0716
|
গত ২৯ জুন জাপানের বিখ্যাত অর্থনৈতিক সংবাদপত্র 'নিক্কেই' (Nikkei)-এর খবরে একটি পরিসংখ্যানের বরাত দিয়ে জানানো হয়, হিউলেট প্যাকার্ডকে টপকে চীনের কোম্পানি 'লেনোভো' বিশ্বের বৃহত্তম কম্পিউটার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তা ছাড়া, বাজার গবেষণা কোম্পানি 'ক্যানালিস' (Canalys)-এর একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ব্যক্তিগত কম্পিউটার বাজারে লেনোভোর (Lenovo) অংশ ২০১৩ সালের প্রথম তিন মাসে ছিল ১০ শতাংশ এবং এ সংখ্যা চলিত বছরের প্রথম তিন মাসে বেড়ে দাঁড়ায় ১২ শতাংশে। অন্যদিকে, বিশ্ববিখ্যাত বাজার গবেষণা কোম্পানি 'গার্টনার' (Gartner)-এর উপাত্ত অনুযায়ী, ২০১২ সালের তৃতীয় প্রান্তিক থেকেই বিশ্ব কম্পিউটার বাজারে HP-কে সরিয়ে প্রথম স্থানটি দখল করে নেয় লেনোভো।
১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় Lenovo কোম্পানি এবং পরবর্তী ৩০ বছরে এটি একটি বহুমুখী ও উদ্ভাবনক্ষমতাসম্পন্ন বৃহদাকার কোম্পানিতে পরিণত হয়। Lenovo-র সিইও ইয়াং ইউয়ান ছিং বলেন, Lenovo-র ৬০ শতাংশ আয় বিদেশ থেকে আসে, তবে গবেষণার ৬০ শতাংশ সম্পন্ন হয় চীনে। এ ছাড়া, কোম্পানিটির ৭০ শতাংশ কর্মী চীনেই কাজ করে এবং ৮০ শতাংশ পণ্য চীনেই উত্পাদিত হয়।
২০০১ সালে Lenovo প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিকায়নের পথে চলতে শুরু করে। ২০০৪ সালে Lenovo তখনকার কম্পিউটার জায়ান্ট আইবিএম-এর ব্যক্তিগত কম্পিটারের ব্যবসা কিনে নেয়। অনেকে এই অধিগ্রহণকে একটি সাপের হাতি গিলে ফেলার সাথে তুলনা করেন। এ অধিগ্রহণের মাধ্যমেই Lenovo-র কম্পিউটার ব্যবসা দ্রুত বিশ্ববাজার দখল করে।
২০০৪ সালের শেষ নাগাদ, ১৭৫ কোটি ডলারে আইবিএম-এর পিসি ব্যবসা ক্রয়ের খবর ঘোষণা করে Lenovo এবং ২০০৫ সালের পয়লা মে থেকে এ অধিগ্রহণ কার্যকর হয়। তখন চীন মাত্রই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় যোগ দিয়েছে। এ পটভূমিতে Lenovo-র মধ্যে সংস্কার খুব প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তখনকার আন্তর্জাতিক বাজারে Lenovo নতুন একটি মুখ এবং আইবিএম অধিগ্রহণের বিষয়টি নিয়েও Lenovo-র কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল। Lenovo-র প্রতিষ্ঠিতা লিউ ছুয়ান চি বলেন- "যখন আমরা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারলাম কেন আইবিএম লোকসান দিচ্ছে এবং কীভাবে এ লোকসান কাটিয়ে ব্যবসাকে লাভজনক করা সম্ভব, তখনই আমরা আইবিএম কিনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।"
অধিগ্রহণের পর, আইবিএমের ব্র্যান্ড, কয়েক হাজার পেটেন্টকৃত প্রযুক্তি এবং বিক্রির চ্যানেল Lenovo-র গুরুত্বপূর্ণ সম্পদে পরিণত হয়। অধিগ্রহণের পরপরই Lenovo তখনকার বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ব্যক্তিগত কম্পিউটার উত্পাদকে পরিণত হয় এবং বিদেশে এর বাজারও সম্প্রসারিত হয়। Lenovo-র ঊর্ধ্বতন ভাইস প্রেসিডেন্ট ছেন স্যু তুং বলেন- "এ অধিগ্রহণের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী আমাদের প্রচারও অনেক বেড়েছে। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রে আগে প্রায় ১০ শতাংশ মানুষ Lenovo সম্পর্কে জানতো। আইবিএম কিনে নেওয়ার পর এখন ৫০ শতাংশ মার্কিনি লেনোভো সম্পর্কে জানে এবং এর পণ্য কিনতে চায়।"
আইবিএম কিনে নেওয়ার পর Lenovo সত্যিকার অর্থেই একটি আন্তর্জাতিক কোম্পানিতে পরিণত হয়। ছেন স্যু তুং বলেন- "কীভাবে আন্তর্জাতিক পরিবেশে ব্যবসা করতে হয়, বিভিন্ন দেশে ব্যবসা কীভাবে ব্যবস্থাপনা করতে হয়, কীভাবে কৌশলগ্রহণ ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হয়, কীভাবে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বিশ্বায়নের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে হয়---এ সবই আমরা শিখেছি। সবকিছুই আমরা শিখেছি হাতেকলমে।"
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইন্টারনেট প্রযুক্তির ক্ষেত্রে দ্রুত উন্নতি ঘটেছে এবং বিশ্বব্যাপী ব্যক্তিগত কম্পিউটারের চাহিদা হ্রাস পেয়েছে এবং পিসির ওপর ভোক্তাদের নির্ভরশীলতাও কমেছে। এ পটভূমিতে ব্যক্তিগত কম্পিউটার উত্পাদক হিসেবে Lenovo-ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। ইয়াং ইউয়ান ছিং বলেন-
"কয়েক বছর আগে আমাদের উদ্ভাবিত চিপ বা অপারেটিং সিস্টেম ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আজকাল ব্যবহারকারীরা এসব নিয়ে খুব একটা ভাবেন না। তাদের কাছে বিভিন্ন ধরনের অ্যাপ্লিকেশন আরও গুরুত্বপূর্ণ।"
এ প্রসঙ্গে লিউ ছুয়ান চিও বলেন- "মোবাইল ইন্টারনেটের প্রসারের ফলে, একটি হার্ডওয়্যার উত্পাদক কোম্পানি হিসেবে আমাদেরকে নতুন করে ভাবতে হয়েছে। এখন আমাদেরকে হার্ডওয়্যার উত্পাদনের পাশাপাশি অন্যান্য সেবা দেওয়ার বিষয়টিও বিবেচনা করতে হচ্ছে। "
বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন যে, বিশ্বব্যাপী স্মার্ট ডিভাইসের বিক্রির পরিমাণ ২০১৩ সালের ১৫০ কোটি থেকে বেড়ে ২০১৭ সালে ২৩০ কোটিতে দাঁড়াবে। এ অবস্থায় Lenovo-র জন্য চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, মোবাইল ফোন ও ট্যাবলেট পিসিসহ স্মার্ট ডিভাইস উত্পাদনের ক্ষেত্রে দ্রুত উন্নতি করা।
২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রের লাস ভেগাসে Lenovo আনুষ্ঠানিকভাবে তার মোবাইল ইন্টারনেট প্রযুক্তির সাথে ভোক্তাদের পরিচয় করিয়ে দেয় এবং প্রথম প্রজন্মের মোবাইল ইন্টারনেট ডিভাইস তাদের হাতে তুলে দেয়। আর এর মাধ্যমেই Lenovo আনুষ্ঠানিকভাবে স্মার্ট ডিভাইসের বাজারে প্রবেশ করে। ইয়াং ইউয়ান ছিং Lenovo-কে একটি হাতির সাথে তুলনা করে বলেন, লেনোভো এমন এক হাতি যা কিনা নৃত্য করতে পারে। ইয়াং ইউয়ান ছিং বলেন- "আমরা ব্যক্তিগত কম্পিউটারের বাজারে এক নম্বরে আছি। এখন মোবাইল ফোন ও ট্যাবলেট পিসিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও আমরা সামনে এগিয়ে যাচ্ছি। ব্যক্তিগত কম্পিউটারের ব্যবহার হ্রাস পেলেও, আমাদের ব্যবসার কোনো ক্ষতি হবে না। নতুন ব্যবসা আমাদের ক্ষতি পুষিয়ে দিচ্ছে।"
২০১৩ সালের শেষ নাগাদ, লেনোভো 'ইয়োগা' (yoga) নামের একটি ট্যাবলেট পিসি বাজারে আনে এবং প্রথম মাসেই এটি বিক্রি হয় ১০ লাখ কপি। Lenovo-র এই ট্যাবলেট পিসি ব্যবহারকারীদের নতুন অভিজ্ঞতা এনে নেয়। একটি ধাতব স্ট্যান্ডের মাধ্যমে পিসিটিকে কোনো একটি কোণে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায়। ছেন স্যু তুং মনে করেন এ পিসির মাধ্যমে লেনোভোর উদ্ভাবনী ক্ষমতা আরো একবার প্রমাণিত হয়েছে। তিনি বলেন- "এ পিসির ব্যাটারি একটানা ১৮ ঘন্টা সক্রিয় থাকে। আগের মডেলের চেয়ে এটি নানান দিক থেকে উন্নতও বটে। ফলে এ ট্যাবলেট পিসি ব্যবহারে তুলনামূলকভাবে অধিক সুবিধাজনক হয়েছে।" গত বছর Lenovo-র ট্যাবলেট পিসির বিক্রির পরিমাণ ছিল সাড়ে এগারো কোটি। অর্থাত প্রতি সেকেন্ডে বিক্রয় হয়েছে ৫টা করে পিসি।
এদিকে, Lenovo গুগল ও মটোরোলার স্মার্টফোন সংক্রান্ত ব্যবসা কিনে নেওয়া পরিকল্পনা করেছে এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী, চলতি বছরের শেষ নাগাদ এ লেনদেন সম্পন্ন হবে। ২০১২ সালের চতুর্থ প্রান্তিক থেকে ২০১৩ সালের চতুর্থ প্রান্তিক পর্যন্ত বিশ্ব স্মার্টফোন বাজারে Lenovo-র হিস্যা ছিল ৪.৩ শতাংশ এবং মটোরোলার ১.১ শতাংশ। এখন মটোরোলার ব্যবসা কিনে নেওয়ার পর, এক্ষেত্রে লেনোভোর অবস্থান গিয়ে দাঁড়াবে হুয়া ওয়ে কোম্পানির উপরে, অর্থাত বিশ্বের তৃতীয় স্থানে।
আন্তর্জাতিক এক উপাত্ত কোম্পানি চীনা অঞ্চলের সহকারী পরিচালক ওয়াং চি পিং বলেন- "চীনের বাজারে Lenovo-র স্থান এক নম্বরে। কিন্তু বিদেশের বাজারে এর অবস্থান প্রায় শেষের দিকে। মটোরোলার ব্যবসা কিনে নেওয়ার মাধ্যমে Lenovo দ্রুত উত্তর আমেরিকা, লাতিন আমেরিকা ও পূর্ব ইউরোপের বাজারে প্রবেশ করতে পারবে। "