0518huanqiu
|
গত ২৫ মে নেপালে রিখ্টার স্কেলে ৮.১ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হানে। নেপাল চীনের সুপ্রতিবেশী দেশ। তাই এ দুর্ঘটনার পর পরই জরুরি ভিত্তিতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় চীন। দেশটিতে জরুরি ভিত্তিতে উদ্ধারকারীদল ও চিকিত্সকদল পাঠানোর পাশাপাশি জরুরি ত্রাণসামগ্রীও পাঠায় চীন সরকার। তাছাড়া, সেদেশে অবস্থানকারী চীনারাও উদ্ধার ও ত্রাণ কাজে অংশগ্রহণ করেন।
হ্যাঁ, যদিও এটি একটি প্রাকৃতিক দুর্ঘটনা, তবে এ ভূমিকম্পে ত্রাণ ও উদ্ধার কাজের কারণে চীন ও নেপালের সম্পর্ক আরো গভীর এবং সুসংবদ্ধ হয়। আসলে শুধু নেপাল নয়, যখন কোনো দেশে প্রাকৃতিক বা অন্য কোনো ধরনের দুর্যোগ ঘটেছে এবং সেদেশের সাহায্য দরকার হয়েছে, তখনই চীন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এ বিষয়ে কোনো দ্বিধা করে নি কখনোই।
ভূমিকম্পের পর থেকে এ পর্যন্ত চীন ইতোমধ্যেই নেপালকে ৬ কোটি ইউয়ান মূল্যের জরুরী মানবিক ত্রাণ সাহায্য দিয়েছে। চীনের উপ বাণিজ্যমন্ত্রী ছিয়ান কো মিং জানিয়েছেন, ভূমিকম্পের পর নেপালকে সবচেয়ে আগে সাহায্য দেয়া দেশের অন্যতম হলো চীন। ভবিষ্যতে দেশটির দুর্যোগের অবস্থা অনুযায়ী চীন নতুন দফা সাহায্য প্রস্তাব প্রণয়ন করবে বলেও জানান তিনি।
সম্প্রতি চীনের বেসামরিক প্রশাসন মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ ৭টি মন্ত্রণালয় বা বিভাগ পেইচিংয়ে এক সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে। এসময় তারা নেপাল ও তিব্বতের ভূমিকম্পের ত্রাণ ও উদ্ধার কাজের সর্বশেষ তথ্য প্রকাশ করে। সহকারী বাণিজ্যমন্ত্রী লিউ চিয়ান ছাও বলেন,
ভূমিকম্প ঘটার সেইদিন রাতেই চীনের ভূমিকম্প ব্যুরোর গঠিত চীনের আন্তর্জাতিক উদ্ধার ও ত্রাণ দল নেপালে পৌঁছায়। দলটি হল কাঠমান্ডুতে পৌঁছানো প্রথম আন্তর্জাতিক পেশাদার উদ্ধারকারী দল। চীনের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কমিশনের গঠিত চীন সরকারের প্রথম দফা চিকত্সকদল ও সামরিক উদ্ধার দলও ভূমিকম্পের এক দিন পরই নেপালে পৌঁছায়।
আমরা সবাই জানি ভূমিকম্প ঘটার পরের ৭২ ঘণ্টা হল উদ্ধারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়। চীনের উদ্ধারকারী দল ঠিক এ সময়টিতেই নেপালে জরুরি উদ্ধার কাজ শুরু করে।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, চীন আন্তর্জাতিক উদ্ধার ও ত্রাণ দল হল নেপালে পৌঁছানো প্রথম আন্তর্জাতিক পেশাদার উদ্ধার ও ত্রাণ দল। ভূমিকম্পে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া লোককে উদ্ধার করার পাঁচটি উদ্ধার দলের অন্যতম একটি হল চীনের উদ্ধার দল। চীনের ভূমিকম্প ব্যুরোর উপ প্রধান নিউ চি চুন বলেন,
'১০ দিনের মধ্যে চীন আন্তর্জাতিক উদ্ধার ও ত্রাণ দল ১৮টি কর্ম এলাকার ৪৩০টি ভবনের ধ্বংসাবশেষ চেক করে। দু'জনকে জীবিত উদ্ধার করা ছাড়াও ৯ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করে। এ ছাড়া দলটি কাঠমান্ডুসহ কয়েকটি দুর্গত এলাকায় ভ্রাম্যমাণ চিকিত্সা কেন্দ্র স্থাপন করে। এতে ইতোমধ্যে ২৭২৯ জনকে চিকিত্সা সেবা দেয়া হয়েছে এবং ২.৮৫ লাখ ইউয়ানের ওষুধ বিতরণ করা হয়েছে'।
নেপালের এবারের ভূমিকম্পে চীনের উদ্ধার ও ত্রাণ কাজের বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে চীনের উপ বাণিজ্যমন্ত্রী ছিয়ান কো মিং জানান:
প্রথম বৈশিষ্ট্য হল : দ্রুত প্রতিক্রিয়া। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা যৌথভাবে সাহায্যের কাজে অংশ নিয়েছে। দ্বিতীয়ত: শুধু যে চীন সরকারই সেখানে জরুরি ত্রাণসামগ্রী এবং আন্তর্জাতিক ত্রাণ দল পাঠিয়েছে তা নয়, চীনের বেসরকারি ত্রাণ দল, স্বেচ্ছাসেবক, চীনা শিল্প প্রতিষ্ঠান ও সেদেশে অবস্থানকারী চীনারা ভূমিকম্পের পর পরই ত্রাণ কাজে যোগ দিয়েছে।
জানা গেছে, এবারের ভূমিকম্পের পর নেপালে দুই দফায় ৬ কোটি ইউয়ান মূল্যের ৫৪.৬ টন ত্রাণ উপকরণ সাহায্য পাঠিয়েছে চীন। এর মধ্যে রয়েছে দুর্গত এলাকার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ৮ হাজার তাঁবু, ওষুধ ইত্যাদি ইত্যাদি।
জরুরি অবস্থায় চীন নেপালকে যথাসাধ্য সাহায্য দিচ্ছে। চীনের ত্রাণতত্পরতা নেপাল সরকার ও স্থানীয় জনগণের ভূয়সী প্রশংসাও পেয়েছে। এ ছাড়া জাতিসংঘ ও অন্যান্য দেশের উদ্ধার ও ত্রাণ দলও মনে করে চীনের উদ্ধার কাজ অনেক প্রশংসনীয়। চীনের উপ বাণিজ্যমন্ত্রী ছেয়ান কো মিং জানান,
'বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নেপালে চীনের দূতাবাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যোগাযোগ বজায় রেখেছে। নেপালের ভূমিকম্পের সর্বশেষ অবস্থা এবং তাদের চাহিদা অনুযায়ী নতুন দফা সাহায্য প্রস্তাব প্রণয়ন করছে। বিশেষ করে জনগণের জীবনযাপনের মান এবং অবকাঠামোসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরো বেশি সাহায্য করবে। যাতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নেপালি জনগণের পুনর্বাসন করা যায়।
আসলে শুধু নেপাল নয়, বিশ্বের যেকোনো দেশ যখন কোনো দুর্যোগের সম্মুখীন হয়েছে, চীন তখনই সেদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে। কখনোই কোনো সাহায্য করতে দ্বিধা করে নি। এ ক্ষেত্রে অনেক উদাহরণ রয়েছে। এখন আমরা এ সম্পর্কে কিছু আলোচনা করবো। চীন মূলত দুর্যোগের সময় যেসব বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ সেসব বিষয়গুলোর উপরই আগে গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
প্রথমত, দুর্যোগের পর দুর্গত এলাকার পুনর্বাসন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এককথায় দুর্যোগের পর পুনর্বাসন অনেকটা রক্তের মতই প্রয়োজনীয়। আর এ জন্য দরকার পর্যাপ্ত আর্থিক সাহায্য। চীন সরকার ও জনগণ বিভিন্নভাবে দুর্যোগে আক্রান্ত লোকদের সাহায্য করে। চীন সরকারের পাশাপাশি দেশটির বেসরকারি সংস্থাগুলোও জরুরি ভিত্তিতে দুর্গতদের পাশে দাঁড়ায়।
২০০৪ সালে ভারত মহাসাগরে ভয়াবহ সুনামি সৃষ্টি হলে মানুষ অবর্ণনীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এতে অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটে এবং হাজার হাজার ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়। এসময় দুর্গতের সাহায্যে কেবল চীনের বেসরকারি সংস্থা ও জনগণের দেয়া চাঁদার পরিমাণ ১৫ কোটি ইউয়ান। যা সবই সাধারণ চীনা নাগরিকদের ভালোবাসা ও যত্নের প্রতীক।
২০১০ সালে পাকিস্তানে ভয়াবহ বন্যা হয়। চীন কোনো দ্বিধা না করে পাকিস্তানকে ৬ কোটি ইউয়ানের ত্রাণসামগ্রী ও অর্থ প্রদান করে।
একই বছর অর্থাত ২০১০ সালে চিলিতে ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হানে। এ ঘটনার পর পরই চীন দ্রুত গতিতে চিলি সরকারকে ১০ লাখ মার্কিন ডলার আর্থিক সাহায্য প্রদান করে। হ্যাঁ, যদিও চিলি অন্য একটি মহাদেশে অবস্থিত তারপরও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে একটুও দেরি করে নি চীন। চীনের এমন ভালোবাসা ও সহানুভূতি অনেক গভীর।
২০১১ সালে মিয়ানমারেও তীব্র ভূমিকম্প আঘাত হানে। তখন চীন জরুরি ভিত্তিতে দেশটিকে নগদ ৫ লাখ মার্কিন ডলার আর্থিক সাহায্য প্রদান করে।
দুর্যোগের পর আরেকটি প্রয়োজনীয় জিনিস হল বিভিন্ন ধরনের ত্রাণসামগ্রী। চীনের রীতি হল দুর্যোগ এলাকায় যে ধরনের উপকরণ দরকার সেগুলো দ্রুত সেখানে পাঠানো। যেমন ২০১১ সালে কম্বোডিয়ায় ভয়াবহ বন্যা হলে সেখানকার দুর্যোগ কবলিত জনগণের জন্য ওষুধ, মশারি ও তোয়ালে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। অবশ্য তখন বিভিন্ন দেশ কম্বোডিয়াকে সাহায্য করে, তবে চীন সরকারের দেয়া সাহায্যের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। বন্যা ঘটার পর পরই ৫ কোটি ইউয়ানের ত্রাণসামগ্রী সেদেশে পাঠায় চীন সরকার। মোটকথা, সেসময় চীনই দেশটিতে প্রথম ওষুধ, মশারি ও তোয়ালে পাঠায়।
২০১১ সালে জাপানে ভয়াবহ ভূমিকম্পের কারণে সুনামি সৃষ্টি হয়। এতে চীন সরকার জাপানকে সাহায্য হিসেবে ১০ হাজার টন পেট্রোল ও ১০ হাজার টন ডিজেল প্রদান করে। এ ছাড়া দেশটিকে তাঁবু, বিশুদ্ধ পানি ও অন্যান্য সব প্রয়োজনীয় ত্রাণসামগ্রীও প্রদান করে চীন।
দুর্যোগের সময় আরেকটি প্রয়োজনীয় বিষয় হলো বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা। যেখানে দুর্যোগ তৈরি হয়েছে, চীনের উদ্ধার ও ত্রাণদল সেখানেই সাহায্য করেছে।
২০০৩ সালে আলজেরিয়ায় ভূমিকম্প ঘটে। এতে চীনের আন্তর্জাতিক উদ্ধার ও ত্রাণদল প্রথমবারের মত আন্তর্জাতিক পর্যায়ের দায়িত্ব পালন করে। আলজেরিয়া এর জন্য অনেক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। সে দেশের এক কর্মকর্তা জানান, আলজেরিয়া যখনই দুর্যোগ বা সমস্যার সম্মুখীন হয়, চীন সবসময় অনেক তাড়াতাড়ি সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। হ্যাঁ, আলজেরিয়ার সেই ভূমিকম্পে চীন শুধু যে ত্রাণসামগ্রী ও অর্থ দিয়েছে তাই নয়, বরং ভূমিকম্পের পর পরই দেশটিতে উদ্ধার ও ত্রাণদল পাঠায়। এককথায় আর্থিক ক্ষেত্রে হোক, মানবিক ক্ষেত্রে হোক, চীন দেশটির ভূমিকম্পে সর্বাত্মক সাহায্য দিয়েছে ।
২০১০ সালে হাইতিতে ভয়াবহ ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটে। সেসময় দেশটির উদ্ধার ও ত্রাণকাজে চীন সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। আসলে হাইতি ও চীনের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় নি। তবে চীন মানবিক দিক থেকেই সে দেশটিকে অনেক সাহায্য দিয়েছে, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনেক প্রশংসা লাভ করে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক মঞ্চে চীনের ভূমিকা আরো গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে। কাজের মাধ্যমে এখন আন্তর্জাতিক মঞ্চে যথেষ্ট সম্মান ও মর্যাদার আসনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে চীন। চীন সবসময়ই মানুষের পাশে আছে, থাকবে। চীন সমসময়ই অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল। চীন অনেক শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ হলেও নিজের বন্ধুকে কখনও ভুলে যায় না। (শুয়েই/টুটুল)