Web bengali.cri.cn   
জেনিফার এবং তার হাফ-সিস্টার আন লুও ছিয়ান
  2015-05-27 14:04:37  cri


গত ৮ মে ৬০ বছর বয়সী জেনিফার ভারতের চেন্নাই থেকে চীনের আসেন। জেনিফারের পিতা চীনা, মা ভারতীয়। তিনি চীনে আসেন তার হাফ-সিস্টার আন লুও ছিয়ানের খোঁজে। বয়সে আন বড়।

যাকে খুঁজতে জেনিফার চীনে এসেছেন, সেই বড় বোনটিকে তিনি এর আগে কোনো দিন দেখেনইনি। কিন্তু তাকে খুঁজে বের করা তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এ সম্পর্কে জেনিফার বললেন,

"আমার বিশ্বাস আমার বোনটি বেঁচে আছেন। আমার বাবার শেষ ইচ্ছা ছিল, আমি একদিন আমার এ বোনটিকে খুঁজে বের করবো। আমি তার এ ইচ্ছা পূরণ করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবো।"

জেনিফারের বড় বোন আন লুও ছিয়ান ১৯৩৫ সালে সাংহাইয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আন ছি বাং। তিনি ছিলেন পরিবারের একমাত্র সদস্য যিনি চীনের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি নেওয়ার পর উচ্চতর ডিগ্রির জন্য ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান। পরে মাত্র ৩০ বছর বয়সে তিনি একটি বাণিজ্য জাহাজের ক্যাপ্টেন হন। আন লুও ছিয়ান যখন খুবই ছোট, তখন আন ছি বাংয়ের সাথে তার স্ত্রীর বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে।

গত শতাব্দীর ৪০-এর দশকের কথা। তখন চীনে চলছে জাপানি আগ্রাসন-বিরোধী যুদ্ধ। আন ছি বাং তার ৬ বছর বয়সী মেয়ে আন লুও ছিয়ানকে তার দাদীর কাছে রেখে বাণিজ্যে জাহাজের সাথে চলে গেলেন ভারতে চেন্নাই। তখন চেন্নাইয়ে প্রায় ৭০টি চীনা পরিবার বাস করতো। চীনা কমিউনিটিতে একমাত্র আন ছি বাং-ই চীনা ও ইংরেজি—দুটি ভাষায় কথা বলতে পারেন। পরে এই কমিউনিটির উন্নয়নে তিনি অনেক অবদান রাখেন।

যুদ্ধের কারণে আন ছি বাং সেসময় চীনে ফিরে আসতে পারলেন না। তিনি ভারতে নতুন ব্যবসা শুরু করেন। একে একে তিনি সেখানে দুটি চীনা রেস্টুরেন্ট খোলেন। আরও পরে তিনি একজন ভারতীয় নারীকে বিয়ে করেন। জেনিফার বললেন,

"আমার বাবা চেন্নাইতে প্রথমে নিজেই একটি চীনা রেস্টুরেন্ট চালু করেন এবং তার পর আমার মাকে বিয়ে করেন। পরে বন্ধুর সাথে যৌথভাবে খোলেন দ্বিতীয় রেস্টুরেন্টটি।"

আন ছি বাং ও তার ভারতীয় স্ত্রীর সংসারে চারটি সন্তান। এর মধ্যে জেনিফার ১৯৫২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। জেনিফার জানালেন, তার বাবা তার অতীর সম্পর্কে খুব একটা কিছু বলতেন না। তবে, তার কাছে সবসময় মেয়ে আন লুও ছিয়ানের ছবি থাকতো।

এদিকে, চীনে আন লুও ছিয়ান দাদীর কাছে বড় হয়েছেন। ১৯ বছর বয়সে তার বিয়ে হয় মিঃ কুওর সঙ্গে। দু'জন একই কোম্পানিতে কাজ করতেন এবং কাজের জন্যই তাদেরকে চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও পেইচিংয়ে বসবাস করতে হয়েছে। গত শতাব্দীর ৭০-এর দশক থেকে তারা পেইচিংয়েই বসবাস করে এসেছেন। আন লুও ছিয়ান বাবার কাছ থেকে দূরে থেকে বড় হয়েছেন। এ নিয়ে তার দুঃখ আছে। অবশ্য তার স্বামী তাকে অনেক ভালোবাসেন। তাদের সংসারে আছে ফুটফুটে চারটি সন্তান। আন লুও ছিয়ানের মেয়ে বললেন,

"আমার মা খুবই সুখী। আমার বাবা তাকে অনেক ভালবাসেন এবং তার যত্ন নেন। আমার মা'র আত্মীয়স্বজন কম বলে, আমার বাবার আত্মীয়স্বজনরাই তার যত্ন নেন।"

আন ছি বাং আর চীনে ফিরে আসেননি। কিন্তু যখনই কোনো চীনা নাগরিক ভারতে আসতো, তিনি তার মেয়ের খোঁজ নিতেন। তিনি ভারতে চীনা দূতাবাসের মাধ্যমে মেয়েকে চিঠিও লিখতেন। তবে ১৯৮২ সালে আন ছি বাং মারা যাওয়ায়, মেয়ের সঙ্গে আর তার দেখা হয়নি।

জেনিফার তার বাবার শেষ ইচ্ছা পূরণের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু চীনের মতো একটা বড় দেশে বোনকে খুঁজে পাওয়া সহজ কথা নয়। জেনিফারের স্বামী অবশ্য তাকে অনেক উত্সাহ দেন এবং তার সঙ্গে চীনে আসেন। তিনি বললেন,

"জেনিফারের বাবার শেষ ইচ্ছা ছিল তার চীনা মেয়ের সঙ্গে দেখা হওয়া। আগে আমরা বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত ছিলাম। তখন আমি জেনিফারকে বলতাম, অবসর নেওয়ার পর আমরা অবশ্য চীনে যাবো। আমি আশা করি, জেনিফার তার বাবার শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে পারবে এবং খুশী হবে।"

৮ মে, জেনিফার ও স্বামী পেইচিং পৌঁছেছেন। তারা ভাবলেন আন লু ছিয়ান সাংহাইতে থাকতে পারেন। তাই ১৪ মে সাংহাই যাওয়ার পরিকল্পনা করলেন। ৯ মে রাতে পেইচিংয়ে জেনিফারের এক বন্ধু তার গল্প সিআরআই-এর তামিল বিভাগকে ই-মেইলের মাধ্যমে জানান। ১০ মে তামিল বিভাগের একজন কর্মীর সাহায্যে জেনিফার নিশ্চিত করেন নিজের বাবা ও বোনের চীনা নামের বানান। ১১ মে সিআরআই তামিল ও ইংরেজি বিভাগ জেনিফারের গল্প শোনে এবং চীনা এস এন এসে জেনিফারের বোনের খবর প্রচার করে। ১২ মে তারা ভাল একটি খবর পান। পেইচিংয়ে বসবাসরত আন লুও ছিয়ান নামের এক প্রবীণ নারী জেনিফারের বোন হতে পারেন বলে তাদের জানানো হয়। জানা গেল, এই আন লুও ছিয়ান ১৯৩৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং তার বয়স জেনিফারের বড় বোনে বয়সের সমান। সিআরআইর সাংবাদদাতা এ প্রবীণ নারীর সঙ্গে ফোনে কথা বলেন এবং নিশ্চিত হন যে, উনি-ই জেনিফারের সেই বড় বোন।

৭০ বছর ধরে বাবার সঙ্গে দেখা নেই আন লুও ছিয়ানের। ভারত থেকে তার হাফ-সিস্টার এসেছে জেনে তিনি তার সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। ১৪ মে, ৫০ বছর পর দু'বোন প্রথমবারের মতো একে অপরের দেখা পেলেন। আন লুও ছিয়ানের বয়স ৮০ এবং জেনিফারের বয়স ৬০। মনে লুকিয়ে থাকা অনেক বছরের স্মৃতি হঠাত জেগে ওঠে। একাধারে কষ্ট আর সুখ আন লুও ছিয়ানের মন ভরিয়ে দেয়। তিনি বললেন,

"কেন আমি কাঁদছি? জেনিফার আন ছি বাংয়ের মেয়ে মানে সে আমার পরিবারের সদস্য।"

বাবা কাছে ছিল না বলে আন লুও ছিয়ানের শৈশবকাল খুব আনন্দে কাটেনি। তার এ দুঃখের কথা এতোদিন তিনি কারোর সঙ্গে শেয়ার করতে পারতেন না। কিন্তু এবার নিজের দুঃখের কথা শেয়ার করার জন্য তিনি তার হাফ-সিস্টারকে পেয়েছেন। দু'বোনে মধ্যে পার্থক্য অনেক বেশি। তারপরও রক্তের সম্পর্ক বলে কথা। আন লুও ছিয়ান বলেন, যখন তিনি প্রথম জেনিফারকে দেখেন, ঠিক তখনই তার প্রতি অন্তরের টান অনুভব করেন।

এদিকে, পিতার শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে পরে খুশী জেনিফার। তিনি পেইচিং-সাংহাই বিমান টিকেট ফিরিয়ে দিলেন এবং পেইচিংয়ে বাকি কটা দিন বোনের সঙ্গেই কাটিয়ে দিলেন। ভারতে ফিরে যাওয়ার আগে তিনি চাইলেন তার চীনা পরিবারের সঙ্গে যতটা বেশি সম্ভব সময় কাটাতে। তিনি আন লুও ছিয়ানের

পরিবারকে ভারতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। জেনিফার বলেন,

"হাসি আর কান্নার কয়েকটি দিন কেটে গেল দ্রুত। আমি আমার এই চীনা পরিবারটির সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখবো। আশা করি একদিন তারা ভারতে আমাকে দেখতে আসবে।"

জেনিফারের গল্প অনেকের দৃষ্টি আর্কষণ করেছে। অনেক চীনা বন্ধু তাকে সাহায্য করেছেন। জেনিফারের ভারতীয় বন্ধু বিশ্বনাথ বললেন,

"চীনা বন্ধুর সাহায্য ছাড়া জেনিফার তার বড় বোনকে খুঁজে পেতেন বলে মনে হয় না। একে আমি দেখি চীন-ভারত মৈত্রীর একটি নিদর্শন হিসেবে। চীনা বন্ধুদের জানাই ধন্যবাদ।"

যখন পেইচিংয়ে জেনিফার এবং তার বোন আন লুও ছিয়ানের দেখা হয়, ঠিক তখন সি আন শহরে ভারত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার চীন সফরে শুরু করেছেন। দু'দেশের নেতারা তখন চীন-ভারত মৈত্রী নিয়ে আলোচনা করেন। তারা হয়ত তখন ভাবতেই পারেননি যে, আমরা পেইচিংয়ে বসে দেখছি চীন-ভারত মৈত্রীর এক খণ্ডচিত্র!

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
Play
Stop
ওয়েবরেডিও
বিশেষ আয়োজন
অনলাইন জরিপ
লিঙ্ক
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040