মহান হিমালয় পর্বত চীন ও ভারতের সীমান্তে থাকলেওদু'দেশের বিনিময় ঘনিষ্ঠ হয়। রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতিও শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চীন-ভারত বিনিময় ও উন্নত হয়েছে।
গত হাজার বছরে দু'দেশের লেনদেন অব্যাহত ছিল।এখন পর্যন্ত, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি লোকসংখ্যা, দ্রুতউন্নয়নশীল দেশ হিসেবে চীন ও ভারতের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে লেনদেন ক্রমাগত বাড়ছে। আর সহযোগিতার ক্ষেত্র ও আকার আগের চেয়ে অনেক বেশি ও বড়।
দু'দেশের তরুণ-তরুণীরা দু'দেশের সংস্কৃতিকে এত ভালবাসে যে তারা পরস্পরের দেশে ভাষা শিখতে ও সংস্কৃতি জানতে যায়। এতে দু'দেশের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হয়।
ভারতের জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগের বিশেষজ্ঞ বি.আর. দিপাকদু'দেশের সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ক্ষেত্রে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তিনি ভারতের হিমাচল প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেছেন। ১৯৮৬ সালে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। শিক্ষাজীবন শেষে ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন শিক্ষকহিসেবে কাজ শুরু করেন। তার শিক্ষক জীবনের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, "তখন ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা কম ছিল। চীনের প্রতি আগ্রহী ছাত্র ছাত্রী আরো কম। আমার মনে হয় যে তখন কয়েক গ্রেডের ছাত্রছাত্রীদের একত্রিত করে ক্লাস নিতেন শিক্ষক। এখন একেবারে অন্য রকম অবস্থা।আমার বিভাগের ১৩০জনেরও বেশি ছাত্রছাত্রী আছে। undergraduate, postgraduate ও Ph.D কোর্স রয়েছেআমাদের।"
বিশেষজ্ঞ দিপাক অনর্গল চীনা ভাষায় কথা বলতে পারেন। চীন সম্পর্কিত অনেক তথ্যও তিনিও বেশি জানেন।তার কোর্সগুলো হলো, চীনা ইতিহাস, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতি ইত্যাদি। তিনি মনে করেন, চীন ও ভারতের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য রয়েছে। সেজন্য তার ক্লাসে সাধারণত দু'দেশের অভিন্ন অবস্থা তুলনা করে ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো হয়। তিনিও ছাত্রছাত্রীদের উত্সাহ দেন তাদের চীনা ভাষা উন্নত করার ব্যাপারে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দিপাকের অনেক ছাত্রছাত্রী স্নাতক করেছে এবং ভালো ভালো চাকরি করছে। এর মধ্যেবিকাশ কুমার সিং এখন চীনের পেইচিং বিশ্ববিদ্যালয়েরআধুনিক ও সমসাময়িক ইতিহাসের ওপর ডক্টরেট করছে।তার শিক্ষকের ব্যাপারে তিনি বলেন,
"যখন আমি প্রথম বারের মত বিশেষজ্ঞ দিপাকের ক্লাসেযাই, মনে হয় তিনি খুবই কঠোর একজন শিক্ষক। তিনি সবসময় ৫ মিনিট আগে ক্লাসে এসে পৌঁছান। কোনশিক্ষার্থীর ৫ মিনিট দেরি হলে, সে আর ক্লাসরুমে প্রবেশ করতে পারে না। কঠোর হলেও, এটা আসলে খুবই গুরুত্বপূর্ণএকটি ক্লাস, আমি জানি যে, 'যথাসময়ে কাজ করা'গুরুত্বপূর্ণ একটি অভ্যাস।"
তার চমত্কার ছাত্রছাত্রী ছাড়াও, তার জন্য সবচেয়েআকর্ষণীয় সম্পদ হচ্ছে তার চীনা স্ত্রী। তার স্ত্রীকে জানবার পর তিনি চীনকে আরো বেশি ভালবাসেন।
তিনি বলেন,
" আজ থেকে দশ বছর আগে ২০০৪ সালে আমাদেরবিয়ে হয়। চলতি বছরের ১৬ আগস্ট আমাদের ১০ম বিবাহ বার্ষিকী। আমাদের দু'টি সন্তান রয়েছে। তারা হিন্দি ও চীনা ভাষা বলতে পারে। ও! আর ইংরেজি তো বটেই!"
সুখী পরিবার, সুন্দরী চীনা স্ত্রী, দুটি লাবণ্যময় শিশু, এ যেনো দিপাকের নিখুঁত জীবন। তার ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা বাড়ায় তার জীবনে ব্যস্ততা বাড়লেও তিনি আসলে এরকম জীবন উপভোগ করেন। কারণ, তিনি চীনকে গভীরভাবে ভালবাসেন। ভারতের বুকে চীনের সংস্কৃতির বিকাশে তিনি ভীষণ আগ্রহী।
আসলে দিপাকের মতো ভারতে অনেক শিক্ষক আছে। আর চীনেও অনেক চীনা শিক্ষকও হিন্দি ভাষা পড়ায়।ভাষা ছাড়া, নৃত্য ও যোগব্যায়ামসহ অনেক ক্লাস রয়েছে।এদের মধ্যে চিন সান সান একজন ভারতীয় নাচের শিক্ষক।
শিশু বয়স থেকেই চিন সান সান ভারতীয় ক্লাসিক্যালনাচ শেখা শুরু করেন। ভারতীয় ক্লাসিক্যাল নৃত্য তারএতো ভাললাগে যে, চিন সান সান তার বিশ্ববিদ্যালয়েরস্নাতক শেষ করে আলাদাভাবে ৫ বার নিজ খরচে ভারতেনাচ শিখতে যান। নৃত্য উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে, চিন সান সান মনে করেন যে এ সুন্দর নৃত্য চীনে প্রচার করবেন। ভারত থেকে চীনে ফেরার পর চিন সান সান বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ২০০৫ সালে পেইচিংয়ে 'ইউয়েই উ ভো স্যুও নৃত্যকেন্দ্র' খোলেন। এ স্টুডিও সম্বন্ধে চিন সান সান বলে,
"স্টুডিও খোলার সময়ে অনেক মানুষেরই ভারতীয়ক্লাসিক্যাল নৃত্য সম্পর্কে তেমন জানাশোনা ছিলোনা। অনেক মানুষ আমার স্টুডিওতে আসতেন। কারণ তারা ভারতীয়চলচ্চিত্র দেখে ছবির নৃত্যগুলো পছন্দ করতেন। কিন্তুএখানকার নাচ দেখার পর তারা আমাকে বলেন যে, কেন এনাচ চলচ্চিত্রের চেয়ে ভিন্ন? তারপর তারা স্টুডিও ছেড়ে চলে যান। অবশেষে অনেক বছর চেষ্টার পর চীনের মানুষ এ সুন্দরক্লাসিক্যাল নৃত্যের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে। তারাক্লাসিক্যাল নৃত্য গ্রহণ করেছে। সেজন্য এখন স্টুডিওতেছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বেড়েছে।"
এখন চিন সান সানের নাচের স্টুডিও পেইচিংয়ে বেশজনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রথম দিকে স্টুডিওতে শুধু দশ জনছাত্রছাত্রী ছিলো। এখন সেখানে একশ'রও বেশি ছাত্রছাত্রীআছে। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ৩ বছর বয়সী শিশুও রয়েছে।প্রাপ্তবয়স্করাও রয়েছে। তাছাড়া চিন সান সানের নিজের মেয়েও ক্লাসিক্যাল নৃত্য শিখছে। তিনি বেশ মজা করেবলেন,
"জন্ম গ্রহণের আগেই আমার মেয়ে আমার পেটে নাচশিখতে শুরু করে!"
চিং ছিয়েন হলো চিন সান সানের মেয়ে। তার মার প্রভাবে সে ভারতীয় নৃত্য শিখে, ভারতের ঐতিহ্যবাহীপোশাক পরে, ভারতীয় চলচ্চিত্র দেখে। চিং ছিয়েনেরভবিষ্যত নিয়ে চিন সান সান বলেন,
"আমার মেয়ের ভবিষ্যতে কী কাজ করবে সেটা তার নিজের সিদ্ধান্ত। আমি আশা করি সে নিজের পছন্দের কাজখুঁজে নেবে। কিন্তু, আমি আশা করি যে ছিয়েন যেহেতুভারতকে এতো ভালবাসে, সে হয়তো আমার মত একজন ভারতীয় ক্লাসিক্যাল নৃত্য শিক্ষক হতে চাইবে।"
তার নিজের মেয়ে ভারতীয় ক্লাসিক্যাল নৃত্য এত ভালবাসে দেখে চিন সান সান খুবই খুশী। তিনি আশা করেননাচ শেখার মাধ্যমে তার মেয়ে, তার ছাত্রছাত্রীরা ভারতের সংস্কৃতিও ভালবাসবে। তিনি বলেন,
"আমি আশা করি আরো বেশি মানুষ আমার স্টুডিওতেআসবে, একদিন একটি স্কুল বা একটি ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হবে।যেখানে আমরা ভারতের সেরা শিল্পীদের চীনে আমন্ত্রণজানাবো। তারা চমতকার নৃত্য পরিবেশন করবেন। তারপর চীনা মানুষের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম প্রতিষ্ঠিত হবে।"
দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চিন সান সানের স্টুডিওতেছাত্রছাত্রীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। আগের স্টুডিওটি যথেষ্ট বড় ছিলো না। তিনি ক্লাসরুমটি বড় একটি জায়গায় সরানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। নতুন ক্লাসরুম চলতি বছরের অক্টোবরথেকে চালু হবে। চিন সান সান খুবই খুশী যে নতুন বড় ক্লাস রুমে আরো বেশি চীনা ছাত্রছাত্রী ভারতীয় ক্লাসিক্যাল নৃত্য শিখতে পারবে।
জনাব দিপাক, চিন সান সান তাদের জন্য দু'দেশের সংস্কৃতি তাদের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। নিজ নিজ দেশে পরস্পরের সাংস্কৃতিক পরিচয় তারা তুলে ধরেন।