বসন্ত উৎসব উপলক্ষ্যে চীনারা প্রতিষ্ঠানভেদে ৩ থেকে ৭ দিন বিশেষ ছুটি পেয়ে থাকেন। অপরদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দীর্ঘ শীতকালীন ছুটি থাকায় শিক্ষার্থীরা আরো বেশি ছুটি পেয়ে থাকে।
এর আগে আমি চীনে ঈদুল আযহা, মধ্যশরত উৎসব এবং ক্রিসমাস উদযাপন করেছি। বসন্ত উৎসবের আগে আমার অনেক চীনা বন্ধু এবং শিক্ষক তাদের বাড়িতে আমাকে উৎসবে অংশ নেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। সাধারণ চীনা মানুষদের সাথে তাদের সবচেয়ে বড় উৎসবে সঙ্গী হতে পারা আমার বড় সৌভাগ্য।
চীনা মানুষের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং বহুল ব্যবহৃত পরিবহন হলো রেলগাড়ি। দেড়শ কোটি মানুষের দেশের রেল ব্যবস্থা অবকাঠামোগত দিক থেকে নি:সন্দেহে সারা বিশ্বে প্রথম। রেল ব্যবস্থা সারা চীনকে অত্যাধুনিক সড়ক যোগাযোগের আওতায় এনেছে। আমার সৌভাগ্য যে আমি বাংলাদেশের পর চীনের রেল সেবা নেওয়ার সুযোগ পেয়েছি এবং বিস্মিত হয়েছি। চীনে রেলভ্রমণ সবচেয়ে নিরাপদ, সাশ্রয়ী এবং সব রেলই ঘড়ির কাঁটা
মেপে চলে যা যোগাযোগ নেটওয়ার্কে বড় প্রয়োজন। বসন্ত উৎসব উপলক্ষ্যে সাধারণত সব মানুষ তাদের পরিবারের সাথে মিলিত হওয়ার চেষ্টা করে। এ কারণে রেল ব্যবস্থার উপর প্রচন্ড চাপ পড়ে। এসময় প্রতিদিন গড়ে ৭০ থেকে ৮০ লাখ মানুষ ট্রেনে যাতায়াত করে এবং বিশেষ ট্রেন সংযোজন করা হয়। এ বছর বহু সংখ্যক মানুষ টিকিট না পেয়ে বাড়িতে যেতে পারেনি এবং অনেকে তাদের মোটর বাইক নিয়ে শত শত কিলোমিটার পথ
পাড়ি দিয়েছে। বিশাল এ মোটর যাত্রায় চীনা পুলিশ মহাসড়কে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে।
বসন্ত উৎসব উদযাপনে আমি গিয়েছিলাম হপেই প্রদেশের ছাংচৌ প্রশাসনিক শহরের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিংশিয়ান কাউন্টিতে। ছিংশিয়ান চীনের জাতীয় মহাসড়কের পেইচিং-সাংহাই বা পেইচিং-তাইপে এক্সপ্রেসওয়ে ধরে পেইচিং থেকে খুব কাছে। পেইচিং ছাড়াও এটি ছাংচৌ এবং থিয়েনচিনের কাছে ছোট্ট কিন্তু সুন্দর শহর। ছিংশিয়ানে এটা আমার তৃতীয়বার ভ্রমণ।
পুরনো বছরের শেষ দিনটিতে মূলত নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর জন্য নানা কার্যক্রম পুরোমাত্রায় শুরু হয়ে থাকে। এদিনে সারা বাড়ি জুড়ে 福(fu) লেখা রং-বেরংয়ের কাগজ সেঁটে দেওয়া হয়। ফু শব্দের অর্থ হলো সুখ। অর্থাৎ এর মাধ্যমে সুখ এবং সুন্দর আগামী প্রত্যাশা করা হয়। ফু এর পাশাপাশি প্রচুর পরিমানে লাল রংয়ের পেপার কাটিং সাঁটানো হয়। গত বছরটি ছিলো সাপ বছর বা সর্প বর্ষ। তাই পর্যায়ক্রমে এ বছর
হলো 马年(ma nian) বা ঘোড়া বর্ষ। তাই এ বছর পেপার কাটিং বা নববর্ষের সব অনুষঙ্গেই ঘোড়ার প্রতিকৃতি স্থান পেয়েছে। বাড়ির মূল গেট থেকে শুরু করে বাইরের দেওয়াল, ঘরের দরজা-জানালা, ভেতরের দেওয়াল, আসবাবপত্র সর্বত্র এধরণের পেপার কাটিং, স্টিকার বা বিখ্যাত কবিতাংশ লেখা কাগজ লাগানো হয়। পুরনো বছরের শেষদিনে পরিবারের সব সদস্য এবং নিকটাত্মীয়রা একসাথে রাতের খাবার খেয়ে থাকেন। বসন্ত উৎসব
উপলক্ষ্যে নানা ধরণের সুস্বাদু খাবার তৈরী করা হয়। ঐতিহ্যগতভাবে বাড়িতে খাবার অনুষ্ঠানের আয়োজন করার নিয়ম থাকলেও বর্তমানে পারিবারিক পুনর্মিলনের এই সান্ধ্যভোজটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রেস্টুরেন্ট এ হয়ে থাকে। এই রাতে ছোট ছেলেমেয়েরা বড়দের কাছ থেকে লাল রংয়ের নকশা করা খামে নগদ টাকা উপহার পায় এবং বড়দের সম্মান জানায়। এর অর্থ পরস্পরের প্রতি শুভকামনা এবং উজ্বল আনন্দময়
আগামীর প্রত্যাশা।
চীনে মুসলমান, বৌদ্ধ ও খৃষ্টান ধর্মের মানুষ যেমন আছে তেমনি স্থানীয় তাও ধর্মের অনুসারীও আছে। তবে চীনের অধিকাংশ মানুষই কোন ধর্মে বিশ্বাস করে না। আমি যে পরিবারটিতে গিয়েছিলাম তারা কোন ধর্মের অনুসারী নয়। কিন্তু আমি খুবই অবাক হয়েছি সেদিন রাতে তারা সবাই রান্না ঘরে স্থাপিত 'প্রভূ'র প্রতিকৃতির সামনে নানা ধরণের খাদ্যদ্রব্য, মোমবাতি, আগরবাতি এমনকি প্রভু'র খাবার সুবিধার্তে
চপস্টিক পর্যন্ত সাজিয়ে রেখে তার সামনে সেজদা দিয়েছেন। কোন ধর্মের অনুসারী না হয়েও, সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস না থাকার পরও ঐতিহ্যগতভাবে তারা এই কাজটি প্রতিবছর করে থাকে। এ সময় বাড়িতে প্রচুর পরিমাণে পটকা ফোটানো হয়। এ রাতে প্রচুর পরিমাণে চীনা টাকা এবং পয়সার প্রতিলিপি পোড়ানো হয়। এর মাধ্যমে পরলোকগত পরিবারের সদস্যদের আত্মার শান্তি কামনা করা হয়।
বসন্ত উৎসবের সবচেয়ে দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য বিষয় হচ্ছে বিপুল পরিমাণ পটকা ও আতশবাজির ব্যবহার। সারা চীনে কি পরিমাণ আতশবাজি আর পটকা'র ব্যবহার হয় তা বোধহয় কেউ আন্দাজও করতে পারবে না। সারা দিন রাত এখানে সেখানে পটকা আর আতশবাজির আওয়াজ পাওয়া যায়। বছরের শেষ রাতে সারা রাত পুরো বাড়িতে আলো জ্বালিয়ে রাখা হয়। 'প্রভু'র সামনে যথারীতি খাদ্যদ্রব্য, মোমবাতি-আগরবাতি জ্বালিয়ে রাখা হয়,
বাজতে থাকে উপাসনা সঙ্গীত। বাড়ির বড়রা সারা রাত নির্ঘুম কাটায়, ছোটরা মধ্যরাত অবধি জেগে থাকে। এদিন সন্ধ্যায় পরের দিন সকালে খাওয়ার জন্য বিশেষ ডাম্পলিং তৈরী করা হয়। এই ডাম্পলিংয়ে মাংস এবং তেল ব্যবহার করা হয় না। তাদের বিশ্বাস, প্রভু মাংস এবং তেল খান না, তাই প্রভুকে খুশি রাখতে এদিন বিশেষ ডাম্পলিং তৈরী করা হয়।
বছরের প্রথম দিন ভোর বেলায় বাড়ির সদর দরজা খুলে দেওয়া হয়। সদর দরজা থেকে ড্রয়িংরুম পর্যন্ত লাল গালিচা বিছানো হয়। এর মাধ্যমে অতিথিকে স্বাগত এবং সম্মান প্রদর্শন করা হয়। সকাল হতেই নিকটাত্মীয় এবং প্রতিবেশিরা একে অপরের বাড়িতে কুশল বিনিময় করতে যান এবং আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। এর মাধ্যমে বসন্ত উৎসব তথা ১৫ দিন ব্যাপী নতুন বছরের উদযাপনী অনুষ্ঠান আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। এ সময়ের
মধ্যে তারা মূলত আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং প্রতিবেশিদের সাথে কুশল বিনিময় এবং একসাথে খাবার খেয়ে থাকেন। বসন্ত উতসব উপলক্ষ্যে উপহার বিনিময়ের মধ্যে কমলা অত্যন্ত জনপ্রিয়। সাধারণত 福 ফু লেখা কাগজে মুড়ে চারটি কমলা দেওয়া হয় যার মধ্যে দুইটি কমলা আবার ফেরত দেওয়া হয়। এর অর্থ অনুরূপ ভালোবাসা এবং সম্মান প্রদর্শন। ভোজের পর তারা একসাথে আনন্দময় ইনডোর গেমস-এ অংশ নিয়ে থাকেন।
বসন্ত উৎসবের দিন আমার বন্ধুর দুই ফুফু আমাকে দুপুরের এবং রাতের খাবারের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। চীনা পরিবারের সাথে বাড়িতে তৈরী খাবার খাওয়া আমার জন্য সতিই স্মৃতিময় অভিজ্ঞতা।
বসন্ত উতসবের প্রথম দিন সানন্দে অতিবাহিত করে রাতে পরিবারের সবাই একসাথে বিশেষ টেলিভিশন অনুষ্ঠান উপভোগ করে থাকেন। সিসিটিভি এদিন বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে যাতে সারা চীনের জনপ্রিয় তারকাদের পাশাপাশি বিদেশি শিল্পীরাও অংশ নেয়। এসব অনুষ্ঠানের মধ্যে নাচ, গান, মজার নাটিকা, এক্রোব্যাটিক ইত্যাদি অংশ থাকে।
দীর্ঘ পনের দিনের এই বসন্ত উৎসব উদযাপন পূর্ণিমা রাতে আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত হবে। সমাপনী উদযাপনের নাম লন্ঠন উৎসব। লন্ঠন উৎসব দেখার অপেক্ষায় রইলাম।
(মহাচীনের ছোট্ট একটি কাউন্টিতে একান্তই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে এই রচনাটি লেখা হয়েছে। স্থানভেদে বসন্ত উৎসব পালনের রীতিনীতিতে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। তবে এই উৎসবের মূল উদ্দেশ্য কেবলই একটি নতুন বছরের আগমনে আনন্দ প্রকাশ নয়, এর উদ্দেশ্য মানুষে মানুষে পারস্পরিক সমঝোতা এবং সহযোগিতা বৃদ্ধি, ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শন এবং সকলের সুন্দর ভবিষ্যত প্রত্যাশা।
স্থান-কাল-পাত্র ভেদে এই উদ্দেশ্যের কোন পার্থক্য নেই।)
মো: লুৎফর রহমান
পরিচালক, চায়না রেডিও ফ্যান ক্লাব
(চীনের ইয়ানশান বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত)