Web bengali.cri.cn   
অন্তঃর্মঙ্গোলিয়ার তৃণভূমিতেসাধারণ মানুষের সুখী জীবন
  2015-02-26 15:38:09  cri


প্রতি বছর চীনা সরকার অনেক প্রতিবেদন বা দলিল প্রকাশ করে। এর মধ্যে প্রথম দলিলটিকে আমরা ডাকি 'এক নম্বর দলিল' নামে। তো, গত ১৫ বছর ধরে এই এক নম্বর দলিলটি প্রকাশিত হয়ে আসছে দেশের গ্রাম, কৃষক ও কৃষির সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সম্বলিত হয়ে। চলতি বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এবারের এক নম্বর দলিলে বলা হয়েছে, কৃষকের আয় বাড়াতে হবে। আয় বাড়ানোর জন্য কিছু দিক্‌নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে দলিলে।

খামারবাড়ি ভ্রমণ চীনে জনপ্রিয় একটি পর্যটনপদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে কৃষকের বাড়িতে পর্যটকরা অস্থায়ীভাবে বসবাস করেন। এখানে তারা নিজেরা রান্নাবান্না করতে পারেন এবং কৃষকের জীবনযাপন পদ্ধতি ও কৃষিকাজ সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেন। অন্তঃর্মঙ্গোলিয়া পাও থুও শহরের তা মাও জেলা খামারবাড়ি ভ্রমণের জন্য বিখ্যাত। এখানে তৃণভূতিতে ক্যাম্পিং সাইট নির্মাণ করা হয়েছে। যেসব পর্যটক নিজের গাড়ি চালিয়ে আসেন, তারা এখানে বসবাস করতে পারেন। এখানকার পরিবেশ ভাল। পর্যটকরা এখানে এসে তৃণভূমির সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হন। এই পর্যটন-পদ্ধতির ফলের এ জেরার কৃষক ও পশুপালকদের আয় দিন দিন বাড়ছে।

উ লান হু সাধারণ একজন পশুপালক। আপনি যদি তার বাড়িতে যান, ঢুকতেই শুনতে পাবেন ছাগলের ডাক। তবে এখন উ লান হুর মূল পেশা ছাগলপালন নয়। তিনি এখন তৃণভূমিতে একটি ক্যাম্পিং সাইটের মালিক এবং তার অতিথিকে তাজা গোশত খাওয়ানোর জন্য তিনি ছাগল লালন-পালন করেন।

আগে উ লান হু ও তার পরিবার পেশাদার পশুপালক ছিল। তবে তৃণভূমিতে লোকসংখ্যা দিন দিন বাড়ায় এবং তৃণভূমির আয়তন দিন দিন কমে যাওয়ায় তিনি পশুপালনের মাধ্যমে জীবিকা অর্জনের ধারণা থেকে সরে আসেন। তিনি শহরে অন্য চাকরিতে যোগ দেন এবং পরে এক বন্ধুর সঙ্গে ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু তার ব্যবসা জমে ওঠেনি। তাই তিনি বছর দুয়েক আগে জন্মভূমিতে ফিরে আসেন এবং তৃণভূতি ক্যাম্পিং সাইটের ব্যবসা শুরু করেন। তিনি বলেন,

"আমি অন্য একটি জেলায় গিয়েছিলাম। সেখানে দেখলাম সেখানে আমার কয়েকজন আত্মীয় তৃণভূমি ক্যাম্পিং সাইটের ব্যবসা করছেন। আমি এ ব্যাপারে তাদের সঙ্গে আলোচনা করি। আলোচনার পর ভাবলাম, নিজের জেলায় তৃণভুমির আয়তন দিন দিন কমে যাচ্ছে এবং আমাদের তিহ্যিক গোচারণ শিল্পের কোনো ভবিষ্যত নেই। যেহেতু আমার জেলায় Naadam দিবসের অনুষ্ঠান খুব জমে, তাই পর্যটনশিল্প সেখানে জমতে পারে বলেই আমার মনে হলো।"

২০১৩ সালে এ জেলায় মাত্র দুই-তিনটি ঐতিহ্যবাহী তাবু খাটিয়ে পর্যটন ব্যবসা শুরু হয়েছিল। আর বর্তমানে সেখানে বিশালকৃতির তাবু আছে ২৭টি। এসব তাবুতে একসঙ্গে ১০০ লোক বাস করতে পারেন এবং তিন শতাধিক লোক খাওয়া-দাওয়া করতে পারেন। এ শিল্প উন্নয়নের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সাহায্য-সহযোগিতা করা হচ্ছে। স্থানীয় পশুপালকরা এ শিল্পে বিভিন্ন ধরনের সেবা সরবরাহ করে নিজেদের আয় বাড়িয়ে নিতে পারছে।

তা মাও জেলা পর্যটন ব্যুরোর প্রধান সুন ফু সান বলেন, অন্তঃর্মঙ্গোলিয়াকে তৃণভূমি সংস্কৃতি প্রদর্শনের এবং উত্তর চীনের পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত করা সরকারের লক্ষ্য। এখানে নিজে নিজে ব্যবসা দ্বার করানোর সুযোগ আছে। তিনি বলেন,

"যে কেউ ইচ্ছা করলে, ক্যাম্পিং সাইট নির্মাণ করতে পারেন। তবে, এর জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করতে হবে। আবেদনপত্রে উল্লেখ থাকতে হবে আপনার প্রজেক্ট প্রপোজাল। আপনি কী ধরনের ব্যবসা করতে চান? কতো টাকা বিনিয়োগ করতে চান? এসব তথ্য থাকতে হবে আবেদনপত্রে। আপনার প্রকল্পের আকার অনুসারে আপনি আর্থিক সহায়তাও সরকারের কাছ থেকে পেতে পারেন।"

২০১৩ সাল থেকে তা মাও জেলায় দু'বার চীনা যাযাবর সংস্কৃতি পর্যটন উত্সব আয়োজন করা হয়। পর্যটক আকষর্ণের জন্য সাংস্কৃতিক, ক্রীড়া, পর্যটন ও বাণিজ্যিকসহ তিন শতাধিক বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় তখন।

তা মাও জেলা পর্যটন ব্যুরোর প্রধান সুন ফু সান বলেন, "চীনা যাযাবর সংস্কৃতি পর্যটন উত্সব প্রায় ৮০-৯০ দিন ধরে চলে। ২০১৩ ও ২০১৪ সালে আমাদের জেলায় পর্যটকের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১৪ লাখ ও ১৫.৩ লাখ। আশা করছি, চলতি বছর পর্যটকের সংখ্যা ২০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে।"

৩৭ বছর বয়সি উ লান হু মনে করেন, এখানে পর্যটন খাতে ব্যবসায় উন্নতি করতে হলে তাকে এখনো অনেককিছু শিখতে হবে। তিনি বলেন

"আমি কিছু শিখতে চাই এবং জেলার বিভিন্ন প্রশিক্ষণকেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নিতে চাই। ভাল ব্যবসা করতে চাইলে শিখতে হবে।"

উ লান হু জানালেন, তিনি তৃণভূমিতে জন্মগ্রহণ করলেও, নিজ জেলার ইতিহাস সম্পর্কে তেমন কিছু জানেন না। তিনি আশা করেন, এ ব্যাপারে লেখাপড়া করার পর অতিথিদের তিনি তার জন্মস্থানের কাহিনী শোনাতে পারবেন। উ লান হু নিজের ক্যাম্পিং সাইটের প্রচারের জন্য একটি ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান। তার আশা, একটি ভালো ওয়েবসাইট তার ব্যবসাকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাবে। তিনি আরো চান, তার জন্মভূমি সম্পর্কে লোকে জানবে এবং এ জায়গাটিকে ভালোবাসবে।

প্রিয় শ্রোতা এতক্ষণ আপনারা চীনের ইনার মঙ্গোলিয়ার পশুপালক উ লান হুর গল্প শুনলেন।

এখন আমরা একজন প্রবীণ ও তার নতুন বাসা দেখতে যাব।

৫৮ বছর বয়সি লাও লিয়াং অন্তঃর্মঙ্গোলিয়ার তা মাও জেলার একজন পশুপালক। তিনি কাঁচা ঘরে ৫০ বছরের মতো বসবাস করেছেন এবং এ বছর তিনি নতুন ইটের বাসায় ছেলে-মেয়েদের নিয়ে বসন্ত উত্সব উদযাপন করছেন।

লি লিয়াং বললেন, আগে তার ছেলে সপ্তাহে একবার তাকে দেখতে আসতো। কারণ, তার পক্ষে কাঁচা ঘরে বসবাস কর কঠিন। কাঁচা ঘরে গ্রীষ্মকাল বা শীতকালে বসবাস করা মুশকিল।

কিন্তু এখন সে সমস্যা নেই। লাও লিয়াংয়ের নতুন বাড়ির দুটি শয়নকক্ষ, একটি বৈঠকখানা এবং একটি ডাইনিং রুম আছে। বাসার বাইরে একটি উঠান। উঠানের পিছনে লাও লিয়াং করেন ছাগল ও শূকর পালেন। শীতকালেও লাও লিয়াংয়ের নতুন বাড়ি উষ্ণ থাকে। ১ লাখ ২৫ হাজার ইউয়ান মূল্যের এ বাড়ি পেতে লাও লিয়াংকে ব্যয় করতে হয়েছে মাত্র ২৫ হাজার ইউয়ান। বাকি টাকাটা সরকার ভাতা হিসেবে দিয়েছে। আসলে এ ভাতা অন্তঃর্মঙ্গোলিয়া সরকারের গণকল্যাণনীতির অংশ। ২০১৪ সাল থেকে অন্তঃর্মঙ্গোলিয়ায় শুরু হয় পুরাতন বাসা রূপান্তর এবং গ্রামে নিরাপদ পানীয় ও বিদ্যুত সরবরাহ প্রকল্প। লাও লিয়াংর গ্রাম এ প্রকল্পের আওতায় অনেক বদলে গেছে। লাও লিয়াংয়ের মতো গ্রামের ১০০টি পরিবার নতুন বাড়ি পেয়েছে। তা মাও জেলা কৃষি ও শিল্প বিভাগের প্রধান উ ছুন পাও বললেন, এটা হল সাম্প্রতিককালে নেওয়া তা মাও জেলার বৃহত্তম প্রকল্প। এ প্রকল্পে আওতায় স্থানীয় কৃষক ও পশুপালকদের জীবনমান উন্নয়নে সরকার ৫০ কোটি ইউয়ান বরাদ্দ দিয়েছে। এখন এ গ্রামে কোনো কাঁচা রাস্তা, ঘর ও দেওয়াল নেই।

নতুন বাসা ও সুবিধাজনক পরিবেশ পাওয়ার পর লাও লিয়াং পয়সা কামানোর চিন্তা করেন। তার উদ্যোগে কয়েকজন গ্রামবাসি একটি সমবায় প্রতিষ্ঠা করেন। সরকারি ভাতা ও নীতির ফলে লাও লিয়াং এখন আরও বেশি আয় করতে পারেন।

৬৬ হাজার বর্গমিটার জমিতে লাও লিয়াং ও তার স্ত্রী আলু ও সূর্যমুখী চাষ করেন এবং তারা কালো শূকর পালন করেন। এখন প্রতি বছর লাও লিয়াং ও তার স্ত্রীর আয় ৪০ হাজার ইউয়ান।

সরকারি সাহায্যে লাও লিয়াংয়ের আলু ও শূকর বাজারজাত করাও এখন সহজতর হয়েছে। ফলে তার আয় বেড়েছে।

প্রিয় শ্রোতা এতক্ষণ আপনারা ইনার মঙ্গোলিয়ার প্রবীণ নাগরিক লাও লিয়াংয়ের গল্প শুনলেন।

এখন শুনুন একটি মঙ্গোলিয়ান সংগীত।

আপনারা জানেন, অন্তঃর্মঙ্গোলিয়ার গরু ও খাসীর মাংস চীনে বিখ্যাত। তবে পশুপালন শিল্পের মাধ্যমে পশুপালকরা বেশি আয় করে পারেন না। নিজেদের পশুজাত পণ্যের ব্র্যান্ড তৈরি করা অন্তঃর্মঙ্গোলিয়ার পশুপালকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তা মাও জেলায় সরকার, পশুপালক ও বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের যৌথ প্রচেষ্টায় পশুপালন এবং পশুজাত পণ্যের প্রক্রিয়াকরণ ও প্যাকেজিংসহ বিভিন্ন কাজ উন্নত হয়েছে। বর্তমানে এখানকার গরুর ও খাসীর মাংসের পণ্য গোটা চীনের বাজারে পাওয়া যায়।

হু সি থু লে ১৯৮৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং তিনিও পশুপালন সমবায়ের প্রধান। তিনি বললেন

"১৭ বছর বয়স থেকে আমি গরু এবং খাসীর মাংস ক্রয় করে তা বিক্রি করার ব্যবসা শুরু করি। এখান থেকে মাংস কিনে অন্য জায়গায় বিক্রি করাই আমার ব্যবসা। একসময় আমি আবিষ্কার করি যে, অন্য শহরে আমাদের গরু এবং খাসীর মাংসের দাম বেশি। পরে আমি সমবায় প্রতিষ্ঠা করতে চাইলাম। কিন্তু তখনো আমি নিজেই গরু ও খাসী পালন করে তা বিক্রি করার পরিকল্পনা করিনি। বাজারে প্রসেসকৃত গরু ও খাসীর মাংস জনপ্রিয়। তাই আমরা মন দিয়ে পণ্যের প্রক্রিয়াকরণ কাজ করতে শুরু করি।'

বর্তমানে হু সি থু লে নিজের ব্র্যান্ড 'মাও মিং আন' গড়ে তুলেছেন এবং পশুপালক হিসেবেও স্বীকৃতি পেয়েছেন। হু সি থু লে বলেন,

"তা মাও জেলার খাসীর মাংসের মান অনেক ভাল। বিশেষ করে dorper sheep-এ মাংস বেশি, চর্বি কম। যখন আমাদের সমবায় প্রতিষ্ঠিত হয় তখন এর সদস্য ছিল মাত্র ৫টি পরিবার। আর বর্তমানে আমাদের সদস্য ১৫০টি পরিবার। আমাদের সমবায় বাজারদামের চেয়ে উচ্চ দাম নিয়ে পশুপালকদের কাছ থেকে খাসী সংগ্রহ করে। পশুপালকরা আমাদের সমবায় অনেক পছন্দ করে।"

তা মাও জেলা কৃষি ও পশুপালন ব্যুরো পেইচিং, সাংহাই ও হহটসহ নানা বড় শহরে তা মাও কৃষি ও পশুজাত পণ্যের দোকান খুলেছে। দোকানগুলো তা মাও জেলার কৃষি ও পশুজাত পণ্য বিক্রয় করে, প্রচার করে। তা মাও জেলা কৃষি ও পশুপালন ব্যুরোর প্রধান আ লা থেং পা কেন বলেন,

"সমবায়ের কোনো পণ্য এসব দোকানে ওঠালে সরকার সে পণ্যের ওপর বিশেষ ভর্তুকি দেয় এবং অন্যান্য সহায়তাও দেয়। আর দোকানে কোনো পণ্যের বিক্রয় ৩০ লাখ ইউয়ান ছাড়িয়ে গেলে সরকার এর ৩০ শতাংশ ভাতা হিসেবে সমবায়কে ফিরিয়ে দেয়।"

জানা গেছে বর্তমানে তা মাও দোকানে ২৬টি কোম্পানি বা সমবায়ের পণ্য বিক্রি হয় এবং ৭ হাজার পরিবার এর থেকে উপকৃত হচ্ছে।

আ লা থেং পা কেন বলেন, সরকার এসব পণ্যের জন্য নতুন মানদন্ড তৈরি করেছে। যে পণ্য দোকানে বিক্রি হয় তা ব্র্যান্ড, প্যাকেজিং, কর্পোরেট খাদ্য উৎপাদন লাইসেন্সসহ নানা বিষয়ে শর্ত পূরণ করতে হয়।

চীন বিশ্বের বৃহত্তম কৃষিপণ্য উত্পাদনকারী দেশ। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে চীনা কৃষিপণ্যের ব্রান্ড বেশি নয়। চীনা কৃষি মন্ত্রী হান ছাং ফু সম্প্রতি অনুষ্ঠিত চীনা কৃষিবিষয়ক সম্মেলনে বলেছেন, চীনের কৃষিপণ্যের বিখ্যাত ব্র্যান্ড তৈরি হওয়া উচিত। তিনি আরো বলেন, গুরুত্বপূর্ণ কোম্পানি ও সমবায়ের নেতৃত্বে তৃণভূমি গরু এবং খাসীর মাংস ও মাংসজাত পণ্যের নিজস্ব ব্রান্ড তৈরি করতে হবে।

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
Play
Stop
ওয়েবরেডিও
বিশেষ আয়োজন
অনলাইন জরিপ
লিঙ্ক
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040