বাংলাদেশে সাংবাদিকতায় নারীর অংশগ্রহণ সেই ৫০-এর দশক থেকে। সময়ের পরিক্রমায় আজ বাংলাদেশে এ পেশায় জড়িত হয়েছেন অনেক তরুণী। চ্যালেঞ্জিং এ পেশায় পুরুষের সাথে সমানে সমানে কাজ করছেন তারা।
রিপোর্টিয়ের মত ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলো করছেন তারা সাহসীকতার সাথে। স্বীকৃতি হিসেব পাচ্ছেন নানা পুরস্কার। নিজের যোগ্যতা ও মেধা দিয়ে কাজ করে এগিয়ে যাচ্ছেন সামনের দিকে। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া ও অনলাইন পত্রিকাগুলোতেও সফলতার সাথে কাজ করছেন নারীরা। মিডিয়া হাউজগুলোতে সংখ্যাগত দিক থেকে নারীর বৃদ্ধি ঘটলেও অনেকই বলেছেন তা যথেষ্ট নয়। তারা বলছেন, সিদ্ধান্তগ্রহণের জায়গাগুলোতে, এমন কি প্রতিষ্ঠানের ওপরের পদগুলোতে এখনো নারী সাংবাদিকের সংখ্যা প্রায় শূন্যের কোঠায়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রভাষক সোমা দেব
এসব বিষয় নিয়ে আমরা এখন কথা বলবো বাংলাদেশের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রভাষক ও গবেষক সোমা দেব'এর সাথে।
প্রশ্ন : বর্তমানে বাংলাদেশে নারীদের সাংবাদিকতার প্রেক্ষাপট বা অবস্থা নিয়ে কিছু বলুন।
সোমা দেব : বর্তমানে নারী সাংবাদিকদের কথা যদি বলি, বিগত দশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যক নারী সাংবাদিকতা পেশায় কাজ করছেন। চ্যালেঞ্জ নিচ্ছেন। চ্যালেঞ্জের সাথে কাজ করছেন। রিপোর্টিং, এডিটিং, নিউজরুম ম্যানেজমেন্ট থেকে শুরু করে সম্পাদক পদে নারীরা বেশ সাফল্যর সাথে কাজ করছেন। সাহসিকতার সাথে কাজ করছেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশের একজন নারী সাংবাদিক নাদিরা শারমিনকে সাহসিকতার সাথে রিপোর্টিং পেশায় অবদানের জন্য আমেরিকার সরকার তাকে পুরস্কৃতও করেছে।
কিন্তু সার্বিক দিক বিশ্লেষণ করলে নারী পুরুষের সমতার কথা যদি বলা হয় তাহলে সেই হারটা একেবারেই কম। নারীরা নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়, সেটা সামাজিক, পারিবারিক এবং অন্যান্য। নারীদের জন্য সাংবাদিকতাটাকে পেশা হিসেবে খুব সহজে গ্রহণ করা হয় না। ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীতে খুব নগণ্য সংখ্যক নারীরা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছে। ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই প্রথম সাপ্তাহিক পত্রিকা 'বেগম' এর সম্পাদনা শুরু করেন বেগম সুফিয়া কামাল। পরে নুরজাহান বেগম 'বেগম' পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। তিনি এখনো সফলতার সাথে সে দায়িত্ব পালন করছেন।
১৯৪৯ সালের জানুয়ারিতে সুফিয়া কামাল এবং জাহানারা আরজু যুগ্মভাবে 'সুলতানা' পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। কিন্তু সেই সময়ে নারীরা সাংবাদিকতায় আসতেন শুধুমাত্র আগ্রহ থেকে এবং সময় কাটানোর জন্য।
বাংলাদেশে ১৯৬০ সাল থেকে নারীরা সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করা শুরু করেন। আমরা ১৯৭১ সালে অআমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের কথা বলতে পারি। অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে তিনি তার সম্পাদিত 'শিলালিপি' পত্রিকার মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে কথা বলতেন।
বর্তমানে দেশে এবং দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোতে বাংলাদেশের নারীরা মেধা ও সাহসিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। এসব সংবাদগুলো আমাদের নারী সাংবাদিকদের সফলতার ইঙ্গিত দেয়।
প্রশ্ন : দেশের মিডিয়া হাউজগুলোতে মেয়েদের কাজ করার পরিবেশ কেমন বলে আপনি মনে করেন।
সোমা দেব : কাজের পরিবেশ বলতে তো আমরা অনেক কিছুই বুঝি। এখানে পত্রিকার পাতায় নিউজ ট্রিটমেন্ট পাওয়া, অ্যাসাইনমেন্ট পাওয়া থেকে শুরু করে এমনকি টয়লেট সুবিধা পাওয়া, রাতে বাড়ি ফেরার জন্য গাড়ি পাওয়াও অন্তর্ভূক্ত। এখানে ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও প্রিন্ট মিডিয়ার চিত্রটা একটু ভিন্ন। আবার মিডিয়া হাউজ ভেদেও কাজের পরিবেশের ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। তবে সার্বিকভাবে বলতে গেলে গুরুত্বপূর্ণ বিটসমূহ যেমন, অপরাধ, কূটনৈতিক, পররাষ্ট্র, স্পোর্টস, অর্থনীতি, শিক্ষা এসব বিটে নারী সাংবাদিকদের উপস্থিতি এখনো বেশ কম। এসব বিষয়ে নারীদের যোগ্য মনে করা হয় না কোন অজানা কারণেই। নারী ও শিশুবিষয়ক বিট, সংস্কৃতি এবং এধরনের সফট ধরনের বিটগুলোতে নারীরা বেশি কাজ করেন। এধরনের অভিযোগ রয়েছে। তবে প্রতিযোগিতার জায়গাটা অনেক বেশি। পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে বেশ প্রতিযোগিতার জায়গাগুলো পেরিয়েই তাকে কাজ করতে হচ্ছে।
অনেক ক্ষেত্রে নারীরা পরিবারকে, সন্তানকে সময় দিতে গিয়ে এই চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করতে হিমশিম খান। এক্ষেত্রে নারী সাংবাদিকদের জন্য ডে-কেয়ার সেন্টার থাকা খুব জরুরি। যেখানে নারীরা তাদের শিশুদের নিশ্চিন্তে রেখে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।
প্রশ্ন : নারী সাংবাদিকদের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং গুনগত মানের বিষয়টি সম্পের্ক আপনার বক্তব্য কি?
সোমা দেব : সংখ্যাবৃদ্ধি এবং গুণগত মান এই বিষয়টি এমন একটি বিষয় যে, একটিকে ছাড় দিয়ে অন্যটিকে টিকিয়ে রাখার যৌক্তিকতা খুবই কম। শুধুমাত্র সংখ্যা বাড়ানো নয় বা শুধুমাত্র গুণগত মান বাড়ানোই নয়। বর্তমান সময়ে দুইটি বিষয়ের প্রতিই গুরুত্ব দিতে হবে। বর্তমানে দেশের পাঁচটি পাবলিক এবং বেশ কিছু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিষয়টির ওপর পাঠদান করা হচ্ছে। এখান থেকে শিক্ষাগ্রহণ এবং সাংবাদিকতা বিষয়টির ওপর প্রশিক্ষণ নেওয়ার মাধ্যমে একজন নারী তার গুণগত মান বজায় রাখতে পারে। পুরুষদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
তাছাড়া নারী সাংবাদিকদের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করাও জরুরি। সহকর্মীদের আন্তরিক প্রচেষ্টা এখানে অনেক বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখে। একজন নারী যখন প্রথম সাংবাদিকতা পেশায় আসেন তখন তাকে আন্তরিকতার সাথে পেশাগত দায়িত্ব পালনে সবার সহযোগিতা করা দরকার বলে আমি মনে করি। শুধুমাত্র পেশায় ওয়েলকাম জানানোই নয়, সংখ্যাবৃদ্ধিই নয়, তাকে যোগ্য এবং সঠিক সাংবাদিকতায় পরিচালিত করাও জরুরি।
প্রশ্ন : বলা হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপরের পদগুলোতে নারী নেই। এমন কি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায়ও নারী নেই। বিষয়টি বুঝিয়ে বলুন।
সোমা দেব : উপরের পদ বলতে বুঝায় সম্পাদক, নির্বাহী সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক, প্রধান প্রতিবেদকসহ বিভিন্ন পদ। এটা সত্যি যে, বর্তমানে বাংলাদেশে হাতে গোনা কয়েকটি পত্রিকায় বা নিউজ চ্যানেলে উপরের পদে নারীদের দেখা যায়। এর একটা প্রধান কারণ আমাদের সামাজিক বাস্তবতা, ইন হাউজ পলিটিক্স, মানসিকতার দৈন্যতা। অনেক ক্ষেত্রেই নারীদের এতটা প্রতিবন্ধকতা পার হয়ে আসতে হয় যে, বড় বড় পদগুলোতে পৌছানোর আগেই তারা সাংবাদিকতা পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। আবার সেই পদগুলোতে পুরুষ আধিপত্য এতটাই বেশি যে, নারী কোণঠাসা হয়ে থাকেন পুরুষের কাছে। তার যোগ্যতা এবং মেধা থাকা সত্ত্বেও।
যেখানে নারীরা এখনো তার নিরাপত্তা পাচ্ছেনা, রাস্তায় পুলিশের দ্বারা নিগ্রহের শিকার হচ্ছে, রক্ষক যখন ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে, পারিবারিক, সামাজিক প্রতিটা ক্ষেত্রে যুদ্ধ করে এগিয়ে যাচ্ছে যেখানে পদের জন্য লড়াইটা তার জন্য অত্যন্ত কঠিন বলে আমি মনে করি।
আমরা জানি নারীরা কোণঠাসা, তারা তাদের ন্যায্য অধিকার এখনো পায়নি। অনেক ক্ষেত্রে সম্মানটুকুও পায়নি। তাই সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের বিষয়টি ততোধিকই দুর্বল। আমরা নারীর অধিকারের বিষয়ে কথা বলি, তার ক্ষমতায়নের কথা বলি। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও এই ক্ষেত্রগুলোতে নারীদের এগিয়ে আসতে হবে, পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব পরিহার করে তাদের সুযোগ করে দিতে হবে। সময় লাগবে তবে হবে, কারণ অনেক বাধা পেরিয়ে নারীরা সাংবাদিকতায় অনেক এগিয়ে গেছেন।