0212china
|
চু মা চে রাং
প্রথমে আমারা চীনা ছিংহাই প্রদেশের তিব্বতি জাতির একটি জেলায় যাব এবং সেখানে আমরা তিব্বতি জাতির ঐতিহ্যবাহী শিল্প লা ইর সঙ্গে পরিচিত হব।ছিংহাই প্রদেশের কুং হে জেলার লোকসংখ্যা ৫০ হাজারেরও কম তবে লা ই ভবন এখানে খুব জনপ্রিয় ছিল। তিব্বত ভাষায় 'লা' মানে পাহাড় এবং 'ই' মানে গান। 'লা ই' হল তিব্বতি তরুণতরুণীর মধ্যে ভালবাসা প্রকাশের একটি শৈল্পিক পদ্ধতি। অবশ্য যে জায়গায় মানুষ লা ই গায় সেখানটার নাম লা ই ভবন। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা একটি ঐতিহ্যবাহী লা ই ভবন দেখব।
লা ই তিব্বতি জাতির ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির ভাণ্ডার। চীনের জাতীয় পরিষদ ২০০৬ সালে লা ইকে চীনের অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। লা ইর উন্নয়ন ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে কুং হে জেলা একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা।
পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সি চু মা চে রাং একটি লা ই ভবন চালান এবং তিনি ছিংহাই প্রদেশের লা ই শিল্পের উত্তরাধিকারী। ওই লা ই ভবনে তিনি আরেকজন উত্তরাধিকারিণী চি মাও চিয়ার সঙ্গে লা ই শিখান। আশেপাশের অধিবাসী ছাড়া অনেক দূর থেকে আগতরাও এখানে লা ইর বিশারদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেন।
আজ রাতে চি মাও চিয়া তার একজন পুরাতন প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামেন। চু মা চে রাং জানান, লা ই নানা রকমের এবং ভালবাসার নানা বিষয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এটিকে। মানুষ সাধারণত উন্মুক্ত স্থানে ও উত্সবের সময়ে লা ই গায়।
চু মা চে রাং বলেন:
"লা ইর কিছু নিয়ম আছে যেমন প্রথমে আমরা 'আমি তোমাকে ভালবাসি' বলি না। প্রথমে আমরা রূপকের মাধ্যমে অপর পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করার ইচ্ছা প্রকাশ করি। যেমন আমি গাই - আমার হাতে দড়ি আছে এবং আমি একটি ভাল ঘোড়া খুঁজে পাচ্ছি। এবং যখন প্রেমিকার কথা আমার মনে পড়ে আমি গাইব তুষারমৌলি পাহাড় দেখে জন্মস্থানের কথা মনে পড়ে, তৃণভূমি দেখে ছোটবেলার কথা মনে পড়ে এবং গরু দেখে প্রমিকার কথা মনে পড়ে - এ রকম। আমার গান শোনার পর মেয়েটি যদি আমাকে পছন্দ করে তাহলে সেও গান গায়। গানের মাধ্যমে দুজনের মধ্যে যোগযোগ হয়।"
চি মাও চিয়া ও চু মা চে রাং কুং হে জেলায় জন্মগ্রহণ করেন এবং সেখানেই বড় হয়েছেন। ছোটবেলা থেকে লা ই শিখেছেন এবং অনেক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। চীনের বিখ্যাত লা ই মাস্টার চিয়ে চি চু মার কাছ থেকে শিখেছেন তিনি। চু মা চে রাং বলেন:
"১৪-১৫ বছর বয়স থেকে গ্রামে পিতা বা চাচার কণ্ঠে গাওয়া লা ই শুনেছি এবং ২০ বছর বয়স থেকে আমি টেপ বা সিডির মাধ্যমে লা ই শিখেছি। পরে আমি কিছু প্রতিযোগিতায় অংশ নিই। গ্রাম থেকে জাতীয় পর্যায়ের সব প্রতিযোগিতায় অংশ নেই আমি এবং এ প্রক্রিয়ায় আমি লা ইকে ভালবেসে ফেলি।"
চি মাও চিয়া
যখন গান না গান তখন খুব শান্ত থাকেন চি মাও চিয়া। তার লাল মুখে রয়েছে দুটি জ্বলজ্বল চোখ এবং মুখে সব সময় মৃদুহাস্য দেখা যায়। এ পর্যন্ত তিনি ১০-১২টি অ্যালবাম প্রকাশ করেছেন এবং সারা তিব্বতি আবাসিক এলাকায় জনপ্রিয় গায়ক তিনি।
১৯৮৪ সালে ১৮ বছর বয়সী চি মাও চিয়া মায়ের উত্সাহে প্রথম বারের মতো একটি লা ই প্রতিযোগিতায় অংশ নেন এবং চ্যাম্পিয়ন হন। পরে এক একটি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তিনি সাহস ও গান গাওয়ার মজার পেয়েছেন। চি মাও চিয়া বলেন:
"ভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে ভিন্ন লা ই গাই। দুজনের মধ্যে ভিন্ন অনুভূতি হলে ভিন্ন প্রেম গান গাওয়া যায়। যে প্রতিযোগিতা আমার মনে সবচেয়ে গভীর ছাপ ফেলে সেটি ছিংহাই প্রদেশের হাই নান রাজ্যের একটি প্রতিযোগিতা। কারণ প্রথম স্থান অর্জন করার পর আমি জনপ্রিয় হয়ে উঠি।"
যখন লাইর উন্নয়ন ও উত্তরাধিকারের কথা ওঠে, চু মা চে রাং তার চিন্তা প্রকাশ করেন। আধুনিক সংস্কৃতি ও শহরায়নের প্রভাবে লাইর উত্তরাধিকার অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। । চু মা চে রাং বলেন:
"আমাদের আবাসিক পরিবেশ পরিবর্তিত হয়েছে। আগে পশুচারণ করতাম আমরা এবং যেখানে যেতাম সেখানেই গান গাইতাম। আমরা গানে পাহাড়, নদী ও পশু – এগুলোকে স্থান দেই এবং সংস্কৃতি আমাদের গানের উত্স। তবে বর্তমানে অনেক পশুপালক ঘরে বসবাস করে এবং জীবনযাপনের রীতি ও ধারণা পরিবর্তিত হয়ে গেছে। মানুষের কল্পনাশক্তি আগের চেয়ে কমে গেছে। যেমন আগে আমরা দুটি পাহাড় দেখে তাদেরকে দুজন সুন্দরী বলে অভিহিত করতাম। তবে বর্তমানে আমরা শুধু গগনচুম্বি ভবন দেখতে পাই এবং ও ভবনগুলো দেখে কোনো কল্পনা জাগে না বলে সাংস্কৃতিক চিন্তা বিলুপ্ত হয়ে যায়।"
চু মা চে রাং বলেন, তার লা ই ভবনে পরিবেশনকারীর সংখ্যা প্রায় এবং তাদের বয়স ২০ ও ৩০ বছরের মধ্যে। সাধারণ অনুষ্ঠান ছাড়া প্রতি বছর তিনি ১-২ মাসের প্রশিক্ষণ আয়োজন করেন। চু মা চে রাং বলেন:
"বর্তমানে অধিকাংশ লা ই পরিবেশনকারীর বয়স ৩০-৪০ বছর বয়স এবং তরুণতরুণীর সংখ্যা কম। আমি লা ইর ঐতিহ্যবাহী শিল্পরীতি তাদেরকে শিখাই। যদিও আমার কাজে কিছু সাফল্য এসেছে, তবুও আমি এখনও আশা করি লা ই সংরক্ষণে সরকার আরও বেশি প্রচেষ্টা চালাবে। কারণ সারা তিব্বতি জাতি লাই খুব পছন্দ করে।"
লা ইর উন্নয়নে ২০১১ সালে হাই নান রাজ্যের ৮০জন লাই শিল্পী লা ই কমিশন প্রতিষ্ঠা করেন। লা ইর উন্নয়নের ক্ষেত্রে চু মা চে রাং তার প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বলেন:
"প্রথমত আমি আশা করি, সরকারের উদ্যোগে আরও বেশি লা ই প্রতিযোগিতা আয়োজিত হবে। তরুণতরুণীরা প্রতিযোগিতার মধ্যমে বড় হবে এবং এ শিল্পকে পছন্দ করবে। দ্বিতীয়ত, লা ই জাতীয় অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে এবং সরকারের সাহায্যে একটি পেশাদার প্রশিক্ষণকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আশা করি।"
সাক্ষাত্কার শেষে লা ই ভবনে গিয়ে সংবাদদাতা দেখেন লা ই ভবনের ছোট মঞ্চে প্রতিযোগিতা চলছে এবং দর্শকরা মন দিয়ে লা ই শুনছেন। আশা করি, তিব্বতি জাতির এ বিশেষ অনানুষ্ঠানিক শিল্প চিরকালের মতো সবার মনে ও জীবনে থাকবে।
আচ্ছা প্রিয় শ্রোতা, এতক্ষণ আপনারা তিব্বতি জাতির লা ই শিল্প নিয়ে একটি প্রতিবেদন শুনলেন।