1029
|
কাই লিনের বয়স ৩০। তিনি সুদর্শন ও আত্মবিশ্বাসী। বেলজিয়ামে ১৫ বছর লেখাপড়া ও কাজ করেছেন। তিনি জানান, ২০০৪ সালের গ্রীষ্মকালে ব্রাসেলসের একটি বারে প্রথম ব্রিটিশ সাংসদ নিরি দেবার সঙ্গে তার পরিচয়। পরিচয় পর্বটিও ছিল উল্লেখ করার মতো। তিনি এক বন্ধুর সঙ্গে বারে গেলেন। পেটে একটু বেশিই অ্যালকোহল পড়েছিল। কাই লিন খানিকটা মাতাল হয়ে গেলেন। তিনি বারের ৫ মিটার উপরে স্থাপিত একটি প্লাটফর্মে ওঠার চেষ্টা করলেন। ঠিত তখন সেই বারে উপস্থিত ছিলেন নিরি দেবা। কাই লিনকে দেখে নিরি তার সহকারীকে জিঙ্গেস করলেন, কী দেখলেন? সহকর্মী বললো, এক মাতালের কাণ্ড। নিরি বললেন, কিন্তু আমি দেখেছি তার সাহস আর লক্ষ্যে পৌঁছানোর কৌশল। তিনি সামনে এগিয়ে গেলেন এবং কাই লিনের সঙ্গে কথা বললেন।
দেবার অভিজ্ঞতাও অসাধারণ। একজন এশীয় মানুষ হিসেবে তিনি ইউরোপে সাফল্য অর্জন করেন। ১৯৪৮ সালে শ্রীলংকায় জন্মগ্রহণ করেন এবং পরে লেখাপড়ার জন্য ব্রিটেনে যান। ১৯৯২ সালে তিনি নিম্ন পরিষদের সদস্য হন এবং ১৯৯৯ সালে ইইউ কাউন্সিলের সদস্য হন। এ পর্যন্ত তিনি টানা তিনবার সদস্য নির্বাচিত হন। দেবা বলেন, কাই লিনের এশীয় মুখের কারণে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সহজ। তারা দু'জন চীন-ইউরোপ সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেন। কাই লিনকে শিক্ষানবিশ কর্মী হিসেবে ইইউ কাউন্সিলে কাজ করা প্রস্তাব দেন দেবা। ওই বছরের শীতকালে কাই লিন ইইউ কাউন্সিল বিদেশ উন্নয়ন কমিটিতে যোগ দেন। দেবাও ওই সংস্থায় ছিলেন, তাই কাই লিন তার সহকারীতে পরিণত হন। ২০০৫ সালের গ্রীষ্মকালে দেবা ইইউ কাউন্সিলের স্পিকারকে একটি চিঠি লেখেন এবং কাই লিনকে নিয়োগের সুপারিশ করেন। অবশেষে কাই লিন সাংসদের উপদেষ্টা হিসেবে ইইউ কাউন্সিলে কাজ শুরু করেন।
কেন কাই লিনকে ইইউ কাউন্সিলে নিয়ে এসেছেন জানতে চাইলে নিরি দেবা বলেন "ইইউ কাউন্সিলে একবার আমি আমার সহকর্মীকে জিজ্ঞাস করি, আপনারা চীন সম্পর্কে কী জানেন? চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কেমন? কেউ আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি। কেউ কেউ চীনের সমালোচনাও করলেন। চীনের লোকসংখ্যা বিশ্বের মোট লোকসংখ্যার ২৫ শতাংশ, অথচ কাউন্সিলের কেউ এ দেশ সম্পর্কে জানে না! কী আশ্চর্য! তাই আমি বলি, আমাদের উচিত চীনকে জানা। চীন আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে সারা কাউন্সিলে একজনও চীনা নেই। তাই আমি একজন চীনা সহকারী নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেই। আমি কাই লিনের সঙ্গে পরিচিত হই। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনি কী বিষয় নিয়ে পড়েছেন? তিনি বলেন, হোটেল ব্যবস্থাপনা। আমি তার ১০০ পাতার লেখা পড়ি এবং তা আমার মনে গভীর ছাপ ফেলে। তাই ইইউ কাউন্সিলে কাজ করার জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানাই আমি।"
আসলে তখন ইইউ কাউন্সিল ও চীনের সম্পর্ক তত ভাল ছিল না। কাউন্সিলের কিছু সদস্য এমনকি চীনের প্রতি বৈরী ছিলেন। যখন প্রথম কাউন্সিলে আসেন তখন কাই লিন অনুভব করেন একটি বৈরী পরিবেশ। কোনো কোনো সাংসদ তাকে দেখেও না-দেখার ভান করতেন। কেউ কেউ তাকে ডাকতেন 'চীনা গোয়েন্দা' বলে। কাই লিন বলেন- "প্রথম যখন কাউন্সিলে কাজ শুরু করি তখন অনেক সাংসদ সরাসরি আমাকে চীনা গোয়েন্দা বলে ডাকতেন। আমার অনেক বিব্রত লাগত। তবে কী করা উচিত্ আমি জানতাম না। প্রথম প্রথম আমি কিছুই বলতান না এবং মৌনতা অবলম্বন করতাম। পরে, একদিন একজন সাংসদ আমাকে 'চীনা গোয়েন্দা' বলে ডাকলে আমি হাসিচ্ছলে বলে উঠি, আমি তো আশা করি আমার সরকারের জন্য কিছু করতে পারবো। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ইইউ কাউন্সিলের সব তথ্যই নির্মল। ইইউ কাউন্সিলের ওয়েবসাইটে সব কিছুই পাওয়া যায়। আপনার কী মনে হয়, একজন চীনা গোয়েন্দা হিসেবে আমার কী করা উচিত? আমার কথা শুনে লোকজন হেসে ফেললো। তারা জানতেন যে, আমি ঠিক বলেছি।"
হাসিঠাট্টার মাধ্যমে পরিবেশ হালকা করা যায়, কিন্তু বাস্তব সমস্যা সমাধানের জন্য এটা যথেষ্ট নয়। তাই কাই লিন চাইলেন ইউরোপ-চীন মৈত্রী গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করতে। তিনি বলেন- "আমি আবিষ্কার করি যে চীনকে না জানার কারণে তারা আমাকে পছন্দ করেন না। তখন কাউন্সিলে ছিল ভারত মৈত্রী গ্রুপ, শ্রীলংকা মৈত্রী গ্রুপ। তাই আমি ভাবলাম, কেন চীনা মৈত্রী গ্রুপ নেই? আমি দেবাকে বললাম, ইইউ কাউন্সিলে আমাকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমি মনে করি, চীনা মৈত্রী গ্রুপ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আপনাকে সাহায্য করা আমার প্রধান দায়িত্ব। আমার কথা শুনে দেবা আমাকে সমর্থন করলেন এবং এক বছরের মধ্যে আমি একটি চীনা মৈত্রী গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করি।"
২০০৬ সালে ইইউ কাউন্সিলে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথম ইউরোপ-চীন মৈত্রী গ্রুপ। এ গ্রুপের উদ্দেশ্য হল, চীন সম্পর্কে জানতে সাংসদকে সাহায্য করা এবং চীন-ইউরোপ সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। সাংসদ দেবা এ গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং কাই লিন মহাসচিব হলেন। তাদের উদ্যোগে ইইউর সাংসদরা চীন সফর করেন। এ গ্রুপ চীন-বিরোধী তত্পরতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও বিতর্কে চীনের অবস্থান সমর্থন করে।
২০০৮ সালে ওয়ান ছুয়ান ভূমিকম্পের দুর্গত লোকের জন্য তাঁবু প্রস্তুত করে এই গ্রুপ এবং ২০০৮ অলিম্পিক গেমসকে সমর্থন করে। গ্রুপের চেয়ারম্যান দেবা ইইউ কাউন্সিলের প্রতিনিধি হিসেবে অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এবং ২০১০ সাং হাই বিশ্ব মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। দালাই লামা ইউরোপ সফরকালে কাই লিন গ্রুপের মহাসচিব হিসেবে ইইউর সরকারি তথ্যমাধ্যম 'voice of Europe'তে প্রবন্ধ প্রকাশ করেন এবং দালাই লামাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য নিন্দা জানান।
চীন সমৃদ্ধশালী হওয়ার সাথে সাথে আরো বেশি ইইউ সাংসদ বুঝলেন যে, চীনের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা দরকার। এখন পর্যন্ত ইউরোপ-চীন মৈত্রী গ্রুপের সদস্য ৪০ জন। গ্রুপের সদস্যরা ইইউ কাউন্সিলের বাইরে স্বাধীনভাবে অন্য একটি এনজিও 'ইউরোপ-চীন মৈত্রী কমিটি' প্রতিষ্ঠা করে।
বর্তমানে ইইউ কাউন্সিলে চীনের সম্পর্কে ধারণা অনেক পাল্টেছে। আরো ৫ জন সাংসদ কাই লিনকে বিশেষ উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ করেছে। কাই লিন বলেন-
"চীনের শক্তিশালী অর্থনীতির কারণে ইউরোপীয় মানুষ বুঝতে পেরেছে যে, চীনকে তাদের প্রয়োজন। ইউরোপ-চীন সুসম্পর্ক থেকে সবাই উপকৃত হতে পারেন। সবকিছু দেখে শুনে তারা চীনকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং চীনের বড় পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে আমাকে গ্রহণ করে নিয়েছে।"