জাতীয় বাজেট হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের একটি বার্ষিক দলিল, যাতে রাষ্ট্রের বাত্সরিক আয়-ব্যয়ের পরিকল্পনা প্রকাশিত হয়।'বাজেট' একটি ইংরেজি শব্দ। শব্দটির ব্যুত্পত্তিগত অর্থ হচ্ছে 'থলে' বা 'ব্যাগ'। অতীতে থলেতে ভরে এটি সংসদে আনা হতো বলে দলিলটির নাম হয়ে যায় 'বাজেট'। বাংলাদেশে প্রতিবছর অর্থমন্ত্রী সংসদে যে বাজেট পরিকল্পনা পেশ করেন, তাতে দুটি মূল অংশ থাকে: রাজস্ব আয় সংক্রান্ত অংশ এবং সরকারি ব্যয় সংক্রান্ত অংশ। বাংলাদেশ রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর রাজস্ব আয় সংক্রান্ত প্রস্তাবসমূহ প্রণয়ন করে এবং অর্থ বিভাগ সরকারি ব্যয় সংক্রান্ত প্রস্তাবসমূহ প্রণয়ন করে। বাজেট আইনপ্রস্তাব বা 'বিল' আকারে জাতীয় সংসদে উত্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী। একে বলা হয় অর্থ বিল। সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন পেলে সেটি আইনে পরিণত হয়। বাংলাদেশে প্রতিবছর জুন মাসে জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ করা হয় এবং সংসদের যে অধিবেশনে বাজেট পেশ করা হয়, সেই অধিবেশনকে ডাকা হয় 'বাজেট অধিবেশন' নামে।
আর মাস দুয়েক পরেই বাংলাদেশের সংসদে ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরের বাজেট পেশ করা হবে। তাই শুরু হয়ে গেছে প্রাক-বাজেট ভাবনা। বাজেট নিয়ে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে বরাবরই একটা ভয় কাজ করে। তাদের কাছে বাজেট মানেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। বাজেট দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করলেই তারা প্রমাদ গুনেন। আর অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা পত্র-পত্রিকায় নিবন্ধ লিখে বা রেডিও-টিভির টক শোতে নিজেদের বাজেট-ভাবনা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশে প্রাক-বাজেট আলোচনা বলে একটা কথা আছে। এ আলোচনা বেসরকারি পর্যায়ে যেমন চলে, তেমনি চলে সরকারি পর্যায়ে। সম্ভাব্য বাজেট নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর এবং অর্থমন্ত্রী সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে ধারাবাহিক প্রাক-বাজেট আলোচনায় মিলিত হন। সে সব আলোচনার প্রভাব বাজেটে পড়তে দেখা যায়।
আগামী অর্থবছরের বাজেটকে সামনে রেখে এই প্রাক-বাজেট আলোচনা শুরু করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং শুরু করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। চলতি মাসে প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রাক-বাজেট আলোচনায় দেশের ৩০টি ব্যবসায়ী সমিতিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল; উপস্থিত হয়েছিলেন মাত্র ১২টি সমিতির নেতারা। স্বাভাবিকভাবেই হতাশ হন এনবিআর চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন। ঢাকায় এনবিআর-এর সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত আলোচনায় অবশ্য দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই-য়ের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
এনবিআর-এর সাথে প্রাক-বাজেট আলোচনায় উপস্থিত সব সমিতির নেতারাই তাদের নিজ নিজ ব্যবসা খাতের জন্য আগামী বাজেটে কর ও শুল্ক ক্ষেত্রে ছাড় চেয়েছেন। বিজ্ঞাপনের উত্সকর ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশে এবং কাগজকলগুলোতে ব্যবহৃত রাসায়নিকের আমদানি শুল্ক কমিয়ে ৩ শতাংশ করার দাবি তুলেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া, বাংলাদেশ পেপার ইমপোর্টাস অ্যাসোসিয়েশান, সিএনজি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশান, সুগার রিফাইনারি অ্যাসোসিয়েশান ইত্যাদির প্রতিনিধিরাও আসন্ন বাজেটে তাদের নিজ নিজ ব্যবসার জন্য অনুকূল প্রস্তাবনা রাখার দাবি জানান। তাদের দাবি শোনার পর এনবিআর চেয়ারম্যান সমিতিগুলোকে এফবিসিসিআইয়ের মাধ্যমে তাদের দাবিগুলো সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরার পরামর্শ দেন।
এদিকে, গত মাসের শেষ সপ্তাহে প্রথম প্রাক-বাজেট আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। তার সেই বৈঠক ছিল দেশের অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির গবেষকদের সঙ্গে। আলোচনা শেষে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, আগামী অর্থবছরের জন্য প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করা হবে। বস্তুত, এটি হবে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের বৃহত্তম বাজেট। অবশ্য, প্রতিবছরই বাজেটের আকার বাড়ছে; ফলে এক্ষেত্রে রেকর্ডও ভাঙছে প্রতিবছর। গত বছর বাজেট ছিল দুই লাখ বাইশ হাজার কোটি টাকার মতো।
অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, আগামী বাজেটে চারটি বিষয়কে সবচে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। বিষয় চারটি হচ্ছে: বিনিয়োগ, বেসরকারি খাত, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ, এবং শিক্ষা। শিক্ষা খাতে প্রতি বছরই দৃশ্যত সবচে বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে সে বরাদ্দের পুরোটা ব্যয় হয় না, এমন অভিযোগ আছে। বিনিয়োগ, বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে অসন্তুষ্ট অর্থমন্ত্রী। এর কারণও আছে। দীর্ঘকাল ধরেই বাংলাদেশে দেশি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ এক ধরনের স্থবিরতায় ভুগছে। গত পাঁচ বছরে দেশে বিনিয়োগের হার জিডিপির ২৫.৫ শতাংশ থেকে ২৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধির হার অত্যন্ত কম। অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ পরিস্থিতিকে তাই অর্থমন্ত্রী দেশের অর্থনীতির সবচে দুর্বল দিক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন, যেভাবেই হোক এক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধির হার বাড়াতে হবে। আরেকটি আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, গত পাঁচ বছরে সরকারি বিনিয়োগ যে-হারে বেড়েছে, বেসরকারি বিনিয়োগ সে হারে বাড়েনি। অথচ দেশের অর্থনীতির ৭০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে বেসরকারি খাত। এ কারণেই আগামী বাজেট প্রণয়নে বেসরকারি খাতের আস্থা অর্জনের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে চাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। আর, বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির কোনো বিকল্প দেখছেন না অনেক অর্থনীতিবিদ। খোদ এনবিআর-এর চেয়ারম্যান সম্প্রতি এক সেমিনারে বলেছেন, বিদেশি বিনিয়োগ প্রত্যাশিত মাত্রায় না-বাড়লে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা কঠিন হবে। বিদেশি বিনিয়োগ প্রতিবছরই বাড়ছে। ২০১৩ সালে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ১৭০ কোটি মার্কিন ডলারের। আশা করা যায় আসন্ন বাজেটে অর্থমন্ত্রী বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে কিছু বিশেষ প্রস্তাবনা পেশ করবেন।
বাংলাদেশে বাজেট মানেই ঘাটতি বাজেট। তবে আসন্ন বাজেটে ঘাটতি ৫ শতাংশের বেশি রাখা হবে না বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। রাজস্ব আয় বৃদ্ধির ব্যাপারেও তিনি আশাবাদ প্রকাশ করেছেন। চলতি অর্থবছর শেষে রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি ১৪.১ শতাংশে দাঁড়াবে বলে তিনি মনে করেন। আগামীতে এ প্রবৃদ্ধির হার ২০ শতাংশে পৌঁছাবে বলে অর্থমন্ত্রী আশা করেন।
প্রাক-বাজেট আলোচনায় অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা অর্থমন্ত্রীর সামনে কিছু সুপারিশ তুলে ধরেছেন। সুপারিশগুলোর মধ্যে আছে: ইউনিয়ন পরিষদে এক কোটি টাকা করে বাজেট বরাদ্দ দেওয়া, ভূমির যথাযথ ব্যবহারের পরিকল্পনা প্রণয়ন করা, কৃষিজমির স্বল্পতা ও সেচ সমস্যার সমাধানকল্পে কৃষির বহুমুখীকরণ, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি তখা পিপিপি-কে কার্যকর করা, অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা, ব্যাংক খাতে অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা শক্তিশালী করা, আমদানি খাতেও আর্থিক সহায়তা দেওয়ার বিধান চালু করা ইত্যাদি। এখন দেখার বিষয় বিশেষজ্ঞদের মতামত আসন্ন বাজেটে প্রতিফলিত হয় কি না বা হলেও, কতটুকু হয়। (আলিম)