0312lvyou
|
নেপালের লুম্বিনি বিশ্বের বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের কাছে একটি দারুণ পবিত্র ও রহস্যময় স্থান। কারণ, এখানেই জন্ম নিয়েছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধ। গত অনুষ্ঠানে আমরা লুম্বিনি সম্পর্কে কিছু তথ্য তুলে ধরেছিলাম। আজ আমরা আবারো বেড়াতে যাবো সেখানে, তুলে ধরবো বৌদ্ধ ধর্ম ও এর উত্পত্তি সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য। আলিম. লুম্বিনি দক্ষিণ নেপালের রুপানদেহি (rupandehi) জেলায় অবস্থিত। খৃষ্টপূর্ব ৬২৩ সালে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গৌতম বুদ্ধ এখানে জন্মগ্রহণ করেন। দেড় হাজার বছর আগে চীনের চিন রাজবংশের সন্ন্যাসী ফাহিয়ান চীনের সিনচিয়াং স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল থেকে ভারত অতিক্রম করে লুম্বিনি পৌঁছেছিলেন। তিনিই ছিলেন প্রথম বিদেশি, যিনি নেপাল সম্পর্কে প্রথমবারের মতো বিস্তারিত লিখেছিলেন। চীনের থাং রাজবংশের সন্ন্যাসী হুয়ান চাংও নেপাল সফর করেছিলেন। তিনি ৬৩৩ সালে সি'আন শহর থেকে রওয়ানা হয়ে ভারত অতিক্রম করে নেপালের লুম্বিনিতে এসেছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল বৌদ্ধ শাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা।
সুবর্ণা. সংস্কৃত ভাষায় লুম্বিনি অর্থ সুন্দর। প্রাচীনকালে নেপালের এক রাণির বাগানের নাম ছিল লুম্বিনি। পরে এ জায়গাটির নামই হয়ে যায় লুম্বিনি। বর্তমানে লুম্বিনি একটি ছোট গ্রাম। নিবিড় সবুজ বনের মধ্যে অবস্থিত গ্রামের দৃশ্য দারুণ সুন্দর। এখানে গৌতম বুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত অনেক পুরাকীর্তি। এখানে একটি সাদা রঙয়ের চারকোণাকৃতির স্থাপত্য দেখা যায়। পাথরে নির্মিত দুই স্তরের এই স্থাপত্যটি আসলে মায়াদেবি মন্দির। তিনি ছিলেন উত্তর ভারতের কাপিলাভাস্তু রাষ্ট্রের রাজা সুদ্ধদানার স্ত্রী। কথিত আছে, খৃষ্টপূর্ব ৬২৩ সালে নেপালের চান্দ্রপঞ্জিকার প্রথম মাসে তিনি মায়ের বাড়ি যাওয়ার পথে লুম্বিনি বাগানে একটি বড় শাল গাছের নিচে বিশ্রাম নেওয়ার সময় সিদ্ধার্থ গৌতমকে জন্ম দেন। এই সিদ্ধার্থ গৌতমই পরবর্তীকালে হন গৌতম বুদ্ধ।
আলিম. মায়াদেবী মন্দিরে একটি পাথরের মূর্তি আছে। মূর্তিটি মায়াদেবীর। মূর্তিটির পাশেই শিশু সিদ্ধার্থ। মায়াদেবী মন্দিরের কাছে একটি চারকোণা পুকুর অবস্থিত। কথিত আছে, এই পুকুরে মায়াদেবী ও শিশু সিদ্ধার্থ স্নান করতেন। পুকুরটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে পবিত্র হিসেবে গণ্য। পুকুরের পাশে একটি শাল গাছ আছে। প্রাচীনকালের চিন রাজবংশের সন্ন্যাসী ফাহিয়ান লুম্বিনি সফর করা পর একটি শাল গাছের কথা তার লেখায় উল্লেখ করেছিলেন। পরে থাং রাজবংশের সন্ন্যাসী হুয়ানসাং লুম্বিনি সফর শেষে তার লেখায় উল্লেখ করেন যে, সেই শাল গাছটি মরে গেছে। এ থেকে বোঝা যায় যে, লুম্বিনিতে বর্তমানে যে শাল গাছটি আছে, সেটি পরবর্তী কোনো সময়ে লাগানো হয়। লুম্বিনি কোনো বড় শহর নয়; এখানে লোকসংখ্যাও খুব বেশি না। কিন্তু এখানে সুন্দর সুন্দর বাগান গড়ে তোলা হয়েছে, গাছ লাগানো হয়েছে, গড়ে তোলা হয়েছে গ্রন্থাগার। পর্যটক ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য এখানে খাওয়া-থাকার সুবন্দোবস্ত আছে। জাপানিরা এখানে পাঁচ তারা হোটেলও নির্মাণ করেছেন। যারা এখানে ভ্রমণে এসে আরামে থাকতে চান, তারা পাঁচ তারা হোটেলে থাকতে পারেন। এতে খরচ অবশ্য বেশি হবে।
সুবর্ণা. ভারতের মহারাজা অশোক ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের ভক্ত। তাঁর নির্দেশে লুম্বিনি অঞ্চলের মানুষের জন্য সবধরনের কর মাফ করে দেওয়া হয়। তার নির্দেশে সেখানে গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থানে পাথরের একটি ভাস্কর্য্যও নির্মিত হয়। একটি কক্ষে এটি এতোদিন লোকচুক্ষুর অন্তরালে ছিল। ১৯৯৩ সালে রাস্তা মেরামত করার সময় সেটি লোকজনের নজরে আসে। কিন্তু ততদিনে সেটি প্রায় বিধ্বস্ত হয়েছে। মায়াদেবী মন্দিরের উত্তর দিকে রাজা অশোক নিজের জন্য একটি পাথরস্তম্ভ নির্মাণ করেছিলেন। সেই পাথর স্তম্ভের উচ্চতা ৬ মিটার। স্তম্ভটি গোলাকার। খৃষ্টপূর্ব ২৪৯ সালে অশোক গৌতম বুদ্ধর জন্মস্থানে শ্রদ্ধানিবেদন করার সময় স্তম্ভটি নির্মিত হয়। পরবর্তীকালে সেটি লুম্বিনির একটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসিক পুরাকীর্তিতে পরিণত হয়। মায়াদেবী মন্দিরের দক্ষিণ দিকে নির্মাণ করা হয়েছে বৌদ্ধ প্যাগোডা ও মন্দির। মন্দিরের দেয়ালে গৌতম বুদ্ধর জীবনসম্পর্কিত বিভিন্ন বহুবর্ণ ছবি অঙ্কিত আছে।
আলিম. বৌদ্ধ ধর্ম বিশ্বের অনেক অঞ্চলে প্রচলিত। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া, চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে এই ধর্মের প্রচলন হয়েছে ব্যাপকভাবে। লুম্বিনি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে একটি অতি পবিত্র স্থান। হাজার বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের এটি আকর্ষণ করে আসছে। প্রতিবছর কোটি কোটি লোক দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে গৌতম বুদ্ধর জন্মস্থান পরিদর্শন করতে আসেন। প্রতি বছর গৌতম বুদ্ধর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে লুম্বিনিতে আয়োজন করা হয় মহান মন্দির মেলা। স্থানীয় অঞ্চলের লোকেরা গৌতম বুদ্ধর মূর্তি একটি সুন্দর সাজানো কাঠের গাড়িতে রেখে বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে। এসময় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা মূর্তির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে।
সুবর্ণা. লুম্বিনি বিশ্ব বিখ্যাত পর্যটন স্থানগুলোর অন্যতম। এ জায়গাটি শান্তি ও পারস্পরিক সমঝোতার প্রতীক। গৌতম বুদ্ধর স্মৃতিবিজড়িত লুম্বিনি শান্তি ও পবিত্রতার প্রতীক। ১৯৭৮ সালে লুম্বিনি উন্নয়ন এলাকা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বিশ্বের বিভিন্ন বৌদ্ধ ধর্মের দেশ এখানে সুন্দর সু্ন্দর মন্দির নির্মাণ করেছে। প্রতিটি মন্দিরই নিজস্ব বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। আপনারা লুম্বিনিতে বেড়াতে আসলে বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন শাখার বৈশিষ্ট্য অনুভব করতে পারবেন। পর্যটকরা সাইকেল ভাড়া করে বিভিন্ন মন্দির পরিদর্শন করতে পারেন।
আলিম. লুম্বিনির পশ্চিম মন্দির এলাকায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নির্মাণ করা মন্দির দেখা যায়। মায়াদেবী মন্দিরের উত্তর দিকের 'অনন্ত শিখা' (eternal flame) থেকে শুরু করে পশ্চিম তীরের মেডিডেশন কেন্দ্র পর্যন্ত অনেক মন্দির রয়েছে। সেখান থেকে আরো উত্তর গেলে চোখে পড়বে সিংগাপুর ও নেপাল কর্তৃক ২০০১ সালে যৌথভাবে নির্মিত মন্দির। মন্দিরের দেয়ালে চমত্কার সব ছবি আঁকা। মন্দিরের পাশেই আছে একটি বড় আকারের বৌদ্ধ প্যাগোডা। মন্দিরের বাইরের রাস্তা ধরে দক্ষিণ দিকে গেলে, উত্তর নেপালের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা নির্মিত 'মানাং সমাজ গম্পা' (manang samaj gompa) চোখে পড়বে। এ মন্দিরের পশ্চিম দিকে অবস্থিত পবিত্র চোংহুয়া চীনা মন্দির। এর দু'পাশে চীনের কনফুসীয় সম্প্রদায়ের মহান ব্যক্তিদের মূর্তি আছে। মন্দিরটিকে দূর থেকে দেখলে পেইচিংয়ের 'নিষিদ্ধ নগর' বা ফরবিডেন সিটির কথা মনে পড়বে। রাস্তার উত্তর দিকে দক্ষিণ কোরিয়া সরকার ও ভিয়েতনামের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের উদ্যোগে নির্মিত মন্দির দেখা যায়। তা ছাড়া, মঙ্গোলিয়া, ভুটান, অস্ট্রেরিয়া ও ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশ কর্তৃক নির্মিত মন্দিরও এখানে রয়েছে।