Web bengali.cri.cn   
আলবিনো, আলবিনিজম এবং "চাঁদের শিশুর বাড়ি"
  2015-06-03 20:13:54  cri


আমাদের আশেপাশে এমন সব শিশু আছে যাদের ত্বক ও চুল সাদা। এরা আলো পছন্দ করে না। রোদে গেলে ওদের ত্বক জ্বালা করে। এদের দৃষ্টিশক্তিও ভালো নয়। হ্যা, এরা 'আলবিনো'। এরা আলবিনিজম (Albinism)-এর রোগী।

এসব শিশু রাতের আবহাওয়া পছন্দ করে। কারণ, তখন আকাশে সূর্য থাকে না। আর তাই অনেকে তাদের আদর করে ডাকেন 'চাঁদের শিশু'।

আসলে, এরা গুরুতর কোনো রোগে আক্রান্ত নয়। তাদের ত্বক ফ্যাকাশে সাদা এবং তারা সূর্যালোক সহ্য করতে পারে না—এই যা। কিন্তু সাধারণ মানুষ অনেক সময় অজ্ঞতার কারণে এদের এড়িয়ে চলতে চায়। বলা বাহুল্য, এতে এই শিশুরা মনে কষ্ট পায়। মনে রাখতে হবে, এমনিতেই আলবিনো শিশুরা ভীরু প্রকৃতির হয়ে থাকে। তারা সহজে কষ্ট পায়।

আগামী ১৩ জুন পালিত হবে প্রথম আন্তর্জাতিক আলবিনিজম দিবস। এ দিবসকে সামনে রেখেই আমরা আজ আলোচনা করছি আলবিনো এবং আলবিনিজম সম্পর্কে।

আমরা এখন আলবিনোদের জীবন সম্পর্কে জানবো। আশা করি এ অনুষ্ঠান শোনার পর শ্রোতাদের মনে আলবিনোদের সম্পর্কে জমে থাকা যে-কোনো ধরনের নেতিবাচক ধারণা দূর হবে। আশা করি, এখন থেকে আমরা সবাই আলবিনোদের প্রতি সহানুভূতিশীল হবো, তাদেরকে অন্য দশজন সাধারণ মানুষের মতোই বিবেচনা করবো।

চীনাদের কাছে আলবিনিজম কোনো অপরিচিত রোগ নয়। কারণ, এদেশে উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তকে আলবিনিজম সম্পর্কে তথ্য আছে। তবে, তা যথেষ্ট নয়। এসব তথ্য আমাদের মনে আলবিনোদের সম্পর্কে কতোটা ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম তা বলা মুশকিল।

আসলে, আলবিনিজম একটি বংশগত রোগ। এ রোগে আক্রান্তদের চোখের রেটিনার কোনো রঙ হয় না। তাদের চুল, ভুরু ও শরীরের অন্যান্য স্থানের চুল ফ্যাকাশে সাদা হয়। আগেই বলেছি, সূর্যের আলোকে তারা ভয় পায়। তো, এ রোগের কোনো কার্যকর চিকিত্সা এখনো আবিস্কৃত হয়নি।

পরিসংখ্যান অনুসারে, বিশ্বব্যাপী প্রতি ২০ হাজার মানুষের মধ্যে একজন আলবিনো। এ হিসেবে চীনের আলবিনো আছে ৬০ থেকে ৭০ হাজার।

কুয়ান লু একজন আলবিনো। চীনের সি আন শহরে তার বাস। ছোটবেলায় অন্য শিশুদের চেয়ে দেখতে ভিন্ন হলেও, কুয়ান লু খুব একটা পার্থক্য অনুভব করেননি। তিনি বলেন:

"আমি এ নিয়ে খুব একটা চিন্তাই করি না। এ বিশ্বে একেক মানুষের ত্বকের রঙ একেক রকমের এবং প্রতিটি মানুষের চেহারাও ভিন্ন ভিন্ন। অন্যদের সাথে আমার পার্থক্য হচ্ছে: আমার গায়ের রঙ ফ্যাকাশে সাদা এবং আমাকে সূর্যের আলোতে বাধ্যতামূলকভাবে রোদচশমা পড়তে হয়।"

কুয়ান লুর বয়স ৩৫ বছর। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে তার সুখী পরিবার। তার স্ত্রী লিউ ইং আলবিনো নন। তার দৃষ্টিতে কুয়ান লু কোনো রোগী নন। তিনি জানালেন, কুয়ান লু-কে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর তার পরিবার আপত্তি জানিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে লিউ ইং বলেন,

"অবশ্য আমার বাবা বিরোধিতার করেননি। তিনি শুধু বলেছিলেন, আলবিনোদের দৃষ্টিশক্তি ভালো হয় না। ফলে ভবিষ্যতে আমার কষ্ট হতে পারে। হ্যা, এ বিয়ের তীব্র বিরোধী ছিলেন আমার মা। তিনি মনে করতেন, তার সুস্থ মেয়েকে একজন অসুস্থ ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার কোনো মানে হয় না। তা ছাড়া, মানুষে কী বলবে সে নিয়েও তার মাথা ব্যথা ছিল। তখন আমি মাকে বলেছিলাম, আমার জীবনের সাথে অন্য মানুষের কোনো সম্পর্ক নেই। তাদের কথায় কিছু যায় আসে না।"

মানসিক দৃঢ়তা সত্ত্বেও, লিউ ইং শুরুর দিকে অন্যের নেতিবাচক কথা আর অদ্ভূত দৃষ্টিতে আহত হতেন। তিনি বলেন,

"শুরুর দিকে আমি যখন স্বামীর সঙ্গে বাইরে যেতাম, তখন অনেকে লুকিয়ে আমাদের ছবি তুলতো। আমার স্বামীর দৃষ্টিশক্তি ভালো নয় বলে তিনি তা লক্ষ্য করতেন না, কিন্তু আমি করতাম। কেউ কেউ আরালে-আবডালে আমাদের সম্পর্কে বিদ্রুপাত্মক কথাবার্তাও বলতো। কেউ কেউ বলতো, আমি নাকি টাকা দেখে আমার স্বামীকে বিয়ে করেছি।"

অন্যের নেতিবাচক কথা লিউ ইংকে কষ্ট দিত। কিন্তু তিনি হতাশ হননি বা ভেঙে পড়েননি। তিনি একজন জেদি মেয়ে। তিনি জানতেন, বিবাহিত জীবনে সুখী হতে হলে অন্যের কথায় কান না-দিয়ে তাকে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে হবে।

বিয়ে ছিল তাদের প্রথম পরীক্ষা। প্রশ্ন উঠলো তাদের ভবিষ্যত সন্তান সম্পর্কেও। যেহেতু আলবিনিজম একটি বংশগত রোগ, সেহেতু তাদের অনাগত সন্তান আলবিনো না-হলেও, এ রোগের জিন বহন করবে। এ সম্পর্কে লিউ ইং বলেন,

"আমার সন্তান আলবিনো হবে কি হবে-না, এ নিয়ে আমার কোনো দুশ্চিন্তা ছিল না। আমি শুধু নিজের অনাগত সন্তানের লালন-পালন নিয়ে ভাবছিলাম।"

লিউ ইংয়ের সমর্থনে কুয়ান লু আলবিনোদের জন্য কিছু করতে চাইলেন। ২০০৮ সালে সি আন শহরে কুয়ান লু ও তার জনৈক বন্ধু 'চাঁদের শিশুর বাড়ি' নামক একটি গণকল্যাণমূলক সংগঠন গড়ে তোলেন। এটি চীনে আলবিনিজম রোগীদের জন্য গড়ে ওঠা প্রথম ও সবচে বড় গণকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান। কুয়ান লু জানান, 'চাঁদের শিশুর বাড়ি'-র মাধ্যমে তার মতো আলবিনোদের এবং তাদের তাদের পরিবারগুলোকে প্রয়োজনীয় তথ্য ও পরামর্শ দেওয়া হয়। এ প্রতিষ্ঠান সমাজে আলবিনোদের জন্য একটি অনুকূল স্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টি করতেও প্রচার-প্রচারণা চালায়।

৭ বছর বয়সি মা লং ইয়ান 'চাঁদের শিশুর বাড়ি'-র একজন সদস্য। তার বাবা বললেন,

"যখন আমার মেয়ে জন্মগ্রহণ করে তখন আমার বয়স প্রায় ৩৮ বছর। আমি মেয়ে অনেক পছন্দ করি। তাই মেয়ে হওয়ার খবর শুনে অনেক খুশি হই। তবে নার্স আমাকে জানান, আমার মেয়ে অন্য শিশুর চেয়ে একটু ভিন্ন, তার চুল সব সাদা রঙের।"

খবর শুনে মিস্টার মা'র মন চিন্তিত হল। তিনি বুঝতে পারছিলেন না, পরিবারের অন্যদের কীভাবে এ খবর দেবেন। তবে তার মা তাকে এক্ষেত্রে সাহায্য করলেন। শিশুর দাদা-দাদি আলবিনিজম সম্পর্কে জানলেন এবং শিশুটিকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করলেন। এ প্রসঙ্গে মিঃ মা বলেন,

"আমার মা খুব স্নেহময় একজন মানুষ। তিনি নাতনীর খবর শুনে আমাকে বলেন, 'চিন্তা করো না। আমি আগেও আলবিনো দেখেছি। তিনি একজন শিক্ষক।' আমার মা খবরটা সহজে গ্রহণ করলেন এবং আমাকে সান্ত্বনা দিলেন।"

নিজের পরিবার ছোট্ট মা লং ইয়ানকে সাদরে গ্রহণ করে নিলেও, সমাজে তাকে নানান বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে হয়। কারণ, তখন অনেকেই আলবিনোদের স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে অভ্যস্ত ছিল না। তার বাবা বলেন,

"আমার মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করাতে আমি আগেভাগেই আবেদন করেছিলাম। কিন্তু স্কুল থেকে ভর্তির কোনো নোটিশ পেলাম না। বলা হলো, কোনো সিট খালি নেই। তবে, আমি জানি আমার মেয়ের গায়ের রঙ-ই তাকে ভর্তি না-করানোর কারণ। এর আগে স্কুলে কোনো আলবিনোকে ভর্তি করানো হয়নি।"

অবশ্য, অন্য একটি স্কুল মা লং ইয়ানকে শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি করিয়ে নেয়। প্রিন্সিপাল নিজে মেয়েটিকে কোলে নিয়ে অন্যান্য শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদে সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। সবাই তাকে সাদরে গ্রহণ করে।

৯৫ শতাংশ আলবিনোর দৃষ্টিশক্তি ০.৩-এর চেয়ে কম। তাদেরকে সাহায্য দেওয়ার জন্য 'চাঁদের শিশুর বাড়ি' বিশেষ টুল প্রস্তুত করে। টুলের সাহায্যে শিশুরা বই পড়তে পারে। 'চাঁদের শিশুর বাড়ি' আলবিনো শিশুদের বৃত্তিও দিয়ে থাকে। এখানে একটি হটলাইন আছে। এ লাইনের মাধ্যমে যে-কেউ আলবিনিজম সম্পর্ক পরামর্শ পেতে পারেন। তা ছাড়া, নিয়মিতভাবে 'চাঁদের শিশুর বাড়ি' সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও আয়োজন করে থাকে। এসব অনুষ্ঠানে আলবিনো শিশুরা নিজেদের প্রতিভা প্রদর্শনের সুযোগ পায়। মা লং ইয়ান এক ধরনের বিশেষ বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারে। সে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে।

গত কয়েক বছর ধরেই 'চাঁদের শিশুর বাড়ি'র কর্মী হিসেবে কাজ করছেন সিয়ে পাও ফু। তিনি বলেন,

"গত কয়েক বছরের প্রচার-প্রচারণার ফলে এখন চীনের অনেক আলবিনো এখন আমাদের 'চাঁদের শিশুর বাড়ি' সম্পর্কে জানে। সমাজের সাধারণ মানুষও এখন এ সংগঠন সম্পর্কে অবহিত। আমার ভালো লাগে যখন দেখি, আমাদের কাজের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান হারে লোকজন আলবিনোদের স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে গ্রহণ করছে এবং এ রোগ সম্পর্কে জানছে।"

অবশ্য আলবিনোদের জন্য লেখাপড়া করা এবং কর্মসংস্থান এখনও একটি বড় সমস্যা। তাদের দৃষ্টিশক্তি ভাল না বলে কাউকে কাউকে বিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করার পর কায়িক পরিশ্রম করতে হয়। কোনো কোনো আলবিনো উচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেও কর্মসংস্থানের প্রশ্নে বৈষম্যের শিকার হন। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বিদ্যমান বৈষম্যও 'চাঁদের শিশুর বাড়ি'র প্রতিষ্ঠাতা কুয়ান লুর জন্য উদ্বেগের বিষয়। তিনি বলেন,

"বর্তমানে, আলবিনোদের কর্মসংস্থান কঠিন সমস্যা। একই ডিগ্রি ও ক্ষমতার দুজন মানুষের মধ্যে চাকুরিদাতারা কখনোই একজন আলবিনোকে চাকুরি দিতে চান ন।" এ প্রসঙ্গে 'চাঁদের শিশুর বাড়ি' থেকে সমাজের প্রতি একটি বার্তা সবসময় প্রচার করা হয়। বার্তাটি হচ্ছে:

"যদি আপনার বা আপনার বন্ধুর পরিবারে একজন 'চাঁদের শিশু' জন্মগ্রহণ করে তাহলে চিন্তা করবেন না, তাকে পরিত্যাগ করবেন না। আমরা বিশ্বাস করি, তার ভবিষ্যত উজ্জ্বল। যদি পথে আপনি একজন আলবিনো শিশু দেখেন, তাহলে অদ্ভূত দৃষ্টিতে তাকে দেখবেন না; তাকে দেখে ভয় পাবারও কোনো কারণ নেই। তার শুধু ত্বক ও চুলের রঙ ভিন্ন। যদি আপনি কোনো কোম্পানির এসআর কর্মী হন তবে স্রেফ আলবিনো হবার কারণে তাকে চাকুরি দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন না। তার ওপর আস্থা রাখুন, সে নিজেকে প্রমাণ করতে সক্ষম হবে। তাদের প্রতি সহমর্মিতা নিয়ে একটি বৈষম্যহীন মুক্ত সমাজ গড়ে তুলুন। বিশ্বাস করি, তারাও সমাজ গঠনে অবদান রাখতে পারবে।"

আর প্রিয় শ্রোতা, আপনাদের জানাই একটি সুখবর। সম্প্রতি আমি facebook-এ একটি ব্যাক্তিগত অ্যাকাউন্ট খুলেছি। ভবিষ্যতে আপনি ইমেল ছাড়া, facebook-এর মাধ্যমেও আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন। আমার facebook-এর অ্যাকাউন্ট হচ্ছে 377641702@qq.com। আসুন, আমাকে জানাবেন আপনাদের মতামত।

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
Play
Stop
ওয়েবরেডিও
বিশেষ আয়োজন
অনলাইন জরিপ
লিঙ্ক
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040