Web bengali.cri.cn   
আকাশের সাথে-চীনের কান সু প্রদেশের লান চৌ থেকে সিন চিয়াং উইগুর অঞ্চলের উলুমুছির দ্রুতগতির ট্রেন-চালকের গল্প
  2015-07-11 20:10:50  cri

ট: প্রিয় শ্রোতাবন্ধুরা, da jiahao! আপনারা চীন আন্তর্জাতিক বেতারের বাংলা অনুষ্ঠান শুনছেন। সবাইকে আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানিয়ে শুরু করছি আমাদের নিয়মিত সাপ্তাহিক আয়োজন 'আকাশের সাথে"। আর এ আয়োজনে আপনাদের সঙ্গে রয়েছি এনামুল হক টুটুল এবং শিয়েনেন আকাশ।

ক: সুপ্রিয় শ্রোতা, আজকের অনুষ্ঠানে আপনারা চীনের কান সু প্রদেশের লান চৌ থেকে সিন চিয়াং উইগুর অঞ্চলের উলুমুছির দ্রুতগতির ট্রেন-চালকের গল্প শুনবেন।

প্রত্যেক মানুষেরই জন্মগতভাবে কিছু স্বপ্ন থাকে। শৈশব থেকে এই স্বপ্নগুলো মানুষকে সামনে এগিয়ে যেতে সবসময়ই উত্সাহিত করে । সেই সব স্বপ্নগুলোর একটি হলো উড়াল দেওয়া বা দ্রুতবেগে চলা।

মানুষের এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে, আমরা মরুভূমি, তৃণভূমি, তুষারের পাহাড়, নদী সবকিছু পার হয়ে চলেছি। আমাদের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে মেঘ; রেলপথের উপর দিয়ে আমরা দ্রুতবেগে উড়ছি।

২০১৪ সালে চীনের কান সু প্রদেশের রাজধানী লান চৌ থেকে সিন চিয়াং উইগুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের রাজধানী উলুমুছি পর্যন্ত দ্রুতগতির ট্রেন চালু হয়। এর মধ্য দিয়ে কান সু প্রদেশ, ছিং হাই প্রদেশ ও সিন চিয়াং স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে দ্রুতগতি ট্রেনের এক নতুন যুগ শুরু হয়।

এ রেলপথের নাম হচ্ছে লান সি কাও তেই। ২০০৯ সালে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এই রেলপথটির মোট দৈর্ঘ্য ১৭৭৬ কিলোমিটার। এখানে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২৫০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলতে পারে।

এই রেলপথ চালু হওয়ার পর, উলুমুছি থেকে লান চৌ যেতে ১১ঘণ্টা সময় লাগে। আগে যেখানে সময় লাগতো ২৬ ঘণ্টা। এখন এখানকার প্রতিটি শহরের দূরত্ব খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। দ্রুতগতির ট্রেন সমস্ত শহরগুলোর দূরত্ব কমিয়ে এনে তাদের যেন এখন একত্রে যুক্ত করেছে ।

উইগুর জাতির আ লি মু চিয়াং উলুমুছিতে ব্যবসা করেন। তিনি প্রথমে তার গ্রামে আঙ্গুর ফল বিক্রি করতেন। এখন তিনি এখানে অনেক ধরনের ব্যবসা করেন। উলুমুছি থাকার এ কয়েক বছরে বাবা-মার কথা সবসময়ই মনে পড়ে তার। দ্রুতগতির ট্রেন চালু হওয়ার আগে তিনি বাসে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বাসায় যেতেন। তিনি বলেন, "আগেই বাসায় ফিরে যেতে প্রায় সারাদিন লেগে যেতো, খুবই কষ্ট হতো তখন"।

আ লি মু চিয়াংয়ের মতো সিন চিয়াংয়ের অনেক তরুণ-তরুণী উলুমুছিতে লেখাপড়া করেন, কাজ করেন বা ব্যবসা করেন। সবাই তাদের গ্রাম, তাদের বাবা-মাকে খুব মিস করেন। এখন দ্রুতগতির ট্রেন চালু হওয়ার পর তাদের বাসা যেন খুব কাছে চলে এসেছে । আ লি মু চিয়াং বলেন, এখন বাসায় ফিরে যেতে শুধু ৫৮ মিনিট সময় লাগে। বাবা-মা এখন সবসময় তার কাছে ছুটে আসেন।

তিনি বলেন, "বাবা-মা যখন সময় পান, যেমন সাপ্তাহিক ছুটির দিন তারা আমার কাছে চলে আসেন। আগে আমি বাসায় ফিরে গিয়ে তাদের নিয়ে আসতাম। এখন শুধু স্টেশনে গিয়ে তাদের রিসিভ করলেই চলে। কোনো সময় লাগেনা"।

আতি টুরতির বাবা রেলওয়েতে চাকরি করেন। তার বাসা রেলওয়ের পাশেই। প্রতিদিন ট্রেনের শব্দ শুনতে না পারলে তিনি ঘুমাতে পারেন না। তিনি বলেন, "ছোটোবেলায় বন্ধুদের নিয়ে আমি ট্রেনের মধ্যে ঘুরে বেড়াতাম। দেখেছি এখানে অনেক ট্রেন থামানো আছে। আমার বন্ধু বলেন, দেখ, দেখ! আমার বাবা ট্রেন-চালক, তিনি ওই তিনটি ট্রেন চালান। একথা শুনে আমি বলি, ও তাই, খুবই ভালো"।

তখন থেকেই ট্রেন-চালনাকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে চান আতি টুরতি। তিনি রেলওয়ে স্কুলে ভর্তি হন এবং 'ট্রেন-চালনাকে' প্রধান বিষয় হিসেবে বাছাই করেন।

২০০৩ সালে আতি টুরতি 'ডিপ্লোমা' ডিগ্রি লাভ করেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে রেলওয়েতে চাকরি শুরু করেন।

তিনি খুব পরিশ্রমের সঙ্গে চাকরি করেন এবং খুব দ্রুতই ট্রেন-চালক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি বলেন, "আমি চাকরিতে যোগদান করার চার বছরের মাথায় ট্রেন-চালকের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই। আমার সহপাঠীদের মধ্যে আমিই প্রথম এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই"। এর পর আতি টুরতি চার বছর ট্রেন চালান। এর মধ্যে তিনি সব ধরনের ট্রেনই চালিয়েছেন।

গত বছর সিন চিয়াংয়ে দ্রুতগতির ট্রেন চালু করার কাজ শুরু হয়। তিনি প্রথমবারের মতো দ্রুতগতির ট্রেনের চালকের জন্য আবেদন করেন।

কিন্তু দ্রুতগতির ট্রেনের চালক হতে চাইলে প্রথমে শারীরিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়।

শারীরিক পরীক্ষায় তিনি অনেক ভয় পান। তিনি বলেন, "ওরে বাবা! শারীরিক পরীক্ষায় প্রায় সারাদিন লাগে । ১৫দিন পর আবার আরেকটি শারীরিক পরীক্ষার আয়োজন করা হয়। সব দিক দিয়ে শরীর পরীক্ষা করা হয়। এমনকি তারা আমাকে একটি গাড়ি চালনা সংক্রান্ত গেমস খেলতে দেন। এ পরীক্ষায় তারা আমার গতির প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করেন"।

তিনি বলেন, "এসব পরীক্ষায় তিনি অনেক ভয় পান এবং মনে করেন তিনি এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারবেন না। খুবই কঠিন, আমার মনে অনেক ভয়, এমনকি ডাক্তার কিছু ইস্যু নিয়ে কথা বলেন, এভাবে তারা আমার আইকিউ পরীক্ষা করেন"।

আতি টুরতি একজন শক্তিশালী এবং মোটা যুবক । এটা তাকে অনেক কষ্ট দেয়। তিনি বলেন, ডাক্তার তাকে বলেছেন, "তুমি অনেক মোটা, শরীর না কমালে তুমি পরীক্ষায় পাশ করতে পারবেনা"।

আতি টুরতি বলেন, "তার এ পেশায় তাকে সবসময় বসে কাজ করতে হবে । এজন্য অনেক চালক মোটা। তাদের নেতা মজা করে বলেন যে, তোমাদের ওজন কমাতে হবে, তা না হলে তোমরা দ্রুতগতির ট্রেনের দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবেনা। এজন্য সবাই খুব চাপে ওজন কমানোর চেষ্টা করেন"।

অনেক প্রচেষ্টার পর অবশেষে তিনি শারীরিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর চীনের সান সি প্রদেশে তাদের একটি প্রশিক্ষণ শুরু হয়। এখানে আতি টুরতি প্রথমবারের মতো দ্রুতগতির ট্রেন দেখেন। তিনি বলেন, "পাও চি'র ওই প্রশিক্ষণে আমি প্রথমবারের মতো দ্রুতগতির ট্রেন দেখি। আমাদের সিন চিয়াংয়ের চালকরা কেউ দ্রুতগতির ট্রেন দেখেননি, শুধু টেলিভিশনে দেখেছি"।

এর পর আতি টুরতি পেইচিংয়ে রেলওয়ে কোম্পানির দ্রুতগতির ট্রেনের চালক হিসেবে সাক্ষাতকার দেন। আবার তিনি দেখেন, এখানে তারা দ্রুতগতির ট্রেনের চালকের জন্য কত কঠিনভাবে পরীক্ষা নেন।

তিনি বলেন, "পেইচিংয়ে মোট তিনজন পরীক্ষক আমাদের সাক্ষাতকার নেন। এ সাক্ষাতকারের জন্য আমরা খুবই যত্ন নিয়ে পোশাক পরি। প্রথমে দরজা নক করতে হবে, তারপর তাদের অনুমতি নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতে হবে এবং এরপর দরজা বন্ধ করতে হবে। সম্ভবত তারা মেঝের উপর একটি বড় সাদা কাগজ রেখেছেন। যদি কেউ ওই সাদা কাগজের দিকে কোনো খেয়াল না করেন তাহলে তার অনেক সমস্যা হয়"।

তিনি বলেন, সাক্ষাতকারের সময় তার একটি খারাপ অভ্যাস সবার সামনে প্রকাশ পায়।

তিনি বলেন, "যখন আমি নার্ভাস ফিল করি তখন আমার একটি খারাপ অভ্যাস প্রকাশ পায়, তাহলো দু'হাত দিয়ে নিজের উরু ম্যাসেজ করা এবং প্যান্ট ধরে টানাটানি করা । আমি ওইদিন অবচেতনভাবে এটা করি। একজন পরীক্ষক এটা খেয়াল করেন, আমি বুঝতে পারার পর দ্রুত তা বন্ধ করি"।

আতি টুরতি বলেন, পরীক্ষকরা প্রশ্ন করা শুরু করেন । তাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া অনেক কঠিন। তিনি বলেন, "তারা অনেক প্রশ্ন করেছেন। তারা আমার বিভিন্ন ক্ষেত্রের অবস্থা জানার চেষ্টা করেন। যেমন, তারা জিজ্ঞাস করেন, ট্রেন চালানোর সময় কোনটা সবচেয় গুরুত্বপূর্ণ এবং কোনটা গুরুত্বপূর্ণ না। আসলে সব গুরুত্বপূর্ণ। কোনটা গুরুত্বপূর্ণ না? কিন্তু উত্তর দিতে হবে। এ ছাড়া পরীক্ষক আপনার উত্তর দেওয়ার পর উত্তর সম্পর্কিত আবার প্রশ্ন করবেন । যদি আপনার মন শক্তিশালী না হয়, তাহলে আপনি অবশ্যই তাদের পরাজিত করতে পারবেননা"।

কিন্তু, সিন চিয়াংয়ের মোট ২২জন ট্রেন চালক এ পরীক্ষায় অংশ নেন, তারা খুবই উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন। সবাই পরীক্ষায় পাশ করেন। তিনি বলেন, "আমরা ২২জন প্রত্যেকেই সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছি এবং পরীক্ষায় পাশ করেছি"।

সাক্ষাতকারের পর আতি টুরতি চীনের সি ছুয়ান প্রদেশে যান এবং সেখানে আরেকটি প্রশিক্ষণে অংশ নেন। তিনি বলেন, "আরে, এতো বেশি বই! আমি প্রতিদিন মন প্রাণ দিয়ে বই পড়ি। অনেক কিছুই আমি বুঝতে পারিনা। সিন চিয়াংয়ের সহপাঠী ছাড়া অন্য অনেক সহপাঠীদের এলাকায় দ্রুতগতির ট্রেন আছে। এজন্য আমি তাদের সবসময় জিজ্ঞাস করি এটা কেন, ওটা কেন?"

ছেন তু শহরে প্রশিক্ষণের পর, প্রত্যেক শিক্ষক একজন ছাত্র নিয়ে দ্রুতগতির ট্রেন চালাতে শুরু করেন।

দ্রুতগতির ট্রেন সম্পর্কে শিক্ষকদের স্পিরিট এবং নিয়মশৃঙ্ক্ষলা দেখে আতি টুরতি অনেক মুগ্ধ হন। তিনি বলেন, "রেলওয়ে স্টেশনে প্রবেশ করার পর, ট্রেন উঠার আগে আমি ভাবি একটু ধূমপান করতে পারি, কিন্তু শিক্ষক আমাকে বলেন, এটা করবেনা। তুমি কাজের সময় এটা করবেনা। শুধু এটা নয়, ট্রেন চালানোর সময় অন্য কোনোরকম কোনো খারাপ কাজ করবেনা"।

আতি টুরতি আরো বলেন, "তাদের কাজ করার অবস্থা দেখে আমি অনেক অবাক হয়েছি। এতো কঠোর, এতো বিস্তারিত। তারা শিফ্ট পরিবর্তন, যেমন রাতের শিফ্ট, দিনের শিফ্ট ও ট্রেন হস্তান্তর করার সময় একে অপরকে স্যালুট করেন। তারপর আমি বুঝতে পারি, দ্রুতগতির ট্রেন সবকিছুই বিস্তারিতভাবে গুরুত্ব দিতে হবে" ।

২০১৪ সালের ১৬ নভেম্বর সকাল ১১টায়, সিন চিয়াংয়ে প্রথম দ্রুতগতির ট্রেন চালু হয়। এই ট্রেন আতি টুরতি চালিয়েছেন। তিনি সিন চিয়াংয়ের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে দ্রুতগতির ট্রেন-চালক হয়েছেন।

সিন চিয়াংয়ে হাজার হাজার আতি টুরতির প্রচেষ্টায় দ্রুতগতির ট্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। এ পর্যন্ত সিন চিয়াংয়ে দ্রুতগতির ট্রেনে কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। একশ' ভাগ নিরাপদ।

আতি টুরতি জানান, দিনের সময় দ্রুতগতির ট্রেন বাইরে চলাচল করে, সন্ধ্যার সময় সব হেডকোয়ার্টারে ফিরে আসে এবং সেখানে তাদের মেরামত করা হয়।

রাত ১২টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত, সব রেলপথ চেক ও মেরামত করা হয়। ট্রেনও হেডকোয়ার্টারে ফিরে আসে এবং তাদের মেরামত করা হয়। ভোর ৪টায় একটি দ্রুতগতির ট্রেন উলুমুছি থেকে রওয়ানা করে হামি যায়। সব রেলপথ চেক করে কনফার্ম করার পর সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রী নিয়ে দ্রুতগতির ট্রেন যাত্রা শুরু করে । প্রতিদিন এটা করা হয়।

আতি টুরতি প্রায় আধা বছরেরও বেশি সময় ধরে দ্রুতগতির ট্রেন চালান। তিনি যাত্রীদের নিরাপত্তায় প্রতিদিন অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে মন প্রাণ দিয়ে ট্রেন চালান। তিনি বলেন, "প্রতিবার যখন যাত্রীদের নিরাপদে ও দ্রুত তাদের গন্তব্যে পোঁছে দিতে পারি, তখন আমি আমার মনে সবচেয়ে আনন্দ পাই"।

ট: বন্ধুরা, আজকের অনুষ্ঠান এ পর্যন্তই। আপনারা যদি নিজেদের কোনো কথা আমাদের সাথে শেয়ার করতে চান বা কোনো কথা বলতে চান, তাহলে আমাদের কাছে টেলিফোন করতে পারেন বা ইমেইল করতে পারেন। আমাদের টেলিফোন নম্বর হচ্ছে: ০০৮৬১০৬৮৮৯২৪২০ এবং আমাদের ইমেইল হচ্ছে enamulhoquetutul@yahoo.com.

ক: বন্ধুরা, এবার তাহলে বিদায়। সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন এবং সুন্দর থাকুন। আপনারা সবসময়ই আমাদের মনে, আমাদের হৃদয়ে, আমাদের আত্মায়।

ট: হ্যাঁ বন্ধুরা, জীবনে মরণে আমরা কখনো পৃথক হবো না। চাই চিয়েন। (আকাশ/টুটুল)

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
Play
Stop
ওয়েবরেডিও
বিশেষ আয়োজন
অনলাইন জরিপ
লিঙ্ক
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040