0621jiankang
|
দশটি সুবিধা নিয়ে আলোচনা করার আগে আমি ভিনেগার সম্পর্কে কিছু তথ্য শ্রোতাদের সঙ্গে শেয়ার করতে চাই। ভিনেগারকে বাংলায় আমরা বলি সিরকা। আর এটি একটি তরল পদার্থ যা অ্যাসিটিক অ্যাসিড (CH3COOH) ও পানির মিশ্রণ। ভিনেগারে সাধারণত ৫ শতাংশ অ্যাসিটিক অ্যাসিড থাকে। ভিনেগার তৈরিতে আপেল, আঁখ, নারিকেল, খেজুর, নাশপাতি, টমেটো, চাউল, গম, মধু, বিয়ার ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়। যুক্তরাজ্য, জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও নেদারল্যান্ডসে বিয়ার ভিনেগার প্রচলিত। আঁখ থেকে তৈরি ভিনেগার ফিলিপিন্সে জনপ্রিয়। তবে ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রেও এ ধরনের ভিনেগার প্রস্তুত করা হয়। নারকেলের পানি থেকে তৈরি ভিনেগার মূলত ব্যবহৃত হয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে। আর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ভিনেগার প্রস্তুত করা হয় ঐতিহ্যবাহী খেজুর থেকে। অধিকাংশ ফলের ভিনেগার তৈরি হয় ইউরোপে। তবে, চীন ও কোরিয়াতেও ফল থেকে ভিনেগার প্রস্তুত করা হয়। অবশ্য চীনের কালো ভিনেগার বিখ্যাত। ইতালি, ফ্রান্স, রুমানিয়া ও স্পেনে পাওয়া যায় মধু থেকে তৈরি ভিনেগার। চাউল থেকে তৈরি ভিনেগার পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়।
ভিনেগার আজকাল শুধু রান্নার কাজে ব্যবহৃত হলেও, গৃহস্থালী পরিস্কার, পুড়ে যাওয়া, চিকিৎসায় পথ্য ইত্যাদি বহুবিধ ক্ষেত্রে এর স্বার্থক প্রয়োগ ঘটেছে। প্রাচীনকালে কোনো কোনো চিকিত্সক ওষুধ হিসেবে ভিনেগার খেতে দিতেন বলে জানা যায়। বিখ্যাত মুসলিম চিকিত্সা-বিজ্ঞানী ইবনে সিনা তার সপ্তদশ শতাব্দীতে লেখা 'দা ক্যানন অব মেডিসিন' গ্রন্থে ভিনেগারের বেশকিছু উপকারিতার কথা লিখে গেছেন। তিনি দাবী করেছেন যে, ভিনেগার পুড়ে যাওয়া ত্বকের ক্ষত ও গরমের কারণে সৃষ্ট মাথা ব্যাথা সারাতে কার্যকর। তিনি ভিনেগারকে হজমে সহায়ক বলেও মনে করতেন। এ ছাড়া, চতুর্দশ শতাব্দীতে আরেক মুসলিম চিকিত্সা-বিজ্ঞানী ইবনে কাইয়ুম আল-যাওজিয়া তার 'দা প্রফেটিক মেডিসিন' গ্রন্থে ভিনেগারের উপকারিতার কথা লিপিবদ্ধ করেছেন। ঊর্মি, আমি ভিনেগার বা সিরকা সম্পর্কে কিছু তথ্য দিলাম। তবে, ভিনেগার নিয়ে প্রচলিত একটি ফরাসি প্রাচীন গল্প না-বললে অন্যায় হবে। গল্পটি এমন: ফ্রান্সের কুখ্যাত 'ব্ল্যাক প্লেগ' বা 'কৃষ্ণ মহামারী'র সময়ে তিনজন চোর এক মহামারী আক্রান্ত ব্যক্তিদের বাড়িতে বার বার চুরি করেও মহামারীতে আক্রান্ত হলো না। শেষ পর্যন্ত তারা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লো। বিচার প্রক্রিয়ার সময় যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিল তা হচ্ছে: কী করে চোর তিনজন মহামারী আক্রান্তদের বাড়িতে দিনের পর দিন চুরি করেও রোগাক্রান্ত হলো না! বিচারক বললেন, তোমাদের মুক্তি দেওয়া হবে, যদি তোমরা এর গোপন রহস্য আমাদের বল। চোরেরা জানালো, তারা একজন মহিলা চিকিত্সকের কাছ থেকে নেওয়া একধরনের তরল নিয়মিত পান করে। আসলে সেই তরল ছিল ভিনেগার বা সিরকা। পরে এই সিরকা 'তিন চোরের সিরকা' নামে ফ্রান্সে শত শত বছর ধরে টিকে থাকে।
সুবিধা ১: খাবারের স্বাদ বৃদ্ধি পায়
চর্বিযুক্ত খাবার রান্নার সময় কিছু ভিনেগার ব্যবহার করলে খাবারের স্বাদ বৃদ্ধি পায়। তা ছাড়া, ভিনেগারের সুগন্ধ খাবারটিকে আরো মজাদার করে তোলে। অনেকে চর্বির গন্ধ পছন্দ করেন না। তারা ভিনেগার দিয়ে রান্না করা চর্বিযুক্ত খাবার খেয়ে দেখুন, ভালো লাগবে।
সুবিধা ২: খাবারের অপছন্দনীয় গন্ধ দূর হয়
আপনি কি কখনো মাছ বা ছাগলের মাংস রান্না করেছেন? হ্যাঁ, মাছ ও ছাগলের মাংস রান্না সময় এক ধরনের গন্ধ পাওয়া যায়। অনেকেই এই গন্ধ পছন্দ করেন না। তো, এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে ভিনেগার। রান্নার সময় একটু ভিনেগার মিশিয়ে দিন, গন্ধ দূর হয়ে যাবে।
সুবিধা ৩: ভিনেগার খাবারকে জীবাণুমুক্ত করে ও খাবারের পচন রোধ করে
যেসব খাবার আগুণে সেদ্ধ করে খাওয়া হয় না, সেসব খাবার ভিনেগার মিশিয়ে খেলে সেগুলো জীবাণুমুক্ত হয়। যেমন: শসা, গাজর ইত্যাদি। আচার তৈরির সময় ভিনেগার ব্যবহার করলে, সেই আচার অনেকদিন ভালো থাকে; তাতে পচন ধরে না।
সুবিধা ৪: ভিনেগার খাবারের লবণাক্ততা বাড়ায়
প্রিয় বন্ধু, আপনি জানেন কি, লবণ বেশি খাওয়া ভালো নয়? আবার খাবারে লবণাক্ততা না-থাকলে, মজাও লাগে না। কোনো সমস্যা নেই। খাবারে ভিনেগার ব্যবহার করুন। তখন লবণ কম ব্যবহার করেও আপনি খাবারে লবণাক্ততার স্বাদ ঠিকই পাবেন।
সুবিধা ৫: ভিনেগার খাবারে ব্যবহৃত মশলার তীব্রতা কমিয়ে দেয়
রান্নার পর যদি দেখা যায় ঝাল বেশি হয়েছে, তখন খানিকটা ভিনেগার মিশিয়ে দিন। দেখবেন ঝালের তীব্রতা কমে যাবে। রেস্তোরাঁ খেতে বসেছেন; বুঝলেন খাবারটি অতিরিক্ত ঝাল; ওয়েটারকে ডাকুন, বলুন একটু ভিনেগার দিতে। মিটিয়ে ফেলুন সমস্যা।
সুবিধা ৬: খাবারকে ক্ষারের স্বাদমুক্ত করতে সাহায্য করে ভিনেগার
আগেই বলেছি, ভিনেগারে প্রায় ৫ শতাংশ অ্যাসিটিক অ্যাসিড থাকে। আর অ্যাসিড হচ্ছে ক্ষার প্রশমক। সুতরাং খাবারের ক্ষারের স্বাদ প্রশমিত করতে ভিনেগার ব্যবহার করুন। চীনাদের খাবার টেবিলে 'মানথৌ' থাকবেই থাকবে। কিন্তু আপনি জানেন কি, 'মানথৌ' তৈরির সময় সাধারণত আমরা ভিনেগার ব্যবহার করি? ময়দার সঙ্গে পানি মিশিয়ে 'মানথৌ' তৈরির সময় যদি দেখা যায় স্বাদ ক্ষারযুক্ত হয়ে গেছে, তখন ভিনেগার মেশানো হয়।
সুবিধা ৭: ভিনেগার খাবারের উজ্জ্বলতা বাড়ায়
সুন্দর কে না পছন্দ করে! যাকিছু দেখতে সুন্দর, মানুষ তা পছন্দ করে। হ্যা, খাবারের ক্ষেত্রেও কথাটা সত্য। যে খাবার দেখতে সুন্দর সেটি খেতেও ভালো লাগে। অন্তত খেয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। চীনাদের সুস্বাদু খাবারগুলোর মধ্যে ভিনেগার ব্যবহার করা হয় এ কারণেও। ভিনেগার খাবারকে সুস্বাদু করার পাশাপাশি এর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে, এর উজ্জ্বলতা বাড়ায়। কারণ, ভিনেগারের মধ্যে জৈব অ্যাসিড রয়েছে। এই উপাদান খাবারে ব্যবহৃত বিভিন্ন উপাদানের রঙ নষ্ট হতে দেয় না।
সুবিধা ৮: খাবার ভালোভাবে সেদ্ধ হতে ভিনেগার সাহায্য করে
আলু রান্নার আগে আপনি প্রথমে ভিনেগারযুক্ত পানিতে ভিজিয়ে রাখুন। তারপর রান্নার সময় পাত্রে আলু দেয়ার পর, আপনি পর্যাপ্ত ভিনেগার দিন। তারপর দেখবেন রান্না করা আলু মুখে দিলে কেমন মিশে যাবে! খেয়ে খুব আরাম পাবেন। চীনের একটি জনপ্রিয় খাবারের নাম 'ছুলিউ থু তৌ সি'। 'ছু' মানে ভিনেগার, 'থুতৌ' মানে আলু আর 'সি' হলো সরু বা fine।
সুবিধা ৯: ভিনেগার খাবার দ্রুত রান্না হতে সাহায্য করে
ভিনেগারের মধ্যে রয়েছে জৈব অ্যাসিড। এটি গরু বা ছাগলের মাংস রান্নার সময় ব্যবহার করলে, রান্না দ্রুত শেষ হবে। ভিনেগার ছাড়া রান্না করলে এক্ষেত্রে যে সময় লাগবে, ভিনেগার ব্যবহার করলে সে সময় অর্ধেকে নেমে আসবে।
সুবিধা ১০: মাছ বা মাংসের হাড় নরম করে ভিনেগার
রান্নার সময় মাছ বা মাংসের হাড় নরম হতে সাহার্য করে ভিনেগার। তাতে আমরা হাড়ের ক্যালসিয়াম তুলনামূলকভাবে বেশি পেতে পারি। মাছসুপ ও হাড়ের সুপ তৈরীর সময় ভিনেগার তাই অপরিহার্য। ভিনেগার ব্যবহার করলে স্যুপের পুষ্টিগুণ ও স্বাদও বৃদ্ধি পায়।
(ঊর্মি/আলিম)