Web bengali.cri.cn   
 'ভি ডে' কুচকাওয়াজ
  2015-09-02 16:05:41  cri


৭০ বছর আগে, ১৪ বছরের রক্তাক্ত যুদ্ধ শেষ করে, চীনা জনগণ জাপানি আগ্রাসনবিরোধী যুদ্ধে জয়লাভ করে। চীনা জনগণ এ জয়ের স্মৃতি কখনও ভুলে যাবে না।

বিশ্বে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল চীনে। আসলে চীনে জাপানি আগ্রাসনের মাধ্যমেই শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ফ্যাসিবাদবিরোধী যুদ্ধের এ অংশটুকু চলেছে সবচে' দীর্ঘ সময় ধরে। ১৯৩১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু করে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত জাপানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে চীন একাই লড়ে গেছে। জাপানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ১৪ বছরের যুদ্ধে সাড়ে তিন কোটি চীনা মানুষ হতাহত হয়েছেন। এসময় চীনের সরাসরি আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৬০,০০০ কোটি মার্কিন ডলার।

চীনের মাটিতে জাপানি সমরশক্তির একটা উল্লেখযোগ্য অংশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গোটা সময়কাল ধরে ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল। সুতরাং এ কথা বলা যেতে পারে যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ে চীনের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধে চীন এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ একটি বেস হিসেবে মিত্রশক্তির দেশগুলোকে প্রচুর কৌশলগত সামগ্রী ও সামরিক গোয়েন্দাতথ্য সরবরাহ করেও সাহায্য করেছে।

জাপানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে চীনের জনগণের যুদ্ধ ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের যুদ্ধ। এ যুদ্ধ ছিল ফ্যাসিবাদবিরোধী যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ ছাড়া, এ যুদ্ধের মাধ্যমেই চীন সার্বিকভাবে মুক্তি অর্জন করে এবং নয়া চীন প্রতিষ্ঠার ভিত্তিও ছিল এই গণযুদ্ধ।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও বিশ্বের ফ্যাসিবাদবিরোধী যুদ্ধে চীনের অবদান স্বীকার করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের জেনারেল ভ্যাসিলি ইভানোভিচ চুইকভ বলেন,

'আমাদের সবচে কঠিন সময়ে, জাপান সোভিয়েত ইউনিয়নে আক্রমণ চালাতে পারেনি। তবে, জাপানি আক্রমণে গোটা চীন তলিয়ে গিয়েছিল।'

সাবেক বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল বলেন, 'দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে চীনকে পরাজিত করতে পারলে, জাপান তার বাহিনীর শক্তিশালী ২০টি ডিভিশনকে মিত্রবাহিনীর অন্যান্য দেশে মোতায়েন করতে পারতো।'

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট বলেছিলেন, দীর্ঘ সাতটি বছর চীন কীভাবে জাপানি আক্রমণ প্রতিরোধ করেছে এবং এশিয়ায় জাপানি আগ্রাসনকে সীমিত রাখতে সাহায্য করেছে, তা যুক্তরাষ্ট্র কখনও ভুলে যাবে না।

১৯৪৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর জাপান স্বাক্ষর করে আত্মসমর্পণের দলিলে। চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নসহ মিত্রদেশগুলোর কাছেই জাপান আত্মসমর্পণ করেছিল। জাপানের আত্মসমর্পণের পরবর্তী ৩ দিন গোটা চীনে আনন্দ-উত্সবের আয়োজন করা হয়েছিল। তারপর থেকে প্রতি বছরের ৩ সেপ্টেম্বর জাপানি আগ্রাসনবিরোধী যুদ্ধে বিজয়ের বার্ষিকী পালন করে আসছে চীন ও চীনে জনগণ। আর ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে চীনা জাতীয় গণ কংগ্রেসের স্থায়ী কমিটিতে ভোটের মাধ্যমে ৩ সেপ্টেম্বরকে জাপানি আগ্রাসনবিরোধী যুদ্ধে বিজয়ের স্মারক দিবস হিসেবে গ্রহণ করা হয়।

নয়াচীন প্রতিষ্ঠার পর ১৪ বার জাতীয় পর্যায়ে কুচকাওয়াজ আয়োজন করেছে চীন। তবে এবারে 'ভি ডে' কুচকাওয়াজ নানান দিক দিয়ে বৈশিষ্ট্যময়। আমরা এ বৈশিষ্ট্যগুলোকে ৬টি ভাগে ভাগ করতে পারি:

১. এবারই প্রথম জাপানি আগ্রাসনবিরোধী যুদ্ধ ও বিশ্বের ফ্যাসিবাদবিরোধী যুদ্ধজয়ের স্মরণ অনুষ্ঠান হিসেবে কুচকাওয়াজ আয়োজন করা হ'ল।

২. এবারের কুচকাওয়াজে প্রথমবারের মত বিদেশি সৈন্যরা অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছেন। রাশিয়া, কাজাখস্তানসহ কয়েকটি দেশের সৈন্যরা এতে অংশ নিচ্ছেন।

৩. জাপানি আগ্রাসনবিরোধী যুদ্ধে অংশ-নেওয়া প্রবীণ সৈনিক ও শহীদদের বংশধররা প্রথমবারের মত কুচকাওয়াজে অংশ নিচ্ছেন।

৪. প্রথমবারের মত জাপানি আগ্রাসনবিরোধী যুদ্ধের ১০ জন বীরের নামে চীনা সশস্ত্র বাহিনীর ১০টি দল কুচকাওয়াজে অংশ নিচ্ছে।

৫. প্রথমবারের মত কুচকাওয়াজে যুদ্ধপরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে যুদ্ধসরঞ্জাম প্রদর্শনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

৬. প্রথমবারের মত কোনো কুচকাওয়াজে চীনের জেনারেলরা অধিনায়ক হিসেবে কুচকাওয়াজে অংশ নেবেন। এসব জেনারেলের বয়স ৪৮ থেকে ৫৮ বছর।

প্রিয় শ্রোতা, 'ভি ডে' কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণকারী দলের সংখ্যা ৫০। এর মধ্যে পাদাতিক দল ১১টি, প্রবীণ সৈনিক নিয়ে গঠিত দল ২টি, সরঞ্জাম দল ২৭টি, যুদ্ধবিমান দল ১০টি। কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণ করবে ১২ হাজার সৈনিক, ৪০ ধরনের ৫০০টা যুদ্ধসরঞ্জাম এবং ২০০টি ২০ ধরনের যুদ্ধবিমান।

পদাতিক দলগুলোর একটিই বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে গার্ড অব অনার প্রদান করবে। এ দলের সদস্যসংখ্যা ২০৭। তাদের মধ্যে নারী ৫১ জন। এবারই প্রথম কুচকাওয়াজের গার্ড অব অনার দলে নারীদের ঠাঁই হতে যাচ্ছে। এসব নারী সদস্যের গড় উচ্চতা ১.৭৮ মিটার, গড় বয়স ২০ বছর এবং তাদের মধ্যে ৮৮ শতাংশই স্নাতক ডিগ্রিধারী।

বাকি ১০টি পদাতিক দলের প্রতিটির নামকরণ করা হয়েছে চীনের ১০ জন বীরের নামে। প্রাক্তন প্রবীণ সৈনিক ও শহীদদের বংশধরদের সমন্বয়ে গঠিত দু'টি দল গাড়িতে চড়ে কুচকাওয়াজে অংশ নিবেন। প্রবীণ সৈনিকদের গড় বয়স ৯০

বছর এবং শহীদদের বংশধরগণের গড় বয়স ৭৮ বছর।

'ভি ডে' কুচকাওয়াজে যেসব অস্ত্র ও সরঞ্জাম প্রদর্শন করা হবে সেগুলো সবই চীনে তৈরি। এসব অস্ত্র ও সরঞ্জামের ৮৪ শতাংশই আবার এবারই প্রথমবারের মত জনসম্মুখে প্রদর্শন করা হবে। ১০টি যুদ্ধবিমান দলে স্থান পাবে চীনের সবচে' উন্নত ও আধুনিক জঙ্গিবিমান।

১৯৪৯ সালে যখন নয়াচীন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন আয়োজন করা হয়েছিল প্রথম কুচকাওয়াজ। তখন বিমানের সংখ্যা ছিল ১৭টি। এবারও কুচকাওয়াজে দেখা যাবে বিভিন্ন বাহিনীর বিমান-সৈনিকদের। ১৯৯৯ সাল থেকেই তিন বাহিনীর বিমান-সৈনিকরা কুচকাওয়াজে অংশ নিয়ে আসছেন। বিশেষ করে জেনারেল পদমর্যাদার সামরিক কর্মকর্তারাও এবার কুচকাওয়াজে যুদ্ধবিমান চালাবেন।

বলা বাহুল্য, পেইচিংয়ে আয়োজিত জাপানি আগ্রাসনবিরোধী যুদ্ধ ও বিশ্বের ফ্যাসিবাদবিরোধী যুদ্ধে জয়ের ৭০ বছর পূর্তির স্মরণ অনুষ্ঠান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকষর্ণ করেছে। এ পর্যন্ত ৪৯টি দেশ কুচকাওয়াজে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছে। বেলারুশ প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্দার লুকাশেঙ্কো, কম্বোডিয়ার রাজা নরোদম সিহামনি, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট পার্ক গেউন-হাই, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট জ্যকোব জুমা, এবং ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট রুয়ং তান সাংসহ ৩০ জন বিদেশি নেতা এবং অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিলসহ ১৯টি দেশের উচ্চ পর্যায়ের সরকারি প্রতিনিধিরা, জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি-মুন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহা-পরিচালক ছেন ফেং ফু চেনসহ ১০ জন আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংস্থার দায়িত্বশীল ব্যাক্তিও এবার অনুষ্ঠানে উপস্থিত হবেন।

জাপানি আগ্রাসনবিরোধী যুদ্ধে যারা চীনকে সাহায্য দিয়েছেন তাদেরকে এবং তাদের অনুপস্থিতিতে তাদের বংশধরদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে চীন। এ ক্যাটাগরিতে ১৫টি দেশের ১০০ জন প্রতিনিধি 'ভি ডে প্যারেডে' অংশ নিতে পেইচিং আসছেন। এদের মধ্যে যেমন রয়েছেন আমেরিকান ভলেন্টিয়ার গ্রুপ ও সোভিয়েত ইউনিয়ন লাল ফৌজের সৈনিক, তেমনি রয়েছেন শ্রদ্ধেয় ডাক্তার নরম্যান বাথুনে ও কে লি হুয়ার বংশধররা।

চীন এবার ব্যাপকভাবে জাপানি আগ্রাসনবিরোধী যুদ্ধ ও বিশ্বের ফ্যাসিবাদবিরোধী যুদ্ধ জয়ের ৭০তম বার্ষিকী পালন করছে। কিন্তু এর মানে এ নয় যে দেশটি ৭০ বছরের পুরনো শত্রুতার জের ধরে রেখেছে এবং এ কুচকাওয়াজের আয়োজন করেছে। চীনের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী চাং মিং স্পষ্টভাবেই বলেছেন, ৩ সেপ্টেম্বরের 'ভি ডে প্যারেড' কোনো দেশের বিরুদ্ধে নয়। এ অনুষ্ঠান আয়োজনের লক্ষ্য ইতিহাসকে স্মরণ করা, যুদ্ধের আত্মত্যাগী বীরদের স্মরণ করা এবং ইতিহাস থেকে শান্তি ও ভালোবাসায় সমৃদ্ধ ভবিষ্যত সৃষ্টির উপাদন সংগ্রহ করা।

চাং মিং আরও বলেন, 'আমরা জাপান ও জাপানি জনগণের বিরুদ্ধে নই। আমরা জাপানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে চাই।'

তিনি জানান, চীন যেসব ব্যক্তিকে এবারের অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছে, তারা সকলেই চীনের জাপানি আগ্রাসনবিরোধী যুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অবদান রেখেছেন। চীনা জনগণ কখনই তাদের ভুলবে না।

তিনি আরও জানান, এবারের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীরা বিশ্বের নানান দেশ থেকে আসবেন। তারা সকলেই নিজ নিজ দেশের শীর্ষ পর্যায়ের বিশিষ্ট প্রতিনিধি।

৭০ বছর পর, যুদ্ধে কৃত অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হয়েই কেবল বিশ্ববাসীর কাছে ক্ষমা পেতে পারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ্রাসী শক্তিগুলো। ৭০ বছর পর, আমরা আশা করি আর কোনো দিন মানবজাতিকে এমন ভয়াবহ যুদ্ধের কবলে পড়তে হবে না। যুদ্ধের বদলে শান্তি, প্রতিরোধের বদলে পারস্পরিক সহযোগিতা হ'ল মানবজাতির শান্তি, সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের গ্রহণযোগ্য উপায়। আশা করি, চীনা জনগণ বিশ্বের জনগণকে সাথে নিয়ে একটি সুন্দর পৃথিবী গড়তে সক্ষম হবে।

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
Play
Stop
ওয়েবরেডিও
বিশেষ আয়োজন
অনলাইন জরিপ
লিঙ্ক
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040