তোবা গ্রুপের পোশাক কারখানা তাজরিন ফ্যাশন্সে ভয়াবহ আগুনে শতাধিক শ্রমিকের মৃত্যু, আর সাভারে রানা প্লাজা ধসে হাজারের বেশি শ্রমিকের মৃত্যুর পর বড় ধাক্কা খায় বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারি তৈরি পোশাক শিল্প খাত। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পোশাক কারখানার নিরাপত্তা ও শ্রমিক কল্যাণের বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এমন এক পরিস্থিতিতেও গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে পোশাক খাতে রপ্তানি আয় বেড়েছে। গত অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয় ছিল ৩ হাজার ২০ কোটি ডলার। এর মধ্যে ৮১ শতাংশ বা ২ হাজার ৪৩৮ কোটি ডলারই ছিল পোশাক রপ্তানি বাবদ আয়।
এ পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় বাংলাদশের অর্থনীতির লাইফলাইনে পরিণত হয়েছে তৈরি পোশাক শিল্প। এটা যেমন আশার কথা, তেমনি পোশাক খাতে নানা দুর্ঘটনা, শ্রমিক অসন্তোষ প্রায়শই আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে শ্রমিক অসন্তোষ ও ধর্মঘটে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অপার সম্ভাবনার এই পোশাক খাত।
সাভারে রানা প্লাজা ধসের ভয়াবহ স্মৃতি ভুলতে না ভুলতে বেতন ভাতার দাবিতে তোবা গ্রুপের পোশাক শ্রমিকদের ১২ দিনের আমরণ অনশন-আন্দোলন এ শিল্পের সমস্যাটিকে আবার সামনে নিয়ে এসেছে। তিন মাসের বকেয়া বেতন ও ঈদ বোনাসের দাবিতে তোবার পাঁচটি পোশাক কারখানার প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক আমরণ অনশন শুরু করে। তাদের আন্দোলনে বাংলাদেশে পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি বিজিএমইএ, সরকার ও শ্রমিকদের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে ৬ ও ১০ জুলাই শ্রমিকদের তিন মাসের বকেয়া বেতন ও ওভারটাইমের পাওনা দেওয়া হয়। এখনো তাদের ঈদ বোনাস দেওয়া হয়নি।
বিজিএমইএ ও সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন তাদের ঈদ বোনাস পরিশোধ করা হবে। কিন্তু তোবার পোশাক কারখানাগুলো আবার চালু হবে কিনা, বা হলেও এসব শ্রমিক কাজ পাবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে। আর যদি তোবার কারখান বন্ধ হয়ে যায় সেক্ষেত্রে শ্রমিকরা নিয়ম অনুযায়ী তাদের পাওনা পাবে কিনা সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। যদিও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, কারখানা লে অফ করলে শ্রমিকদের চার মাসের বেতন পরিশোধ করতে হবে মালিক পক্ষকে। তোবার মতো এমন বহু কারখানাতেই শ্রমিকদের বেতনভাতা নিয়ে মাঝেমাঝে শ্রমিক-মালিক সংঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পোশাক শিল্প খাত।
এমনই এক পরিস্থিতিতে শনিবার 'পোশাক শিল্পের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়' শীর্ষক সেমিনার হয়েছে ঢাকায়। সেমিনারে বিশিষ্টজনরা শ্রমিক অসন্তোষের জন্য মালিক পক্ষ ও বিজিএমইএকে দায়ী করেছেন। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, সাব কন্ট্রাক্ট নিয়ে তোবা গ্রুপের মতো পোশাক কোম্পানিগুলো সস্তা শ্রমের সুযোগ নিয়ে মুনাফা লুটছে। কিন্তু শ্রমিকদের ন্যায্য প্রাপ্য দিচ্ছে না। বিজিএমই ও সরকার তোবার মতো কোম্পানিগুলোর পাশে দাঁড়াচ্ছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন। চীনের পোশাক খাতে দক্ষ শ্রমশক্তির উদাহরণ দিয়ে ড. জিল্লুর বলেন, সময় হয়েছে বাংলাদেশের সস্তা শ্রমের অবস্থা থেকে দক্ষ শ্রম ব্যবস্থায় উত্তরণের।
তবে বিজিএমইএ সভাপতি আতিকুল ইসলাম তার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে বলেন, এক সময় সাব-কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে পোশাক শিল্পে অর্ডার এলেও এখন ক্রেতারা সাব-কন্ট্রাক্টের ব্যাপারে আগ্রহী নন। এখন ক্রেতারা সরাসরি কার্যাদেশ দিতে আগ্রহী।
এদিকে, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ রোববার এক আলোচনায় ড. হোসেন জিল্লুরের মন্তব্যের সমালোচনা করে বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তিনি বাণিজ্যমন্ত্রী থাককালে যে শ্রমিক অসন্তোষ হয়েছিল তা তিনি থামাতে পারেননি। নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, বাংলাদেশের পোশাক খাত নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। বলেন, সরকার চাপ না দিলে বিজিএমইএ তোবা গ্রুপের হয়ে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দিত না। আর শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, তোবার মালিক দেলোয়ার হোসেনকে জামিন না দিলে ছয় মাসেও শ্রমিকরা বেতন-ভাতা পেতেন না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দীন আহমেদ বলেন, পোশাক মালিকরা সরকার থেকে সব রকম সুযোগসুবিধা নেন, কিন্তু এ শিল্পে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নে তারা কাজ করছেন না। পোশাক মালিকরা শ্রমিক কল্যাণকে মাথায় রেখে এ শিল্পের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নে মনোযোগ দিলেই পোশাক শিল্প খাতের সমস্যাগুলো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব বলে মনে করেন সাবেক এই গভর্নর।
মাহমুদ হাশিম, ঢাকা থেকে।