0923
|
পিং সিয়াং ও ভিয়াতনামের মধ্যে ব্যবসার ইতিহাস অনেক পুরাতন। ১০০০ বছর আগের চীনের সুং রাজবংশ আমল থেকে পিং সিয়াং ছিল চীন–ভিয়াতনাম সীমান্ত বাণিজ্য কেন্দ্র এবং দক্ষিণ রেশমপথের গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা।
পিং সিয়াং শহরে ফু চাই ছিল ছোট একটি গ্রাম এবং গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকে আসিয়ান বাণিজ্য উন্নয়নের সুযোগ ধরে এটি সমৃদ্ধ হয় এবং একটি বন্দরে পরিণত হয়। সেপ্টেম্বর মাসে, ফু চাইতে আবহাওয়া মেঘমুক্ত।
সীমান্তে চীনের দিকে একটি ছোট চত্বরে কয়েকজন ভিয়াতনামি নারী ফল বিক্রয় করছেন। পর্যটক ও ব্যবসায়ীরা মাঝে মাঝে তাদের কাছ থেকে ফল কিনছেন। ইউয়ুন এ সি নামে একজন ভিয়াতনামি নারী জানান, ২০ বছর বয়স থেকে তিনি ফু চাই বন্দরে ব্যবসা শুরু করেন এবং তার বয়স এখন ৩৭ বছর। তিনি বলেন, বন্দরে সুযোগ-সুবিধা আছে। তাই এক ঝুড়ি ফল ভিয়াতনাম থেকে এনে চীনে বিক্রয় করলে তার দশ-বারো ইউয়ান লাভ হয়। কৃষিকাজের বাইরে এটা তার অতিরিক্ত দু'টো পয়সা আয়ের উত্স। গত কয়েক বছরে ফু চাইয়ে কী কী পরিবর্তন ঘটেছে জানতে চাইরে ইউয়ুন এ সি বলেন, তার চোখের সামনেই এখানে উঠেছে উঁচু উঁচু ভবন; সুন্দর হয়েছে বন্দরটিও। বন্দরের মাধ্যমে দু দেশের মধ্যে আসা-যাওয়া আরও সুবিধাজনক হয়েছে।
ফু চাই এখন চীন ও আসিয়ানের মধ্যে বৃহত্তম ফল বিনিময় বাজার। পিং সিয়াং বাণিজ্য বিভাগের পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, প্রতি বছর আসিয়ান থেকে চীনে আমদানিকৃত ফলের তিন ভাগের এক ভাগই আসে ফু চাইর মাধ্যমে। আবার এর মাধ্যমে চীন থেকে ভিয়াতনামে যে পরিমাণ ফল রফতানি হয়, তা আসিয়ানে চীনের রফতানিকৃত মোট ফলের ২৫ শতাংশ। ২০ বছর আগে, ফু চাই ছিল দশ-বারো পরিবারের ছোট একটি সীমান্ত গ্রাম। চীন-আসিয়ান বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার সাথে সাথে চীনা ছুয়াং সংখ্যালঘুজাতির মানুষের এ গ্রাম এখন বিশ্বের বিভিন্ন ব্যবসায়ীর পদভারে মুখরিত। পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, প্রতিদিন গড়ে ৬৫০০ জন মানুষ ফু চাইর মাধ্যমে আসা-যাওয়া করে। কোনো কোনো দিন ১০ হাজার মানুষও যাতায়াত করে। তা ছাড়া, ট্রাক যাতায়াত করে কয়েক হাজার করে।
ফু চাইর উন্নয়ন চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ব্যবসায়ীদের জন্য বড় সুযোগ এনে দিয়েছে। পিং সিয়াং ফু চাই বন্দর বাজারে রয়েছে 'ই সিন' নামে একটি দোকান। এ দোকানে বিক্রি হয় ভিয়াতনামের Aquilaria। দোকানের মালিক ছেন মেই কুই একজন ভিয়াতনামি নারী। তার বাসা পিং সিয়াং থেকে ২০০০ কিলোমিটার দূরে। তবে এখানে তিনি ৪-৫ বছর ধরে ব্যবসা করছেন। তার চীনা ভাষা খুব ভাল এবং তার ব্যবসাও দিন দিন সমৃদ্ধ হচ্ছে। তিনি বললেন, "আমি Aquilaria বিক্রয় করি এবং আমার ক্লায়েন্টদের অধিকাংশই চীনা মানুষ। পেইচিং ও সাংহাইয়ে আমার ক্লায়েন্ট আছে এবং তাদের চাহিদা অনুযায়ী আমি তাদের Aquilaria সরবরাহ করি। প্রতি মাসে দশ-বারো হাজার ইউয়ান লাভ হয় আমার। "
ছেন মেই কুই শুধু ফু চাইতে ব্যবসা করেন তা নয়। তার স্বামী ভিয়াতনামি মানুষ। দুজন এখন ফু চাইতে সংসার পেতে বসেছেন। তার স্বামী এখন চীনা ভাষা শিখছেন। আর ছেন মেই কুই ব্যবসা করতে করতে নিজে নিজে চীনা ভাষা শিখেছেন। তিনি বললেন, ব্যবসা করার জন্য মনের দিগন্ত প্রসারিত হওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। যদিও তিনি ফু চাইতে ব্যবসা করেন তবে আসিয়ান প্রদর্শনীতে অংশ নেয়ার জন্য তিনি মাঝে মাঝে কুয়ান সি প্রদেশের রাজধানী নান নিং শহরে যান।
পিং সিয়াংতে ছেন মেই কুইর মত চীন-ভিয়াতনাম সীমান্ত ব্যবসায়ীরা দ্রুত অর্থ উপার্জন করছেন। পিং সিয়াং চীনের লাল রঙের পেড়ের শহর। ২০১২ সাল পর্যন্ত একটানা ৬ বছর চীনে বৃহত্তম লাল রঙের পেড়ের আসবাবপত্র আমদানির শহর ছিল পিং সিয়াং এবং বিনিময়ের পরিমাণ ছিল ৩০০ কোটি ইউয়ানের বেশি।
লিউ এন নিং পিং সিয়াং নানা সান উন্নয়ন এলাকার রুই সি ক্র্যাফট বাজারে একজন যুব ব্যবসায়ী। পেং সিয়াংতে আসার পরবর্তী ৬ বছরে তিনি একজন শিক্ষানবিস থেকে একজন ব্যবস্থাপকে পরিণত হন। এখন তার আছে নিজের দোকান ও ব্যবসা। লিউ এন নিং বলেন, "আমার দোকানে রয়েছে নানা রকমের কাঠ। অনেক বড় আসবাবপত্রের দোকানেও আমার মত এত বেশি ধরনের কাঠের সংগ্রহ নেই। আফ্রিকা, লাওস ও ভিয়াতনামসহ নানা দেশ থেকে আমদানি করা কাঠ আছে আমাদের। বন্দর আমার ব্যবসার জন্য অনেক সুবিধা ও সুযোগ সৃষ্টি করেছে। বর্তমানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো থেকে চীনে আমদানি করা সব কাঠ পিং সিয়াং ও তুং সিং বন্দরের মাধ্যমেই চীনে প্রবেশ করে।"
২০০৮ সালে চীন সরকার পিংসিয়াংতে প্রতিষ্ঠা করে কুয়াং সি পিং সিয়াং সার্বিক শুল্কমুক্ত এলাকা। এটাও চীনে প্রথম স্থল সীমান্তে প্রতিষ্ঠিত সার্বিক শুল্কমুক্ত এলাকা। এখানে বন্দর, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, শুল্কমুক্ত পণ্য স্থানান্তরসহ নানা সুবিধা পাওয়া যায়। এখানে চীনে সবচে' বেশি সুযোগ-সুবিধার নীতি ভোগ করতে পারেন ব্যবসায়ীরা।
চলতি বছর সিং ইয়ুন থুং Electronic Co., Ltd কুয়াং সি পিং সিয়াং সার্বিক শুল্কমুক্ত এলাকায় আসে। কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক চুও তুং ছিং বলেন, "পিং সিয়াং চীনে বৃহত্তম স্থলবন্দর এবং আমাদের প্রধান ক্লায়েন্ট ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মানুষ। ভবিষ্যতে ভিয়াতনামে আমাদের বাজার প্রসারিত করতে চাই। এখানে ব্যবসা করলে ব্যয় কম হয়।"
'এক অঞ্চল, এক পথ' কৌশলের প্রভাবে পিং সিয়াংতে পণ্য স্থানান্তর, আমদানি ও রফতানির পরিমাণ বিপুল মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে পিং সিয়াং বন্দর দিয়ে আমদানি ও রফতানি হয়েছে ৬৭৭ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২০ শতাংশ বেশি। আর এসময় এখানে শুল্কমুক্ত ব্যবসার পরিমাণ ছিল ১৩৪ কোটি মার্কিন ডলারের, যা গত বছরের একই সময়ের ৪৯ গুণ। ব্যবসা বৃদ্ধির বিচারে চীনের ৩০টি শুল্কমুক্ত এলাকার মধ্যে পিং সিয়াংয়ের অবস্থান দ্বিতীয়।
পিং সিয়াং বন্দরে দাঁড়িয়ে দেখা যায় চীনা লাল রঙের ট্রাক ও ভিয়াতনামি সাদা রঙের ট্রাকের আনাগোনা। একদা যেটি ছিল ছোট একটি গ্রাম, সেই পিং সিয়াং এখন আন্তর্জাতিক সংযোগস্থলে পরিণত হয়েছে।