1203
|
১২ সেং সিয়াও অর্থাত ১২ রাশিচক্র হল যথাক্রমে: ইঁদুর,গরু,বাঘ,খরগোশ ,ড্রাগন,সাপ,ঘোড়া,ছাগল,
বানর, মুরগী,কুকুর,শূকর।
প্রাচীনকালের মানুষেরা এক দিন অর্থাত ২৪ ঘণ্টাকে ১২ অংশে ভাগ করেন। প্রতি দু ঘণ্টা এক সি চেন এবং প্রতি সি চেনকে একটি সেং সিয়াও দিয়ে নামকরণ করেন।
যেমন রাত১১টা থেকে রাত ১টা হলো ইঁদুর সময়। এই সময় হলো এক দিনের শেষ সময় এবং নতুন আরেক দিনের সূচনা। ইঁদুর হলো ১২ সেং সিয়াওয়ের প্রথমটা।
রাত ১ টা থেকে রাত ৩টা হলো গরু সময়। গরু এ সময় থেকে জমিতে কাজ করা শুরু করে ইত্যাদি। এভাবে এক একটি পশু দিয়ে এক একটি নামকরণ করা হয়।
১২ সেং সিয়াও সম্পর্কিত কিংবদন্তী
অনেক অনেক বছর আগে আকাশের রাজা ইউয়ু হুয়া একটি আদেশ জারী করেন যে, ১২টি পশু বাছাই করতে হবে যারা একদিনের ১২ সি চেনকে প্রতিনিধিত্ব করে। প্রথমে ১২টা পশুকে তাঁর সামনে হাজির করতে হবে এবং তাদেরকে ক্রম অনুসারে নির্বাচিত করা হবে।
বিড়াল ও ইঁদুর ছিল খুবই ভাল বন্ধু। তারা এ খবর শুনে খুবই খুশি হয়। বিড়াল ইঁদুরকে বলে, কাল আমরা একসাথে রাজপ্রাসাদে যাব। তবে আমি তো সকালে সহজে ঘুম থেকে উঠতে পারিনা তাই যখন তুমি যাও আমাকে ঘুম থেকে জেগে দিও। ইঁদুর বলে, কোনো সমস্যা নেই ভায়া।
তবে পরদিন সকালে ইঁদুর ঘুম থেকে উঠে বিড়ালকে না বলেই একা একা রাজপ্রাসাদে রওয়ান হয়।
ইঁদুর,গরু,বাঘ,খরগোশ ,ড্রাগন,সাপ,ঘোড়া,ছাগল,
বানর, মুরগী,কুকুর,শূকর ১২টি পশু রাজপ্রাসাদে এসে উপস্থিত হয় এবং রাজা তাদেরকে নিয়ে ক্রম করেন।
এসময় শূকর সুপারিশ করে বলে, রাজা, আপনি এত ব্যস্ত, তাই আমি আপনার জন্য এক কাজ করতে পারি। আমি তত্ত্বাবধায়ক হতে চাই এবং আমরা নিজেরাও ক্রম করতে পারবো।
রাজা এ কথা শুনে খুব খুশি হন। তিনি শূকরের উপর দায়িত্ব দিয়ে সেখান থেকে চলে যান।
তবে রাজা চলে যাবার পরপরই উপস্থিত সকলে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে।
প্রথমে সবাই এক মত হয় যে, গরু অনেক উদার তাই তার প্রথম স্থানে থাকা উচিত। এ কথা শুনে ইঁদুর প্রতিবাদ করে বলে,আমিই সবচেয়ে বড় তাই আমার প্রথম স্থানে থাকা উচিত। আপনারা যদি আমার কথা বিশ্বাস না করেন তাহলে আমরা প্রতিযোগিতা করতে পারি।
প্রতিযোগিতার জন্য গরু ও ইঁদুর মানুষের মধ্যে আসে। মানুষ যখন গরুকে দেখে তখন তাদের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। কারণ এটি সাধারণ একটি ব্যাপার। তবে ইঁদুর যখন গরুর মাথার উপর দাঁড়ায় তখন মানুষ ইঁদুরকে দেখে অবাক হয়। তারা চিত্কার করে বলে, দেখো দেখো এত বড় একটি ইঁদুর! এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা লাঠি নিয়ে ইঁদুরকে হত্যা করতে চায়। তবে মানুষ যখন লাঠি নিয়ে ফিরে আসে তখন ইঁদুর দূরে পালিয়ে যায়।
রাজপ্রাসাদে ফিরে এসে ইঁদুর গর্ব করে বলে, মানুষ তাকে বড় বলেছে তাই তার প্রথম স্থানে থাকা উচিত। এ কথায় কেউ রাজি হয় নয়, তবে শূকর মনে মনে ভাবে, ইঁদুরকে প্রথম স্থানে এবং গরুকে দ্বিতীয় স্থানে রাখা উচিত। কারণ সে ভাবছে এতে হয়তো সে নিজে একটি ভাল স্থান অর্জন করতে পারবে।
এ অবস্থা দেখে বাঘ ও ড্রাগনের খুব রাগ হয় এবং তারা গর্জন করে উঠে। তাদের গর্জন শুনে উপস্থিত অন্যরা ভয় পাওয়া শুরু করে । মুরগীর আগে দুটি শিঙ ছিল, ড্রাগনকে শান্ত করার জন্য সে তার শিঙ দু'টো তাকে দিয়ে দেয়।
সবাই বাঘকে বনের রাজা হিসেবে ও ড্রাগনকে আকাশের পশুর রাজা হিসেবে তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে রাখতে সম্মত হয়। তবে এ সময় খরগোশ বলে, 'আমার চেহারা ইঁদুরের মতো এবং ইঁদুরের চেয়ে আমার শরীর বড়। আমার ড্রাগনের আগে থাকা উচিত'। এ কথা শুনে ড্রাগন অসন্তুষ্ট হয়। সে খরগোশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে চায়।
কুকুরকে রেফারি হিসেবে ঠিক করে তারা দু'জন দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু করে ।
কুকুর ও মুরগীর সম্পর্ক ভাল নয়। মুরগী ড্রাগনকে তোষামোদ করে দেখে কুকুরের খুব রাগ হয়। তাই সে খরগোশকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেয়।
প্রতিযোগিতার জন্য কুকুর কাঁটায় পরিপূর্ণ গাছের রাস্তা বাছাই করে। প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ড্রাগন খরগোশের চেয়ে দ্রুতবেগে দৌড়ালেও গাছের শাখায় তার শিং আটকে পড়ে এবং সে সামনে যেতে পারেনা। এ সুযোগে খরগোশ সামনে চলে যায়। ড্রাগন পরাজয় মেনে নিয়ে খরগোশকে বিজয়ী ঘোষণা করে। তাই খরগোশের স্থান হয় চতুর্থ এবং ড্রাগন চলে যায় পঞ্চম স্থানে।
কুকুর খরগোশকে বলে, আমি তোমাকে সাহায্য না করলে তুমি বিজয়ী হতে পারতে না। খরগোশ বলে, আমি নিজের শক্তি দিয়ে ড্রাগনকে পরাজিত করেছি। এ কথা শুনে কুকুরের খুব রাগ হয় এবং খরগোশের সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতা করতে চায়।
কুকুর খরগোশকে ধরে ফেলে এবং খরগোশকে হত্যা করতে চায় বলে সে শাস্তি পায় এবং তাকে শেষ স্থানে রাখা হয়।
মুরগী তার শিঙ হারিয়েছে এবং সে পশু নয়। তাই তাকে শুধু কুকুরের আগে রাখা হয়।
এক পর্যায়ে শূকর বাকি পশুদের বলে, বানর ও সাপ সবরকম কাজ করতে সক্ষম। আপনাদের দু'জনকে কোন স্থানে রাখতে পারি আমরা? আলোচনার পর তারা আবার পরীক্ষা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সাপ ও বানর সাহায্য পাওয়ার জন্য যথাক্রমে ঘোড়া ও ছাগলকে আমন্ত্রণ জানায়।
সাপের ১২টি পা আছে, তাই ঘোড়া একটি কাপড় তৈরি করে তার নিচে নিজের পা লুকিয়ে রেখে সাপকে দৌড়াতে সাহায্য করে। এভাবে সাপ অনেক দ্রুত সামনে এগিয়ে যায়।
তবে ছাগলকে বানর পছন্দ করে না, তাই তাকে কোনো সাহায্য করে না। প্রতিযোগিতায় সাপ গাছে বা পানিতে, যেখানেই হোক না কেন ইচ্ছা মতো অনুষ্ঠান করতে পারে এবং তা দেখে মানুষ খুব খুশি হয়। তবে যখন বানর উল্টোভাবে থাকে তখন মানুষ তার পার্শ্বদেশ দেখে অনেক হাসাহাসি শুরু করে। বানর এতে অনেক লজ্জা পেয়ে গাছ থেকে পড়ে যায়।
শেষে বানরকে হারিয়ে সামনে চলে আসে সাপ। এমনকি ঘোড়া, ছাগলের সামনেও সে চলে আসে।
সব ক্রমবিন্যাস শেষ করে নিজেকে প্রথম স্থানে রাখে শূকর। তবে রাজা এ তালিকা দেখে শূকরকে তালিকার শেষ স্থানে রাখেন। কারণ শূকরের আচরণ দেখে রাজার খুব রাগ হয়। শূকর নিরপেক্ষ বিচার করতে পারে নি। শাস্তি দেয়ার জন্য রাজা শূকরকে সলিন জায়গায় পাঠান। তখন থেকে শূকর এমন জায়গায় বসবাস করতে শুরু করেন।
ইঁদুর বাড়ি ফিরে এসে খুশিতে নাচানাচি শুরু করে দেয়। বিড়াল শব্দ শুনে জেগে উঠে। সে ইঁদুরকে জিজ্ঞাস করে, আমরা কখন রাজপ্রাসাদে যাবো?
ইঁদুর বলে, প্রতিযোগিতা শেষ হয়েছে এবং আমি প্রথম স্থান অর্জন করেছি। এ কথা শুনে ভীষণ রেগে যায় বিড়াল। সে বলে, তুমি কেন আমাকে জাগাওনি? আমি তোমাকে বলেছিলাম তুমি যাবার সময় আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে। ইঁদুর বলে, তুমি গেলে আমি প্রথম স্থান অর্জন করতে পারতাম না। এ কথা শুনে বিড়াল রেগে গিয়ে ইঁদুরকে হত্যা করে ফেলে। তখন থেকে বিড়াল ও ইঁদুর একে অপরের শত্রুতে পরিণত হয়।
বন্ধুরা,এ গল্প শুনে কেমন লাগছে আপনাদের?
কেন ১২ সেং সিয়াও'র মধ্যে বিড়াল নেই?
আসলে প্রাচীনকালে চীনে কোনো বিড়াল ছিল না। চীনে বিড়াল আসে সেই প্রাচীন মিশর থেকে।
হাজার হাজার বছর ধরে পশুদের নামের সেং সিয়াং চীনে একটি প্রথা হিসেবে পালিত হয়ে আসছে ।
চীনের সংখ্যালঘু জাতির সেং সিয়াও
মঙ্গোলিয়ান ১২ সেং সিয়াও ঠিক চীনের সেং সিয়াওয়ের একই ১২টি পশু নয়। মঙ্গোলিয়ান, ছুয়াং ও হান জাতির ১২ সেং সিয়াও একই। অন্য জাতির মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন রয়েছে। যেমন ই জাতির ১২ সেং সিয়াওর মধ্যে ড্রাগন নেই এবং তারা পেঙ্গোলিন ব্যবহার করে। কে এর কে জি জাতি ড্রাগন ও বানরের বদলে মাছ ও শিয়াল ব্যবহার করে । লি জাতি একই ১২ সেং সিয়াও ব্যবহার করলেও তাদের প্রথায় মুরগী প্রথম এবং বানর শেষ সেং সিয়াও। তাই জাতি আবার শূকরের বদলে হাতি ব্যবহার করে ইত্যাদি।
সংখ্যালঘু জাতির আলাদা আলাদা সেং সিয়াও থেকে আমরা জানতে পারি যে, বিভিন্ন জাতি নিজের জীবনের সাথে ঘনিষ্ঠ পশুকে সেং সিয়াও হিসেবে ব্যবহার করতে পছন্দ করেন।
আসলে চীনা সংস্কৃতিতে বিভিন্ন সেং সিয়াও বিভিন্ন চরিত্রের প্রতিনিধিত্ব করে। এসব সেং সিয়াওয়ের মাধ্যমে আমাদের পূর্বপুরুষগণ আমাদের ওপর অনেক প্রত্যাশা রেখেছেন।
ইঁদুর ও গরু: ইঁদুর বুদ্ধিমান,মেধাবী ইত্যাদির প্রতিনিধিত্ব করে। গরু প্রতিনিধিত্ব করে পরিশ্রমের। এ দুই চরিত্রের কোনো একটি ছাড়া জীবনে সফলতা অর্জন করা একেবারেই কঠিন।
বাঘ ও খরগোশ: বাঘ প্রতিনিধিত্ব করে সাহসের। আর খরগোশ প্রতিনিধিত্ব করে সাবধানতার।
ড্রাগন ও সাপ: ড্রাগন প্রতিনিধিত্ব করে অনমনীয়তার। আর সাপ প্রতিনিধিত্ব করে নমনীয়তার।
ঘোড়া ও ছাগল: ঘোড়া প্রতিনিধিত্ব করে উদ্যমতার। আর ছাগল প্রতিনিধিত্ব করে ঐক্যের।
বানর ও মুরগী: বানর প্রতিনিধিত্ব করে নম্রতার। আর মুরগী প্রতিনিধিত্ব করে স্থিতিশীলতার ।
কুকুর ও শূকর: কুকুর প্রতিনিধিত্ব করে বিশ্বস্ততার। আর শূকর প্রতিনিধিত্ব করে সরলতার ।
প্রতিটি মানুষেরই নিজস্ব সেং সিয়াও আছে এবং নিজস্ব চরিত্র আছে। কোনো মানুষই নিখুঁত ও পরিপূর্ণ নয়। অবশ্যই পরস্পরের কাছ থেকে শিখতে হবে।