0930
|
জিম্বাবুয়ের এমন কোনো মোবাইল ফোনের দোকান নেই যেখানে চীনের হুয়া ওয়ের মোবাইল সেট পাওয়া যায় না। রাস্তায় চলতে গেলে প্রায়ই শোনা যায় হুয়া ওয়ে ফোনের বিশেষ রিংটোন। জিম্বাবুয়ের মানুষের মধ্যে অ্যাপেলের চেয়ে হুয়া ওয়ের স্মার্টফোন বেশি জনপ্রিয়। প্রুনি একজন অফিস সহকারী। তিনি আগে অ্যাপেলের স্মার্টফোনের অনুরাগী ছিলেন। তবে হুয়া ওয়ে ফোন ব্যবহার করার পর তার ধারণা পাল্টেছে। তিনি বলেন, "হুয়া ওয়ে ফোনের ব্যাটারি খুব ভাল। জিম্বাবুয়েতে মাঝে মাঝেই বিদ্যুত্ বিভ্রাট ঘটে বলে আমরা সবসময় ব্যাটারি চার্জ করতে পারি না। তাই আমি চাই, একবার চার্জ দিলে যেন আমার ফোনটি সারাদিন সচল থাকে। হুয়া ওয়ে ফোন সকালে চার্জ দিলে পরের দিন পর্যন্ত আর চার্জ দিতে হয় না।"
এটা সত্যি যে, জিম্বাবুয়ের মানুষ মোবাইল সেট কেনার আগে চিন্তা করে এর ব্যাটারির চার্জধারণ ক্ষমতা সম্পর্কে। ভাল ব্যাটারি তাদের প্রথম শর্ত। অন্য ব্র্যান্ডের স্মার্টফোনের চেয়ে হুয়া ওয়ের ফোনের ব্যাটারির চার্জধারণ ক্ষমতা বেশি। তা ছাড়া, এর ব্রান্ডের ফোনের দামও ক্রেতাদের কাছে গ্রহণযোগ্য। জিম্বাবুয়ের সাধারণ মানুষের গড় মাসিক আয় ৩০০ মার্কিন ডলার। আর সেখানে হুয়া ওয়ের সবচেয়ে সস্তা স্মার্টফোনের দাম মাত্র ৬০ মার্কিন ডলার।
১৯৯৮ সালে হুয়া ওয়ে কোম্পানি জিম্বাবুয়েতে প্রবেশ করে। বিগত ১৭ বছর ধরে কোম্পানিটি দেশটিতে ব্যবসা করছে। মোবাইফোনের আগে, হুয়া ওয়ের প্রধান ব্যবসা ছিল মোবাইল ইন্টারনেট সুবিধা সরবরাহ করা। ২০১২ সালে, আফ্রিকায় স্মার্টফোনের চাহিদা মেটাতে, হুয়া ওয়ে শুরু করে নতুন এ ব্যবসা। জিম্বাবুয়েতে হুয়া ওয়ে জনসংযোগ ব্যবস্থাপক লাই সিয়াও হাই বলেন, "বিশ্বব্যাপী শিল্পোন্নত দেশগুলো সাধারণ ফোন থেকে স্মার্টফোন যুগে প্রবেশ করে অনেক আগেই। কিন্তু আফ্রিকায় এ পরিবর্তন ঘটছে ধীর গতিতে। এখানে অধিকাংশ মানুষ সাধারণ মোবাইফোন ব্যবহার করে। স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা মাত্র ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। হুয়া ওয়ের জন্য এটি একটি বড় বাজার।"
তবে হুয়া ওয়ে স্মার্টফোনের জিম্বাবুয়ের বাজারে প্রবেশ সহজ ব্যাপার ছিল না। লাই সিয়াও হাই জানালেন, তাদের আগেই এ বাজারে অ্যাপেল ও স্যামসাং প্রবেশ করে। তিনি বলেন, "স্মার্টফোন ব্যবসায় আমাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাপেল ও স্যামসাং। আমরা এ বাজারে দেরিতে প্রবেশ করেছি; এর মানে আমাদের অভিজ্ঞতাও কম। তবে বিগত কয়েক বছরে আমরা এ ব্যবধান কমিয়ে আনার চেষ্টা করেছি। হুয়া ওয়ের নতুন 'mates' স্মার্টফোন বিশ্বমানের হয়েছে। তা ছাড়া, টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক নির্মাণ খাতে হুয়া ওয়ের বেশ কয়েক বছরের অভিজ্ঞতার কারণে, আমাদের ফোন তুলনামূলকভাবে ভালো সিগন্যাল গ্রহণ করতে পারে।"
লাই সিয়াও হাই বলেন, হুয়া ওয়ে পণ্যের মান উন্নয়নের জন্য প্রতিবছর গবেষণা খাতে বিপুল বিনিয়োগ করে। নতুন প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী পণ্যের প্রচারও চালায় হুয়া ওয়ে। বিশেষ করে জিম্বাবুয়ের মানুষের সর্বশেষ চাহিদার ওপর গুরুত্বারোপ করে কোম্পানি। আয় বেশি না-হলেও, নতুন পণ্যের প্রতি দুর্বলতা আছে জিম্বাবুয়ের মানুষের। তারা ফুটবল ও সেলফি অনেক পছন্দ করে। জিম্বাবুয়ের রাজধানী হারারের একটি হুয়া ওয়ে দোকানে রিটুনডো স্মার্টফোন কিনতে এসেছেন। তিনি জানালেন, তার প্রিয় ফুটবল দলটিকে স্পন্সর করছে হুয়া ওয়ে। তাই তিনি একটি হুয়া ওয়ে ফোন কিনতে আগ্রহী। তা ছাড়া, হুয়া ওয়ে তার ছবি তোলার শখও পূরণ করতে চান। তিনি বললেন, "আমি একজন ফুটবল অনুরাগী। হুয়া ওয়ে ফোনের মাধ্যমে আমি সবসময় আমার প্রিয় ফুটবল দলের সর্বশেষ খবর পেতে পারি। তা ছাড়া, হুয়া ওয়ে স্মার্টফোনের ক্যামেরাটি ভালো। আমার ছবি তোলার শখটিও এ ক্যামেরা ভালোভাবেই পূরণ করতে পারবে বলে আশা করি। '
দোকানের মালিক কারিউ জানান, প্রতি মাসে তিনি গড়ে ১০০০টি হুয়া ওয়ে ফোন বিক্রয় করে থাকেন। জিম্বাবুয়ের মানুষ স্মার্টফোন পছন্দ করে। কিন্তু স্মার্টফোনের দাম একবারে পরিশোধ করার ক্ষমতা অনেকেরই নেই। এ সমস্যা সমাধানের জন্য কারিউ কিস্তি-সেবা দেওয়া শুরু করেছেন। তিনি বলেন, "অধিকাংশ ক্রেতাই নগদ অর্থ দিয়ে ফোন কিনে থাকেন। তবে কেউ কেউ কিস্তিতে ক্রয় করতে পছন্দ করেন। তাই আমরাও ব্যাংক ও ঋণদাতা কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা করেছি। কোনো ক্রেতা কিস্তিতে আমাদের পণ্য ক্রয় করতে চাইলে ব্যাংক বা ঋণদাতা কোম্পানির কাছে আবেদন করতে পারেন। এভাবে ক্রেতা তার পছন্দের ফোনটি কিনতে পারেন। এ ব্যবস্থায় আমাদের ঝুঁকিও কম।"
এখন জিম্বাবুয়েতে রয়েছে মাত্র একটি হুয়া ওয়ে মোবাইফোন বিক্রয়কেন্দ্র। তবে দোকানটি অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ায় চলতি বছরের শেষ নাগাদ আরও ৫টা বিক্রয়কেন্দ্র খোলা হবে। শুরুর দিকে হুয়া ওয়ে মোবাইলসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে স্মার্টফোন বিক্রয়ের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সে চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। জিম্বাবুয়েতে হুয়া ওয়ে মোবাইফোন বিষয়ক মহা-ব্যবস্থাপক ইয়াং সেন এ প্রসঙ্গে বলেন, "প্রথমে আমরা মোবাইলসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে আমাদের পণ্য বিক্রির চেষ্টা করি। কিন্তু অচিরেই আমরা বুঝতে পারলাম, আমাদের পণ্যের ব্রান্ড পরিচিতের জন্য উন্মুক্ত বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে হবে। উন্মুক্ত বাজার বৃহত্তম বাজার এবং এ বাজারের মাধ্যমেই কেবল নিজস্ব ব্র্যান্ড তৈরি করা সম্ভব। স্যামসাংসহ অন্যান্য কোম্পানি এ উপায়েই জিম্বাবুয়েতে নিজেদের অবস্থান সৃষ্টি করেছে।"
বর্তমানে হুয়া ওয়ে স্থানীয় শতাধিক দোকানের সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে মোবাইল ফোন বিক্রি করছে। তার মানে, জিম্বাবুয়ের বিখ্যাত মোবাইলফোন মার্কেট ও সুপারমার্কেটগুলোতে হুয়া ওয়ে ফোন বিক্রি হচ্ছে। সেখান থেকেই এ ফোনসেট কিনতে পারছেন ক্রেতারা। এ জন্য তাদেরকে হুয়া ওয়ের বিক্রয়কেন্দ্রে যেতে হচ্ছে না।
জিম্বাবুয়ে হুয়া ওয়ে জনসংযোগ ম্যানেজার লাই সিয়াও হাই মনে করেন, জিম্বাবুয়েতে হুয়া ওয়ের উন্নয়ন নির্ভর করে স্থানীয়করণের ওপর। জিম্বাবুয়ে হুয়া ওয়ে কোম্পানির কর্মীদের ৬০ শতাংশই স্থানীয় মানুষ। তারা স্থানীয় পরিবেশ, নীতি ও বিক্রয় চ্যানেলের সঙ্গে পরিচিত এবং স্থানীয় বাজারের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হুয়া ওয়েকে সাহায্য করতে পারে। লাই সিয়াও হাই বলেন, "জিম্বাবুয়েতে হুয়া ওয়ের স্থানীয়করণ হার ৬০ শতাংশ। আমাদের Subcontractorও স্থানীয় কোম্পানি। বেজ স্টেশন নির্মাণ ও সরঞ্জাম ইনস্টলেশন করতে চাইলে স্থানীয় কোম্পানির সঙ্গে সহযোগিতা প্রয়োজন। আমাদের কোম্পানি একটি বিশেষ প্রকল্প চালু করেছে। এ প্রকল্পের আওতায় আমরা স্থানীয় মানুষকে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত করি। তারা ভবিষ্যতে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবেন।"
Internet Data Center-এর ২০১৪ সালে প্রকাশিত উপাত্ত অনুযায়ী, ২০১৪ সালে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বাজারে হুয়া ওয়ের অনুপাত ছিল ৮.৯ শতাংশ। অন্যভাবে বললে এই দুটি বাজারের চীনা এই কোম্পানির অবস্থান দ্বিতীয়। নেটওয়ার্ক ট্রাফিক বিশ্লেষণ কোম্পানি start counter-এর পরিসংখ্যান অনুয়ায়ী, ২০১৪ সালে জিম্বাবুয়ের মোবাইলফোন বাজারে হুয়া ওয়ের অনুপাত অ্যাপেলকে ছাড়িয়ে তৃতীয় স্থানে দাঁড়ায়। আসলে হুয়া ওয়ে মোবাইলফোনের বিক্রির পরিমান আরও বেশি। কারণ, সিঙ্গাপুর, হংকং ও দুবাই থেকে চোরাচালান হয়ে আসা হুয়া ওয়ে ফোনও বিক্রয় হয় জিম্বাবুয়েতে। ২৫ শতাংশ শুল্ক ও ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর দিতে হয় না বলে এই চোরাচালানকৃত ফোনের দাম পড়ে অনেক কম। এ সমস্যা সমাধানের জন্য হুয়া ওয়ে কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। হুয়া ওয়ে কর্মকর্তা ছাং হং লি বলেন, "আমরা হুয়া ওয়ে বিক্রয়কেন্দ্রের পরিবেশ উন্নত করার চেষ্টা করছি, সেবার মান বাড়ানোর চেষ্টা করছি। এ ছাড়া, আমরা ২০১৩ সাল থেকে এক বছরের বিনামূল্যে মেরামতসেবা প্রদান শুরু করেছি।"
শুধু তাই নয়, যারা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত, তাদের হুয়া ওয়ে ভালো অফার দিয়ে চোরাচালান থেকে বিরত রাখার চেষ্টাও করছে। তাদের বলা হচ্ছে, কোম্পানির সঙ্গে সহযোগিতা করলে তাদেরকে বৈধ উপায়েই ভাল লাভ দেওয়া হবে।
চোরাচালান ছাড়াও হুয়া ওয়ের জন্য অন্য একটি চ্যালেঞ্জ হল জিম্বাবুয়ের মন্থর অর্থনীতি ও অস্থিতিশীল নীতি। এ প্রসঙ্গে লাই সিয়াও হাই বলেন, "বিশ্বায়নের এ যুগে একটি কোম্পানি হিসেবে আমাদের উদ্দেশ্য হল, বিশ্বের প্রতিটি দেশ ও অঞ্চলে নিজেদের ব্রান্ডকে পরিচিত করে তোলা। স্থানীয় মানুষের সঙ্গে যৌথভাবে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা খুব প্রয়োজন। আমরা বিশ্বাস করি, যৌথ প্রচেষ্টা চালালে অবশেষে সব সমস্যা সমাধান করতে পারব।"