা আমাদের কর্মসূচির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলো।

কুয়াংচৌর দ্রুতগতির রেলপথ অঞ্চলটির উন্নয়নে এবং যাত্রীদের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে তা সাক্ষাতকারে জানতে চাওয়া হয়।

সাক্ষাতকার শেষ সুবর্ণা আপু এবং আমি গাড়িতে করে যাত্রা শুরু করি শহরের উপকণ্ঠে আরেকটি রেলওয়ে স্টেশনে। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর আমরা সেখানে পৌঁছাই। সেখানে কথা হয় একজন পরিবহন নেতা এবং একজন রেলওয়ে কর্মকর্তার সঙ্গে।

পরিবহন নেতা বলেন, এ অঞ্চলের রেলপথ চীনের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আগে কুয়াংচৌ থেকে ট্রাকে করে বিভিন্ন জায়গায় মালামাল পরিবহন করা হতো। এতে অনেক সময় দরকার হতো এবং খরচও ছিলো বেশি। এছাড়া এতে বাড়তি লোকের দরকার হতো এবং পরিবেশের জন্যও যা ছিলো ক্ষতিকর। কিন্তু রেলপথ চালু হবার পর সে সমস্যা এখন আর নেই। কারণ এখন ট্রেনে করে দ্রুত মালামাল পরিবহন করা যায়, বাড়তি লোকেরও প্রয়োজন হয় না এবং যা পরিবেশের জন্যও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি এতে একসাথে অনেক মালামাল পরিবহন করা যায়।

মালামাল পরিবহনে মালিকদের সাথে যোগোযোগ সম্পর্কে ওই রেলওয়ে কর্মকর্তা বলেন, বিভিন্ন স্থানের জন্য খরচ বিভিন্ন রকম এবং মালের পরিমাপ অনুযায়ী এ খরচ নির্ধারণ করা হয়। মালিকরা তাদেরকে সংশ্লিষ্ট মালামাল, স্থান, পরিমাণ ইত্যাদি বিষয় অবগত করেন এবং পরে তাদের সঙ্গে খরচ হিসেবে করে মালামাল পরিবহন করা হয়। এ ব্যবস্থা অতি চমত্কার। এতে খুব দ্রুত অনেক মালামাল বিভিন্ন জায়গায় পরিবহন করা যায়, যা জনগণের চাহিদা এবং অর্থনীতির উন্নয়নে অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

তাদের সঙ্গে কথা বলার পর আমরা মালামাল বহনকারী রেলগাড়ি এবং রেলওয়ে লাইন পরিদর্শন করি। সেখানে হাজার হাজার কন্টেইনার রাখা এবং পাশেই রেলগাড়ি এবং মালামাল পরিমাপের যন্ত্র। বড় বড় ক্রেন দিয়ে কন্টেইনারগুলোকে তারা পরিমাপ যন্ত্রে তুলছেন এবং মাপ শেষ তা রেলগাড়িতে পরিবহনের জন্য রাখছেন।

তাদের সঙ্গে কথা বলে এবং মালবাহী রেলগাড়িতে মালামাল পরিবহন সংক্রান্ত ব্যবস্থা দেখার পর আমরা রওয়ানা হই হোটেলের উদ্দেশে।

এর কিছুক্ষণ পর আমরা বেড়িয়ে পড়ি শহর দেখার জন্য। সুবর্ণা আপু বললেন, এখানে একটি দ্বীপ আছে, আমরা সেখানে যাবো। দ্বীপের কথা শুনে আমি খুব মুগ্ধ হয়ে উঠলাম। আমরা রওয়ানা হলাম দ্বীপ দেখার উদ্দেশে। সাবওয়ে করে আমরা দ্বীপের কাছে পৌঁছলাম।

এই দ্বীপটিকে বলা হয় 'শামিয়ান তা চিয়ে'। এর একপাশে পার্ল রিভার, অন্যদিকগুলোতে কৃত্রিমভাবে লেক তৈরি করা। চারপাশে পানি থাকার কারণেই হয়তো এটিকে দ্বীপ বলা হয়।

সুবর্ণা আপু জানালেন, একসময় ইউরোপীয়ানরা এখানে বাস করতেন। পরে তারা চীনের কাছে তা হস্তান্তর করেন। আসলে এ জায়গাটা দেখতে অন্যরকম। অন্যরকম এ কারণে যে, এখানকার দালানকোঠা, স্থাপত্য, ডিজাইন, রাস্তাঘাট সবকিছুই পশ্চিমা ধাঁচের। এখানকার সবকিছুকে চীনের মতো মনে হয় না।

এ জায়গাটি এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন এলাকা। এর ভিতরে রয়েছে সুন্দর বসার জায়গা, রয়েছে সুন্দর সুন্দর বৈচিত্র্যময় ভাস্কর্য, রয়েছে স্কুল, রয়েছে রেস্তোঁরা ও কফিশপ। লোকজন ভিতরে বসে গল্প করছেন, খেলাধুলা করছেন, শরীর চর্চা করছেন। অনেকে আবার ক্যামেরা নিয়ে এখানকার ছবি তুলছেন।

নদীর পাড় ঘেঁষে টেনিস কোট। ছোট বড় সবাই সেখানে টেনিস খেলছেন। আর নদীর পাড়ে মুক্ত বাতাসে অনেকে কুংফু চর্চা করছেন।

'শামিয়ান তা চিয়ে' ঘুরে দেখার পর আমরা রওয়ানা হই বিখ্যাত 'ক্যান্টন টাওয়ার' দেখতে।

'ক্যান্টন টাওয়ার' সুউচ্চ একটি টাওয়ার যা দেখলে জুড়িয়ে যায় চোখ, তৈরি হয় এক আশ্চর্য অনুভূতি। বিশাল উঁচু এই টাওয়ারটিতে রয়েছে রেস্তোঁরাসহ বিভিন্ন রাইড। এই টাওয়ারের উপর থেকে কুয়াংচৌর অনেক দৃশ্য দেখা যায়।

আমরা রাতের বেলা টাওয়ারটির কাছে পৌঁছাই। টাওয়ারটির পাশেই নদী। দেখে মনে হয়, টাওয়ার আর নদী যেন মিলেছে একে অপরের সাথে। পৃথিবীতে যতরকম আলোকসজ্জা আছে তার সবগুলো দিয়েই সাজানো হয়েছে এ টাওয়ারকে । এটি একটি যাদুর মতো। কখনও এ টাওয়ার হলুদ রং ধারণ করছে, কখনও নীল, কখনও লাল, কখনও বেগুনি, আবার কখনও লাল, নীল, বেগুনি সবগুলোই। একেক রঙে যখন টাওয়ারটি আলোকিত হয় তখন এটিকে দেখতে যাদুর মতো হয়। মনে হয় এখন বুঝি অন্য একটি টাওয়ার দেখছি। বিশাল উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ নিয়ে এই টাওয়ারটি গঠিত। পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন আর সাজানোগোছানো রাস্তাঘাট বয়ে চলেছে একে কেন্দ্র করে। অসংখ্য লোকজন এর প্রাঙ্গণে বসে থাকেন এর অপরূপ আলোকসজ্জা দেখার জন্য। বসে থাকেন এর ঝিলিমিলি রঙে নিজেদেরকে আলোকিত করবার জন্য। বসে থাকেন নিজেদের মনটাকে রাঙানোর জন্য। আবার কেউ কেউ হয়তো টাওয়ার আর পাশের নদীকে নিয়ে লেখেন কবিতা, গল্প, নাটক ও উপন্যাস।

আসলে আবারও চীনের প্রশংসা করতে হয়। আমার ধারণা প্রতিদিনই নতুন কিছু আবিষ্কার করে চলেছে চীন। আর তার প্রমাণ আমরা সবজায়গাতেই পাচ্ছি। যেমন পেয়েছি ক্যান্টন টাওয়ারে।

কুয়াংচৌ যাওয়ার আগে আমার এক সহকর্মী বলেছিলেন, সেখানে সে অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যময় কিছু খাবার আছে। এ খাবার অনেক সুস্বাদু। এই খাবার তারা সকালে খেতে বসেন এবং দুপুরে শেষ করেন। এটা শুনে একটু অবাক হয়েছিলাম আমি। কিভাবে এটা সম্ভব? সুবর্ণা আপুকে সে খাবারের কথা বলায় তিনি রাজি হয়ে গেলেন এবং আমাদেরকে পরের দিন সকালে সেখানে নিয়ে গেলেন। আমরা একটি এ বৈশিষ্ট্যময় খাবারের রেস্তোঁরায় গেলাম।

সত্যিই তাই । এখানে হরেক রকমের খাবার। সবাই বসে বসে খাচ্ছেন আর গল্প করছেন। সুবর্ণা আপু বললেন, মূলত যাদের বয়স একটু বেশি এবং যারা চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন তাদের বেশিরভাগই এখানে খেতে আসেন। কারণ এখানে এসে তারা সবাই মিলিত হতে পারেন এবং খাবার খেতে খেতে দীর্ঘ সময় নিয়ে গল্প করতে পারেন।

আমি সত্যিই এটা শুনে ভীষণ মুগ্ধ হয়ে যাই। কারণ আমার কাছে বয়স্কদের জন্য এটা একটি চমত্কার ব্যবস্থা। কারণ তারা এখানে এসে তাদের পুরনো সব বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে বসে গল্প করতে পারেন এবং চমত্কার সময় কাটাতে পারেন যা তাদের জীবনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

একসময় সুবর্ণা আপু বললেন কুয়াংচৌতে সিআরআইয়ের একটি শাখা অফিস আছে। আমরা সেখানে যাবো। আসলে আমি আগে জানতাম না যে, সিআরআইয়ের শাখা অফিস আছে। তার কথা শুনে অনেক ভালো লাগলো। তিনি বললেন সেই অফিসের গাড়ি আমাদেরকে এখান থেকে নিয়ে যাবেন। আমরা তখন গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম আর স্থানীয় বৈশিষ্ট্যময় খাবারের দোকানগুলো ঘুরে দেখতে শুরু করলাম।

একসময় সিআরআইয়ের গাড়ি আসলো। আমরা গাড়িতে করে সিআরআই শাখা অফিসের দিকে যাত্রা শুরু করলাম।

আঁকাবাঁকা ছোট পাহাড়ি পথের মধ্য দিয়ে আমাদের গাড়িটা একটা পার্কের ভিতর প্রবেশ করলো। ভীষণ শান্ত, নি:স্তব্দ ও নিরিবিলি পরিবেশ। সেখানে প্রবেশে অনেক বাধা-নিষেধ। সিআরআইয়ের কল্যাণেই হয়তো আমরা সেখানে যেতে পারলাম। আশ্চর্যের বিষয় হলো, ভিতরে গিয়ে দেখি এখানেই সিআরআইয়ের সেই শাখা অফিস।

আমি সিআরআইতে চাকরি করি, তাই স্বাভাবিকভাবেই সিআরআইয়ের শাখা অফিস দেখে ভীষণ আনন্দিত হয়ে উঠলাম। অফিস প্রাঙ্গণে বিশাল একটি টাওয়ার। জানতে পারলাম অনুষ্ঠান প্রচারসহ নানান কাজে এই টাওয়ার ব্যবহার করা হয়। এই টাওয়ার থেকে পুরো কুয়াংচৌ শহর দেখা যায়।

সিআরআই ভবন থেকে একজন সুদর্শন ভদ্রলোক বের হয়ে আমাদেরকে শুভেচ্ছা জানালেন। তিনিই এ শাখা অফিসের পরিচালক। কথা বলে বুঝলাম ভীষণ আন্তরিক ও অসাধারণ একজন ভালো মানুষ তিনি। তিনি আমাদেরকে নিজ হাতে চা বানিয়ে দিলেন। চা পান করতে করতে তার সঙ্গে আমরা গল্প করলাম। তিনি আমাদেরকে শাখা অফিসের নানান রুম ঘরে দেখালেন। শাখা অফিসের স্টুডিওতে নিয়ে গেলেন। খুবই উন্নত স্টুডিও। আধুনিক সব যন্ত্রপাতি। সেখানে আমরা তার সঙ্গে ছবি তুললাম। এরপর তিনি আমাদেরকে টাওয়ারের উপরে নিয়ে গিলেন।

লিফটে করে আমরা টাওয়ারে উঠলাম। টাওয়ারে উঠে প্রথমে আমি খুব ভয় পাচ্ছিলাম। এত উঁচু। সেখান থেকে মনে হয় পুরো কুয়াংচৌ শহরকে দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার বিশ্বাসই হচ্ছিলো না যে আমি এত উপরে দাঁড়িয়ে আছি। সত্যিই ভীষণ রোমাঞ্চকর । উপর থেকে শহরের সুউচ্চ দালানকোঠা, রাস্তাঘাটগুলোকে ছোট ঘরের মতো মনে হচ্ছিল। সেখানে কিছুক্ষণ থেকে আমরা নিচে নেমে আসলাম।

সিআরআইয়ের শাখা অফিসের ওই পরিচালক আমাদেরকে বিদায় জানালেন। তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সিআরআইয়ের গাড়িতে করে আমরা চলে গেলাম 'ফাইভ গোটস স্ট্যাচু' দেখতে।

যার কথা শুরুতেই উল্লেখ করেছি, সুবর্ণা আপু অনেক আগে একবার সেখানে গিয়েছিলেন।

গাড়ি থেকে নেমে বেশ কয়েকটা ধাপ সিঁড়ি বেয়ে আমরা উপরে উঠলাম, যেখানে 'ফাইভ গোটস স্ট্যাচু' অবস্থিত।

অসাধারণ একটি শৈল্পিক স্ট্যাচু এটি। আমি ভীষণ মুগ্ধ, অভিভূত এই স্ট্যাচু দেখে। পাঁচটি ছাগল নিয়ে এই স্ট্যাচু তৈরি। একটি বড় ছাগল মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আর অন্য চারটি ছাগল এই বড় ছাগলটিকে কেন্দ্র করে রয়েছে। একটি ছোট ছাগল দুধ খাচ্ছে, অপরগুলো পাশে ঘাস খাচ্ছে। একটি পরিবারের মতো সবাই একসঙ্গে মিলেমিশে রয়েছে। বড় ছাগলটি যেন পরিবারের কর্তার মতো বাইরে খেয়াল রাখছে যেন কেউ তাদের আক্রমণ করতে না পারে। আমার দৃষ্টিতে, মূলত জীবনের এক গভীর দর্শন ফুটে উঠেছে এই স্ট্যাচুতে।

'ফাইভ গোটস স্ট্যাচু' দেখা শেষ করে আমরা চলে যাই একটি পুরেনো এলাকায়। যে এলাকাটি পেইচিংয়ের হুথোং এর মতো।

সেখানে রাস্তার ধারে ছোট ছোট খাবারের হোটেল ও বিভিন্ন দোকান। আমরা একটি হোটেলের সামনে একেবারে প্রাকৃতিক পরিবেশে, ছায়াঘেরা রাস্তায় বসে খাবার খেলাম; সেখানকার বৈশিষ্ট্যময় খাবার। এরপর রাস্তার বিভিন্ন দোকান ঘুরে আমরা রওয়ানা হলাম আমাদের হোটেলের দিকে।

পরের দিন সকালে আমরা বের হলাম 'পেইচিং লু' দেখতে। খুবই সুন্দর। সাজানোগোছানো রাস্তা। দু'পাশে নানান ধরনের জামাকাপড়ের দোকান। আমরা জামাকাপড়ের দোকানগুলো ঘুরে দেখে তাড়াতাড়ি হোটেলে ফিরলাম। কারণ আমাদেরকে সেদিনই শেনচেন শহরে যেতে হবে।

হোটেল থেকে লাগেজ নিয়ে সাবওয়েতে করে চলে গেলাম রেলওয়েস্টেশনে। এবার গন্তব্য শেনচেন শহর।

এখানে উল্লেখ করেত চাই, পুরো কুয়াংচৌ শহরে গাড়ির পাশাপাশি যাতায়াতের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হচ্ছে সাবওয়ে বা মেট্রো । পুরো শহর জুড়ে সাবওয়ে লাইন। খুবই পরিস্কার, পরিচ্ছন্ন এবং অনেক প্রশস্ত সাবওয়েস্টেশনগুলো। বড় স্টেশনগুলোতে খুব সহজেই এই সাবওয়েতে করে যাওয়া যায়।

আমরা যখন শেনচেন যাওয়ার জন্য বড় স্টেশনে পৌঁছলাম তখন দেখি সেখানে অনেক যাত্রী। সবাই বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছেন আসছেন।

কুয়াংচৌ থেকে দ্রুতগতির ট্রেনে শেনচেন যেতে মাত্র ৩০ মিনিট সময় লাগে। আমরা যে ট্রেনটিতে গিয়েছিলাম তাতে আমাদের সময় লেগেছিল এক ঘণ্টা। চারপাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন যে সময় শেষ হয়ে গিয়েছিলো তা বুঝতেই পারিনি।

আমরা জানি, একটি দেশের উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বলা হয়ে থাকে, যেদেশের বা যেখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা যত ভালো সে দেশ তত উন্নত।

আমার প্রায় দু'বছরের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, চীনের উন্নয়নে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে দেশটির যোগাযোগ ব্যবস্থা। বিশাল এই দেশটিতে যোগাযোগে রেলপথ একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।

এই রেলপথ জনগণের জীবনে বয়ে এনেছে সীমাহীন সুযোগ সুবিধা। এই রেলপথের কারণেই তারা দ্রুত বিভিন্ন জায়গায় যেতে পারছেন।

বলতে পারি, যারা কুয়াংচৌ থাকেন তারা মাত্র ৩০ মিনিট সময় ব্যয় করে শেনচেন গিয়ে তাদের প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে আবার কুয়াংচৌতে ফিরতে পারেন। তেমনি যারা শেনচেনে থাকেন তারাও এরকম করতে পারেন।

এক কথায় বলতে পারি, এ অঞ্চলের দ্রুতগতির ট্রেন ছাত্র-শিক্ষক, কর্মচারি, কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের জনগণের জন্য বয়ে এনেছে এক বিরাট সুযোগ। তাদের জীবনকে করেছে অনেক সহজ ও সুন্দর। সেই সঙ্গে ঘনবসতিমুক্ত জীবনযাপনে শহরের মধ্যে তৈরি করেছে ভারসাম্য।

আমার দৃষ্টিতে শেনচেন কুয়াংচৌ শহরের চেয়ে আরও ব্যস্ত আরও বাণিজ্যিক একটি শহর। হংকংয়ের খুব কাছে এই শহরটি অবস্থিত। অনেক আধুনিক অনেক পরিকল্পিত একটি শহর শেনচেন। পুরো শহর জুড়ে সুউচ্চ দালানকোঠা। বলা হয়ে থাকে শেনচেন হলো ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতির শহর। আসলে তাই। আমরা শেনচেন শহরের কয়েকটি মার্কেট ঘুরে দেখেছি। সেখানে ইলেকট্রনিক্স জগতের এমন কিছু নেই যা পাওয়া যায় না। অসংখ্য বিদেশি চোখে পড়েছে আমাদের। যারা ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য প্রতিনিয়ত এই শহরটিতে আসেন। সেখানে শ্রীলংকার একজন ব্যবসায়ী আমাদের জানান, তিনি ত্রিশ বছর ধরে এই শহরটিতে বাস করছেন। তিনি ব্যবসার সাথে যুক্ত। তিনি বলেন, চীনের ব্যবসা-বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর হলো শেনচেন।

আসলে আমাদের সংক্ষিপ্ত সফরে আমাদের কাছেও তাই মনে হয়েছে। প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত শহরের রাস্তার দোকানপাটগুলোকে আমরা ব্যস্ত দেখেছি। দেখেছি অসংখ্য বিদেশি এখান থেকে তাদের জিনিসপত্র কিনছেন। নি:সন্দেহে বলা যায়, চীনের ব্যবসা-বাণিজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ শহর হলো শেনচেন।

২৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে আমরা শেনচেন বিমানবন্দরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি। শহর থেকে প্রথমে সাবওয়ে, তারপর বাসে চড়ে পৌঁছাই বিমানবন্দর। চমত্কার আকর্ষণীয় বিমানবন্দর হলো শেনচেন বিমানবন্দর। বিশাল উন্মুক্ত জায়গাজুড়ে এই বিমানবন্দরটি অবস্থিত। চারপাশে নেই কোনো শহরের কোলাহল, নেই কোনো যানজট। বিমানবন্দরের যাত্রী ছাড়া আর তেমন লোকের আনাগোনা এখানে নেই । হাজার হাজার যাত্রীরা এখানে আসা যাওয়া করছেন।

একেবারে আধুনিক বিমানবন্দর বলতে যা বোঝায় তার পুরোটাই এই বিমানবন্দর। দূর থেকে দেখে সাদা চকচকে একটি আকাশের মতো মনে হয়। পুরো বিমানবন্দরটি ঝকঝকে পরিস্কার। সাদা রঙের ছাদ আর লাইটগুলো এতে যুক্ত করেছে আরও আকর্ষণ, আরও সৌন্দর্য। ভিতরটা অনেক বেশি খোলামেলা। সেখানে যাত্রীদের জন্য আছে বেশ কিছু রেস্তোঁরা এবং দোকানপাট। কেউ কেউ বসে খাবার খেয়ে নিচ্ছেন, কেউ বা দীর্ঘযাত্রার ক্লান্তি দূর করার জন্য বিশ্রাম নিচ্ছেন। আবার কেউ বা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনছেন। সুশৃঙ্খল নিয়মের মধ্য দিয়ে যাত্রীরা ছুটে চলেছেন তাদের গন্তব্যে।

আমি অবাক দৃষ্টিতে বিমানবন্দরটির সৌন্দর্য দেখছিলাম। আগে আমি বেশকিছু বিমানবন্দর দেখেছি, কিন্তু শেনচেন বিমানবন্দরের সৌন্দর্য সেসব বিমানবন্দরকে ছাপিয়ে গেছে।

উন্মুক্ত এক খোলা মাঠে অপরূপ আধুনিকতার ছাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শেনচেন বিমানবন্দর, তা যেন এ শহরের বিশেষ বৈশিষ্ট্যই তুলে ধরছে। বিমানবন্দরের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে আমরা বিমানে উঠে বসলাম। এবার যাত্রা পেইচিং।

সবশেষে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি আমার এ লেখা শেষ করতে চাই। ধন্যবাদ সিআরআই বাংলা বিভাগকে আমাকে এ সুযোগ দেওয়ার জন্য। ধন্যবাদ সাদিশা ও দিলশানকে। আর আমার অন্তরের গভীর থেকে অকৃত্রিম শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই সিআরআই বাংলা বিভাগের পরিচালক ম্যাডাম ইয়ু কুয়াং ইয়ুকে এবং উপ-পরিচালক ছাওইয়ানহুয়া সুবর্ণাকে। (এনামুল হক টুটুল)

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
Play
Stop
ওয়েবরেডিও
বিশেষ আয়োজন
অনলাইন জরিপ
লিঙ্ক
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040