ছেন ছি
0430china.m4a
|
চীনের সান সি প্রদেশের থাই ইউয়ান শহর থেকে ম্যাডাম ছেন ছি ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো হাঙ্গেরিতে আসেন এবং তখন থেকেই তিনি সেখানে বসবাস করছেন। মাঝখানে মেয়ের লেখাপড়ার খাতিরে শুধু ৩ বছরের জন্য চীনে কাটান। ম্যাডাম ছেন মনে করেন, যদিও বিদেশে পরিবারের সব সদস্য ও বন্ধুদের সঙ্গে সবসময় দেখা হয় না; তথাপি বুদাপেষ্টে তার জীবন আরও স্বাচ্ছন্দ্যময় এবং সেখানকার পরিবেশও তুলনামূলকভাবে ভাল। তিনি বলেন"হাঙ্গেরির প্রাকৃতিক পরিবেশ ভাল এবং আবহাওয়া ও আর্দ্রতা বসবাসের জন্য উপযুক্ত। আমার মেয়ে ব্রিটেনে তিন বছরের মতো লেখাপড়া করেছে, তবে সে ব্রিটেনের আবহাওয়া পছন্দ করে না। কারণ, ওখানে সারা বছরই আকাশ মেঘলা থাকে এবং রোদ কম। অন্যদিকে, বুদাপেষ্টের আবহাওয়া অনেক ভাল।"
বুদাপেষ্ট বিখ্যাত ও দর্শনীয় ইউরোপীয় শহর এবং মানুষ একে 'পূর্ব ইউরোপের প্যারিস' ও 'দানিউব নদীর মুক্তা' বলে ডাকে। দানিউব নদীর দু'পারের দৃশ্য খুব সুন্দর এবং ধীরে ধীরে শহরের ভেতরে ঢুকলে দেখা যাবে অনেক মধ্যযুগীয় ভবন। প্রতি বছর বুদাপেষ্ট বিশ্বব্যাপী বহু পর্যটক আকর্ষণ করে। অনেক পশ্চিম ইউরোপীয় মানুষ বুদাপেষ্ট পছন্দ করেন, কারণ এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য সুন্দর, আবহাওয়া ভাল এবং খরচও কম।
মাডাম ছেন চীনে ছিলেন পদার্থবিদ্যার একজন শিক্ষিকা। বর্তমানে বুদাপেষ্টে তিনি একটি চীনা স্কুলে কাজ করেন। এ স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের অধিকাংশই বুদাপেষ্টে বসবাসকারী প্রবাসী চীনাদের সন্তান। যদিও বুদাপেষ্টে বহু বছর ধরে বসবাস করে আসছেন, তবু ম্যাডাম ছেন হাঙ্গেরিয়ান ভাষা তেমন একটা জানেন না। প্রথমে বুদাপেষ্টে এসে তিনি ছোট ব্যবসা শুরু করেছিলেন এবং দোকান খুলেছিলেন। ২০০২ সালে একটি চীনা দম্পতি বুদাপেষ্টে একটি চীনা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন এবং তখন থেকে মাডাম ছেন এ স্কুলে পড়ান। যারা ম্যাডাম ছেনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তারা মূলত চীনা বা চীনা ভাষা জানা হাঙ্গেরিয়ান বলে ভাষা ম্যাডাম ছেনের জন্য কোনো সমস্যা নয়।
বর্তমানে হাঙ্গেরিতে তিনটি কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট আছেউ। এগুলো বুদাপেষ্ট, Szeged ও Miskolc-এ অবস্থিত। চীনা ভাষা ঐচ্ছিক বিদেশি ভাষা হিসেবে হাঙ্গেরির মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে পড়ানো হয়। প্রতি বছর অনেক হাঙ্গেরিয়ান ছাত্রছাত্রী চীনা ভাষা শিখে এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ বিনিময় শিক্ষার্থী হিসেবে পেইচিং ফরেন স্টাডিজ ইউনিভার্সিটিসহ চীনের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করতে আসে। ছেন ছি কুয়াং হুয়া নামে একটি বেসরকারি স্কুলে কাজ করেন। এখানে দিন দিন ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বাড়ছে। কারণ, এখানে বসবাসকারী চীনা মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ছেন ছি বলেন"প্রতিবছর আমি একবার চীনে আসি। সত্যি কথা বলতে কি, এখন চীনে ধোয়াশা বেশি এবং দেশে ফিরে এলেই আমি সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হই। হাঙ্গেরিতে এ সমস্যা নেই। তা ছাড়া, চীনে মানুষ অনেক বেশি এবং আমি হাঙ্গেরির শান্ত পরিবেশের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। হাঙ্গেরিতে মানুষ কম এবং মনও শান্ত থাকে। চেষ্টা-তদবির করলে একটা কাজও জুটিয়ে নেওয়া যায়। আমার মনে হয়, যতদিন বিদেশে থাকতে পারবো, ততই ভালো।"
হাঙ্গেরির উন্নত জীবনমানও অভিবাসীদের আকর্ষণ করে। হাঙ্গেরির কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর উপাত্ত থেকে জানা গেছে, ২০১৩ সালে হাঙ্গেরির জি. ডি. পির পরিমাণ ১৩০ বিলিয়ান ৩০০ মিলিয়ান ডলার এবং মাথাপিছু জি. ডি. পি ১৩ হাজার ১৬৮ ডলার। ছেন ছি বলেন"সাধারণত এখানে যারা কাজ করে এবং নিয়মিত কর দেয়, তারা চিকিত্সা ও অবসরভাতার নিশ্চয়তা পায়। তা ছাড়া, হাঙ্গেরিতে ১৮ বছরের বাধ্যতামূলক শিক্ষাব্যবস্থা রয়েছে, যার অর্থ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়াশোনা করতে নিজের কোনো টাকা খরচ করতে হয় না।"
হাঙ্গেরির মানুষের চরিত্র ও রীতিনীতিও ভাল। বিশেষ করে বিদেশিদের প্রতি তাদের মনোভাব বন্ধুত্বপূর্ণ। ছেন ছি বলেন"আমি মনে করি, হাঙ্গেরি স্নেহশীল জাতি। যখন আমি প্রথম এ দেশে আসি, তখন থেকেই হাঙ্গেরির মানুষ আমার প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন আচরণ করে আসছে। আপনি যদি কোন একটি জায়গা খুজঁতে চান তাহলে হাঙ্গেরির মানুষ সবসময় আপনার সাহায্যে এগিয়ে আসবে। একবার আমি একটি জায়গার ঠিকানা সম্পর্কে একজন হাঙ্গেরীয়র কাছে জানতে চাইলে, উনি আমাকে সেখানে নিয়ে যান। শুরুতে ভেবেছিলাম, উনিও হয়তো ওই একই জায়গায় যাচ্ছেন। পরে বুঝলাম, স্রেফ আমাকে পৌঁছে দিতেই তিনি আমার সঙ্গে এসেছিলেন। "
বিদেশে চীনে রয়ে যাওয়া নিজের পরিবার ও বন্ধুদের কথা সবসময় ছেন ছির মনে পড়ে। বিশেষ করে যখন তিনি প্রথমে হাঙ্গেরিতে আসেন। তখন ওখানে কোনো চীনা ভাষার বইও খুঁজে পাননি। পরে কম্পিউটার কেনার পর তিনি সহজে চীনের খবর পেতে শুরু করেন। গত কয়েক বছর আগে সহকর্মীর সুপারিশে ছেন ছি স্থানীয় একটি গায়কদলে যোগ দেন। ওখানে তিনি অনেক চীনা বন্ধুর সঙ্গে পরিচিত হন। ২০১০ সালে চীনা শিল্পী ছাং কুও চির উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এ গায়ক দল বিদেশে সংগীত প্রতিযোগিতায় অনেক পুরস্কার অর্জন করে। এ দলের প্রধান চু কুই লিয়ান বলেন"আমাদের দলের সদস্যরা সমাজের বিভিন্ন মহলের মানুষ। যেমন ম্যানেজার, গাইড, শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ও অবসরপ্রাপ্ত। বিদেশে চীনা মানুষের জীবনে খানিকটা হলেও একঘেয়েমি আছে। আমাদের দলে নাম লিখিয়ে তারা খানিকটা হলেও জীবনে বৈচিত্র্য খুঁজে পান।"
প্রতি সপ্তাহের নির্দিষ্ট সময় মহড়া হয় এবং গায়ক দলের সদস্যরা সবসময় নানা রকমের অনুষ্ঠানে পারফর্ম করে থাকেন। বুদাপেষ্টের যে কোনো প্রবাসী চীনা দলের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন এবং তাদের দ্বারা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারেন। ছেন ছি বলেন"গায়কদলে যোগ দেয়ার পর আমি খুব খুশি। দলে সবার শখ একই এবং একসঙ্গে থাকতে পেরে সবাই খুব আনন্দিত।"
বর্তমানে ছেন ছি স্কুলে শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন এবং গায়কদলের উপ-প্রধানের দায়িত্বও পালন করেন। তার দৈনন্দিন জীবন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এবং এখন জীবনের প্রতি তিনি সন্তুষ্ট। তিনি ভাবছেন হাঙ্গেরিতে তার বাকি জীবন কাটবেন। তিনি বলেন"বর্তমানে আমর মেয়েও হাঙ্গেরিতে কাজ করে। স্নাতক হওয়ার পর সে বুদাপেষ্টে ফিরে এসেছে এবং এখানে বিয়ে করেছে। আশা করি, ভবিষ্যতে তার বাচ্চাও এখানে বড় হবে। আমার বয়স প্রায় ৬০ বছর। আমি হাঙ্গেরি পছন্দ করি এবং এখানে বাকি জীবন কাটতে চাই।"
গায়কদলের অন্য সদস্যদের মতো বিদেশে থাকলেও ছেন ছি সবসময় চীনের খোঁজখবর রাখেন। যখন চীনে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয় তখন তিনি ও অন্য চীনা মানুষ সবসময় অনুদান দেন। যদিও বুদাপেষ্টে প্রায় ২০ বছর ধরে আছেন, কিন্তু এখনও চীনা খাবার রান্না করেন ছেন ছি। যে স্কুলে তিনি কাজ করেন, সেখানে চীনা ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ১৫০ এবং তারা চীনের শিশুদের মতো চীনা শিক্ষা গ্রহণ করে। গায়কদলও বিদেশে চীনা সংস্কৃতি প্রচার করে। বুদাপেষ্টসহ হাঙ্গেরির বিভিন্ন শহরে চীনা সংগঠন আছে এবং তাদের কাছে থেকে বিদেশে বসবাসরত চীনারা সাহায্য-সহযোগিতা পেয়ে থাকে।