Web bengali.cri.cn   
সবজি ও ফলের স্বর্গ চীনের শউকুয়াং
  2015-05-05 13:13:54  cri

শুরুতেই বলতে চাই, এই লেখাটি লেখার আগে দীর্ঘ সময় ধরে ভেবেছি কি নামে ডাকলে যথার্থ নামেই ডাকা হবে চীনের শানতুং প্রদেশের এই শউকুয়াং শহরকে । ভাবতে ভাবতে বিখ্যাত পর্যটক মার্কো পোলোর কথা মনে হলো। মার্কো পোলো বলেছিলেন, শ্রীলংকা হলো তাঁর চোখে দেখা একটি সুন্দর দ্বীপ।

হ্যাঁ, একজন ক্ষুদ্র মানুষ হিসেবে আমিও বলতে চাই, আমার চোখে শউকুয়াং হলো সবজি ও ফলের স্বর্গ।

চীন আন্তর্জাতিক বেতারের বাংলা বিভাগ থেকে ১৯ এপ্রিল আমি ও আমার চীনা সহকর্মী আকাশ ভাই (শিয়েনান) শউকুয়াংয়ের উদ্দেশে রওয়ানা হই। দীর্ঘ ট্রেন ভ্রমণের পর অবশেষে ওয়েইফাং (শানতুং) শহরে পোঁছাই। সেখান থেকে গাড়িতে করে প্রায় ৪০ মিনিটি পর পৌঁছাই শউকুয়াং শহরে।

পরিষ্কার, সবুজ, শান্ত ও স্নিগ্ধ শউকুয়াংয়ের রাস্তাঘাট দেখেই মনে হচ্ছিল এবার আমার গন্তব্য নিশ্চয়ই ছায়াঘেরা সুনিবিড় কোনো স্থানে, যা আমার সবসময়ের স্বপ্ন ও প্রত্যাশা ।হ্যাঁ, অনেক দিন পর আমার সে স্বপ্ন পূরণ হলো। আমি সত্যিই এমন এক সুন্দর শহরে প্রবেশ করলাম যা আমার ভাবনার চেয়েও অনেক বেশি সুন্দর ।

আমাদের বহনকারী গাড়িটি শউকুয়াং হোটেলে পৌঁছানোর সাথেই সাথেই ছুটে এলেন কয়েকজন যুবক। তারা আমাদের সম্ভাষণ জানিয়ে হোটেলের রিসিপশনে নিয়ে গেলেন। রিসিপশনে যখন প্রয়োজনীয় কাজ নিয়ে ব্যস্ত তখন দেখি আমার প্রতি সবাই যেন আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছেন এবং কথা বলতে চাইছেন। বুঝতে পারলাম আমি বিদেশি তাই আমার প্রতি তাদের আগ্রহ একটু বেশি । আমিও ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দে তাদের সাথে চীনা ভাষা বলা শুরু করলাম । যতটুকু বুঝলাম এরা অনেক বেশি আন্তরিক ও সরল ।

২০ এপ্রিল সকালে নাস্তা খেয়ে রওয়ানা হলাম শউকুয়াং সবজি মেলার স্থানে। ১৬তম চীন শউকুয়াং সবজি প্রযুক্তি মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান এদিন সকালে শউকুয়াং শহরে অনুষ্ঠিত হয়। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির ভিত্তিতে কৃষির সুফল প্রতিষ্ঠার আন্তর্জাতিক প্লাটফর্ম তৈরি করার লক্ষে এ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। চল্লিশ দিনের এ মেলাটি শউকুয়াং আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী কেন্দ্রে শুরু হয়। কথা বলে জানলাম, এ মেলায় দুই হাজার প্রজাতির সবজি ও ফল প্রদর্শন করা হচ্ছে। একটি প্রধান প্রদর্শনী হল ও ১২টি শাখা প্রদর্শনী হলে এসব প্রদর্শন করা হচ্ছে।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর প্রদর্শনী দেখতে ধীরে ধীরে আমরা বিভিন্ন হলে প্রবেশ করি ।

বিশাল হলের মধ্যে যখন প্রবেশ করি তখন দেখি এক ভিন্ন চিত্র। প্রথমেই ভীষণ অবাক হয়ে উঠি। মনে মনে ভাবি কোথায় প্রবেশ করলাম! আমার না দেখা হাজার রকমের সবজি ও ফলের সমাহার যেন আমাদের ঘিরে। এতো বিশাল, এতো বৈচিত্র্য, এতো রঙিন! যেন ফল ও সবজির রাজ্য! কি নেই এখানে?

মনে হলো এটি কোনো হল নয়, এটি বিশাল বিস্তীর্ণ একটি মাঠ। নানান প্রজাতির সবজি, ফল ও এসব গাছের প্রদর্শনী।

সারিবদ্ধভাবে বিভিন্ন সবজি গাছ দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই এটা কেবল প্রদর্শনীর জন্যই করা হয়েছে। মনে হলো এটাই যেন সবজি ক্ষেত, সবজি মাঠ, সবজি বাগান ।

বিভিন্ন প্রজাতির সবজি, ফলমূলের চিত্র এখানে তুলে ধরা হয়েছে । আগে আমি বিভিন্ন ধরনের সবজি গাছ দেখেছি, দেখেছি বিভিন্ন ধরনের বেগুনও, কিন্তু এখানে যে ধরনের সবজি গাছ, ফলমূল ও বেগুন আমার চোখে পড়লো তা সত্যিই রীতিমতো আশ্চর্যের। কালো, সাদা ছাড়াও অন্যান্য রঙের বেগুন যখন দূর থেকে দেখছিলাম তখন মনে হচ্ছিল বিশাল বিশাল সাপ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে । না, এগুলো সাপ নয়, এগুলো শউকুয়াংয়ের ঐতিহ্যবাহী বেগুন।

বিভিন্ন ধরনের মরিচ, ক্যাপসিকাম, টমেটো, কুমড়া, শসা থেকে শুরু করে অসংখ্য সবজি ও ফলের সমাহার চোখে পড়ে আমাদের।

মজার ব্যাপার হলো এই প্রদর্শনীতে সবজি ও ফলমূলের গাছগুলোকে এমনভাবে প্রদর্শন করা হয় যা আমার দৃষ্টিতে নতুন এক শিল্প।

প্রদর্শনী দেখতে দেখতে হঠাত টিপ টিপ পানির শব্দ শুনতে পাই। উত্স খুঁজতে গিয়ে দেখি গাছে মেশিন দিয়ে পানি দেয়া হচ্ছে। জানতে পারি এটা সবজি চাষের একটি পদ্ধতি। এই পদ্ধতিকে রোলিং পাইপলাইন চাষ পদ্ধতি বলা হয়। এই পদ্ধতিতে গাছের টবগুলোকে সুন্দর করে সাজিয়ে মেশিনের পাইপে লাগানো হয়। মেশিন চালু করার পর পাইপ যখন ঘুরতে থাকে তখন গাছের টবগুলোও ঘুরতে থাকে এবং তখন প্রতিটি টবের ভিতরে পানি প্রবেশ করে ।

ঠিক এর পাশেই চোখে পড়লো প্যাঁচানো এক ধরনের গাছ। আসলে এই গাছগুলো প্যাঁচানো একটি ফ্রেমকে ঘিরে বড় হচ্ছে । হ্যাঁ!, জানতে পারি, স্থানীয়ভাবে এই গাছকে প্যাগোডা গাছ বলা হয় । কেননা এই গাছ পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বড় হতে হতে শেষপর্যন্ত প্যাগোডার মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।

প্যাগোডা গাছ দেখতে দেখতে একটু দূরেই গাছের দেয়ালের মতো একটি দেয়াল চোখে পড়ে। কাছে গিয়ে দেখি এটি একটি গাছের দেয়াল। মানে পুরো দেয়াল জুড়ে ছোট ছোট গাছ লাগানো । জানতে পারি, ঘরের দেয়ালে এ ধরনের সবজি চাষ করা হয়। বিশেষভাবে তৈরি ঘরের দেয়ালে কিভাবে সবজি চাষ করা যায় তা তুলে ধরা হয়েছে এখানে । দেয়ালের পাশাপাশি বাড়ির ব্যালকনিতে সবজি চাষের পদ্ধতিও তুলে ধরা হয়েছে । এ পদ্ধতিতে কিভাবে বাড়ির ব্যালকনিতে সবজি চাষ করা হয় তা দেখানো হয়েছে ।

প্রদর্শনী দেখতে দেখতে হঠাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি হাতে সময় বেশি নেই, মানে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আমাদেরকে গাড়ির কাছে ফিরে যেতে হবে । তাই যতটা সম্ভব এই হলের প্রদর্শনী তাড়াতাড়ি দেখা শেষ করে আমরা পাশের হলে প্রবেশ করি।

পাশের হলের প্রদর্শনী আরো চমত্কার, আরো মুগ্ধকর, আরো প্রশংসনীয়। এককথায় যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আগের হলে আমরা সবজি ও ফলমূলসহ এসব গাছের প্রদর্শনী দেখেছি। কিন্তু এই হলে সবজি ও ফল দিয়ে বিভিন্ন ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে । সারা চীনের বিখ্যাত বিখ্যাত নিদর্শন ও ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিকে ফল ও সবজি দিয়ে তৈরি ভাস্কর্যের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে দর্শকদের কাছে ।

শুধু তাই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানেরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু নিদর্শন তুলে ধরা হয়েছে এখানে । জানা গেছে, এ হলের এ প্রদর্শনীতে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চল অংশ নিয়েছে ।

এ হলের প্রদর্শনীতে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে বিভিন্ন ঘরবাড়ি, বিভিন্ন অঞ্চল, বিভিন্ন ধরনের মানুষ ও তাদের রীতিনীতি, জীবনধারাসহ সে অঞ্চলের কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে ।

হলে প্রবেশ করেই কিছু মানুষ দেখতে পাই, কাছে গিয়ে দেখি বিভিন্ন ফল দিয়ে এসব মানুষ তৈরি করা হয়েছে। চীনের সিনচিয়াংয়ের ঘরবাড়ি, মানুষ ও তাদের রীতিনীতিই যেন এখানে দৃশ্যমান।

পাশেই বিশাল একটি নৌকা। নৌকাটি দেখেই টাইটানিকের কথা মনে পড়লো আমার । তবে এটি টাইটানিক নয়, এটি চীনের ঐতিহ্যবাহী নৌকা। পাল তুলে দু'জন যাত্রী সবজি নিয়ে ছুটে চলেছেন দূরে, বহুদূরে। এটি সত্যিকার কোনো সাগর বা সমুদ্র নয়; তবে দেখতে যেন একদম সাগরের মতোই। হুবহু সাগরের মতো করেই একটি সাগর তৈরি করে তাতে এই নৌকাটি ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে। অবাক করার বিষয় হলো আর এ সবকিছুই তৈরি হয়েছে বিভিন্ন ধরনের ফল দিয়ে।

ভিতরে ঘুরতে ঘুরতে হঠাত করেই রূপকথার সেই পরীর কথা মনে পড়লো। হ্যাঁ, তার কথা মনে পড়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কারণ হলো এখানে রূপ কথার সেই পরীকে তুলে ধরা হয়েছে । একটি সুন্দর বাড়ি, বাড়িটি গাছে ঘেরা। ঘরের চালের উপর একজন সুন্দরী পরি ডানা মেলে বসে আছেন। বিভিন্ন ধরনের ফল ও গাছ দিয়ে এই দৃশ্যটি তৈরি করা হয়েছে; দেখতে যেন একেবারেই বাস্তব।

আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) জ্ঞান অর্জনের জন্য সুদূর চীনে যাবার কথা বলেছেন। ছোটোবেলায় এই কথাটির মানে খোঁজার অনেক চেষ্টা করতাম। কিন্তু বুঝতে পারতাম না। তবে চীনে আসার পর সত্যি সত্যিই বুঝতে পারি আমাদের নবী কেন একথা বলেছেন। চীন যে কতটা সুন্দর, কতটা বৈচিত্র্যময়, কতটা রঙিন তা চীনে না আসলে হয়তো কোনোদিনই জানতে বা বুঝতে পারতাম না।

হ্যাঁ, প্রদর্শনী হলে চীনের এই অপরূপ সৌন্দর্যের কথা বারবার আমার মনে হচ্ছিল। কারণ এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে আমি যেন একটি পরিপূর্ণ অপরূপ সুন্দর চীনকে দেখতে পাচ্ছিলাম।

প্রদর্শনীতে ঘুরতে ঘুরতে দূরে একটি ঘোড়া দেখতে পাই, কাছে গিয়ে দেখি একজন বীর যোদ্ধা ঘোড়ায় চড়ে ছুটে চলেছেন। পাশেই রয়েছে আরো বেশ কয়েকটি ঘোড়া। জানতে পারি চীনের প্রাচীনকালের ঐতিহ্যবাহী ঘোড়া এবং মানুষের যুদ্ধযাত্রার অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে । চীনের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন জাতের ঘোড়াও প্রদর্শন করা হয়েছে এখানে।

এই প্রদর্শনী দেখা শেষ করে যখন অন্য প্রদর্শনী দেখতে পা ফেলেছি তখনই ডাক পড়লো গাড়িতে ফিরবার। কারণ আমাদের হাতে সময় নেই। যতটুকু সময় হাতে আছে তাতে করে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে আমাদের গাড়ির কাছে যেতে হবে। তাই কি আর করা, দ্রুত প্রদর্শনী হল থেকে বের হয়ে যাত্রা শুরু করলাম গাড়ির উদ্দেশে।

(এনামুল হক টুটুল/ শিয়েনান আকাশ)

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
Play
Stop
ওয়েবরেডিও
বিশেষ আয়োজন
অনলাইন জরিপ
লিঙ্ক
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040