Web bengali.cri.cn   
তুরস্কের 'চীন-বিরোধী প্রহসন' ব্যর্থ হয়েছে
  2015-07-21 21:20:42  cri
সম্প্রতি তুরস্কের 'পূর্ব তুর্কিস্তানের' কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী ও চীন-বিরোধী শক্তি চীনের মুসলমানদের রমজান মাসের রোজা পালন নিয়ে অনেক গুজব রটিয়েছে এবং চীনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল করেছে। এর পাশাপাশি তুরস্কের কিছু গণমাধ্যম পশ্চিমা গণমাধ্যমের মিথ্যা সংবাদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে যে, রমজান মাসে সিনচিয়াংয়ের মুসলমানদের ধর্মীয় রেওয়াজ পালনে বাধা দেওয়া হয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ ধরনের গুজব ও চীন বিরোধী বিক্ষোভ মিছিল তুরস্ক ও চীনের সম্পর্কোন্নয়নের ওপর কিছুটা প্রভাব ফেলতে পারে। এটা কেবল 'পূর্ব তুর্কিস্তানের' বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির তত্পরতা। তুরস্কের সংসদ নির্বাচন পরবর্তী পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েছে তারা। এ সময় কিছু লোক নিজেদের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের জন্য এ ধরনের প্রহসনমূলক অপপ্রচার চালিয়েছে। এ উদ্দেশ্য সফল হয়নি ও জনপ্রিয়তা পায় নি, বরং ব্যর্থ হয়েছে।

১৮ জুন রমজান মাস শুরু হওয়ার পর তুরস্কের কিছু তথ্যমাধ্যম বিদেশি তথ্যমাধ্যমের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রচার করেছে যে, সিনচিয়াংয়ে মুসলমানদের রমজানের রোজা পালনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। কিছু দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদী টুইটার ও ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফলাও করে এসব প্রচার করেছে। এরপর তুরস্কের প্রধান গণমাধ্যমগুলোও মিথ্যা খবরগুলো প্রচার করেছে এবং তুরস্কে চীন বিরোধী মনোভাব দ্রুত বেড়েছে।

এএফপি'র ৪ জুলাইয়ের খবরে বলা হয়েছে, তুরস্কের বৃহত্তম শহর ইস্তাম্বুলের পুরনো অঞ্চলে চীন বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়েছে। কিছু বিক্ষোভকারী একদল দক্ষিণ কোরীয় পর্যটককে চীনা মানুষ মনে করে আক্রমণ করেছে। পরে দাঙ্গাবিরোধী পুলিশ তাদের উদ্ধার করে। সেদিন বিক্ষোভকারীরা ইস্তাম্বুলের একটি বিখ্যাত চীনা রেস্তোরাঁয় ভাংচুর চালায়। তা ছাড়া সম্প্রতি তুরস্কের অন্যান্য শহরেও এ ধরনের বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার পর তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তুরস্ক সরকার চীনের ভূখণ্ডের অখণ্ডতা, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তাকে সমর্থন করে। কিন্তু গুজব থেকে সৃষ্ট ঘটনাপ্রবাহের প্রতি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে তারা। তুরস্কে চীনের দূতাবাস এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে যে, "বিদেশি তথ্যমাধ্যমের খবর সত্যের সঙ্গে পুরোপুরি সংগতিপূর্ণ নয়।" চীন সরকার সর্বদাই কমিউনিস্ট পার্টির জাতিগত ধর্মীয় নীতিকে উচ্চ গুরুত্ব দেয় এবং ভালোভাবে তা কার্যকর করে, আইনানুসারে ধর্মীয় ব্যাপার পরিচালনা করে এবং স্বাভাবিক ধর্মীয় তত্পরতা ও ঐতিহ্য রক্ষা করে। চীনের সিনচিয়াং উইঘুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের পার্টির কমিটি ও গণ সরকার এ বছরের রমজান মাস শুরুর আগে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। বিশেষ করে, রমজান মাসে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের রোজা রাখা, নামাজ আদায় করা ও ইফতার খাওয়াসহ নানা ধর্মীয় তত্পরতার ওপর হস্তক্ষেপ না করার নির্দেশনা দিয়েছে।

৬ জুলাই চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, উইঘুর জাতি হলো, চীনের ৫৬টি জাতির বড় পরিবারের এক সদস্য। সিনচিয়াংয়ে এক কোটিরও বেশি উইঘুর জাতির মানুষ সুখে শান্তিতে বসবাস করছেন। তারা সংবিধান অনুযায়ী ধর্ম বিশ্বাসের স্বাধীনতা ভোগ করেন। সিনচিয়াংয়ের উইঘুর জাতির তথাকথিত সমস্যার আদৌ কোনো অস্তিত্ব নেই। চীন আশা করে, কোনো পক্ষ ও ব্যক্তি মিথ্যা খবর ও অপবাদ প্রচার করবে না। সম্প্রতি তুরস্কে চীন বিরোধী সহিংস কর্মকাণ্ডের ওপর গভীর মনোযোগ দিয়েছে চীন। এক্ষেত্রে সহিংসতা মোকাবিলায় তুরস্ককে বাস্তব ও বলিষ্ঠ ব্যবস্থা নেওয়া এবং সেখানে চীনা নাগরিক ও চীনা প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা ও ন্যায়সঙ্গত বৈধ স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার দাবি জানায়। চীনের সার্বভৌমত্ব ও ভূখণ্ডের অখণ্ডতা সম্মান করা, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সযত্নে কথা বলা ও কাজ করা এবং চীনের সঙ্গে যৌথভাবে সম্পর্কের সুষ্ঠু ও স্থিতিশীল উন্নয়ন বজায় রাখতে তুরস্ককে অনুরোধ জানিয়েছে পেইচিং।

বিশ্লেষকরা বলছেন, মিথ্যা খবর প্রচার করা হলো 'পূর্ব তুর্কিস্তানের' বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির সৃষ্ট বিভ্রান্তি। চলতি বছরের জুনের প্রথম দিকে তুরস্কের সংসদ নির্বাচনের পর সৃষ্ট স্পর্শকাতর ও কঠোর রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগে এবারের বিক্ষোভ তত্পরতাকে উসকে দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত তুরস্কের সংসদ নির্বাচনে ১৩ বছর ধরে ক্ষমতাসীন তুরস্কের 'জাস্টিস এন্ড ডিভালপমেন্ট পার্টি' বা একেপি'র বিজয় হলেও, সংসদে তারা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। দশ বারো বছর ধরে সংরক্ষিত আসনগুলো হারিয়েছে তারা। এতে করে একেপি'র দীর্ঘ সময়ের একচ্ছত্র ক্ষমতার অবসান হয়েছে। তাই তাকে অন্যান্য পার্টির সঙ্গে যৌথভাবে কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে হবে। দেশটিতে চরম জাতীয়তাবাদী শক্তির লক্ষণীয়ভাবে উত্থান হচ্ছে। সিএইচপি পার্টি প্রায় ১৬ শতাংশ ভোট পেয়েছে এবং দ্বিতীয় বারের মতো সংসদের বিরোধী দলের মর্যাদা পেয়েছে। দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদী শক্তি রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের জন্য 'বিশ্ব উইঘুর কংগ্রেস'সহ 'পূর্ব তুর্কিস্তানের' মতো বিচ্ছিন্নতাবাদী ও বিদেশি সংস্থার সঙ্গে একত্রিত হয়ে ক্ষমতাসীন পার্টিকে চাপ দিয়ে নিজদের লক্ষ্য অর্জনের অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এদিকে, তুর্কি প্রেসিডেন্টের দেয়া মন্ত্রিসভা গঠনের সময় ঘনিয়ে আসছে, কিন্তু কোয়ালিশন সরকার গঠনের ক্ষেত্রে কোনো বাস্তব অগ্রগতি অর্জিত হয়নি। জোট সরকার গঠনে ব্যর্থ হলে দেশটিতে ফের সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে।

বর্তমানে তুরস্কের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ স্পর্শকাতর ও পরিবর্তনশীল অবস্থায় আছে। তুরস্কের চরম দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদী শক্তি ও বহু বছর ধরে আত্মগোপন করে থাকা 'পূর্ব তুর্কিস্তান' বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি এ পরিস্থিতিকে তাদের সুযোগ মনে করছে। তুরস্কের ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী শক্তির দৃষ্টিতে, 'পূর্ব তুর্কিস্তানের' চীন বিরোধী তত্পরতার সমর্থন করা হলো, তুরস্কের ক্ষমতাসীন পার্টির চীন নীতির ওপর হস্তক্ষেপ করা। আর এভাবেই তুরস্কের সংসদ নির্বাচনের পর সৃষ্ট রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে স্বার্থ হাসিলে ব্যবহার করা হয়েছে। তুরস্কের গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, তুরস্কের দ্বিতীয় বিরোধী দল জাতীয় তত্পরতা পার্টির অধীনস্থ কিছু চরমপন্থি যুব সংগঠন হলো এসব বিক্ষোভের প্রধান সংগঠক।

উল্লেখ্য করা দরকার যে, চীন ও তুরস্কের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। বর্তমানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দু'দেশের সহযোগিতার স্বর্ণযুগ চলছে। ২০১০ সালে চীন ও তুরস্ক কৌশলগত সহযোগিতামূলক সম্পর্ক ঘোষণা করার পর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কোন্নয়ন আরো দ্রুতগতিতে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চীন ও তুরস্কের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ টানা তিন বছরে ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। ২০১৪ সালে দু'দেশের ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাণিজ্য হয়েছে। জার্মানির পর চীন হলো তুরস্কের দ্বিতীয় বাণিজ্যিক অংশীদার। এর পাশাপাশি, দু'দেশের সামরিক খাতে আস্থা ও যোগাযোগও গভীরতর হয়েছে। চলতি বছরের মে মাসে চীন ও তুরস্কের যুদ্ধজাহাজ দু'দেশের বন্দর সফর করেছে এবং চীনের ছিংতাওয়ে যৌথ সামরিক মহড়ার আয়োজন করেছে। তুরস্ক ২০১৫ সালের নভেম্বর জি-২০ আনাতলিয়া শীর্ষসম্মেলনের স্বাগতিক দেশ। চীন ২০১৬ সালের জি-২০ হাংচৌ শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করবে। জি-২০'র কাঠামোতে চীন ও তুরস্কের সহযোগিতা ও যোগাযোগ আরো গভীর হয়েছে। বিশেষ করে চীনের প্রস্তাবিত 'এক অঞ্চল, এক পথ' ধারণা দু'দেশের সার্বিক সহযোগিতার জন্য অভূতপূর্ব সুযোগ এনে দিয়েছে। বলাই বাহুল্য, চীন ও তুরস্কের সম্পর্ক রক্ষা ও জোরদার করা তুরস্কের রাষ্ট্রীয় স্বার্থের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ এবং দেশটির বিশেষজ্ঞরাও এ বিষয়ে একমত হয়েছেন।

আসলে গেলো কয়েক বছরে তুরস্ক সরকারের চাপে 'পূর্ব তুর্কিস্তানের শক্তি ব্যাপকভাবে কমেছে। এমনকি তাদের শক্তি প্রান্তসীমায় পৌঁছে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে তুরস্কে থাকা 'পূর্ব তুর্কিস্তান' বাধ্য হয়ে জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশে পাড়ি জমাচ্ছে। কিন্তু 'পূর্ব তুর্কিস্তান'সহ চীন বিরোধী শক্তিগুলো চীনের বিরুদ্ধে অপচেষ্টা এখনও বন্ধ করেনি। তারা চীন ও তুরস্কের সম্পর্কোন্নয়ন দেখতে চায় না। ফলে তুরস্কের অভ্যন্তরীণ জাতীয়তাবাদী চরম শক্তি উত্থানের নতুন পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিকভাবে ফিরে আসার জন্য জুয়া খেলায় মেতেছে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পূর্ব তুর্কিস্তান সমস্যা অল্প সময়ে নির্মূল না হলেও তা চীন ও তুরস্কের কৌশলগত সহযোগিতামূলক সম্পর্ককে প্রভাবিত করতে পারবে না। দু'দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এ ধরনের চীন বিরোধী প্রহসন বাধা হতে পারবে না এবং দু'দেশের জনগণের সমঝোতা ও মৈত্রী গভীরতর করার ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা কাজ করবে না। (ইয়ু/তৌহিদ)

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
Play
Stop
ওয়েবরেডিও
বিশেষ আয়োজন
অনলাইন জরিপ
লিঙ্ক
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040