Web bengali.cri.cn   
'পৃথকীকরণ দেয়াল ভাঙ্গা' ফিলিস্তিন-ইসরায়েল বোঝাপড়া
  2015-01-25 19:47:45  cri

এঁকেবেঁকে যাওয়া পৃথকীকরণ দেয়াল ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনকে বিভক্ত করেছে। তবুও অনেক ইসরায়েলি জর্ডান নদীর পশ্চিত তীরে হেঁটে হেঁটে নিজের চোখে সেখানে বসবাসকারী ফিলিস্তিনিদের জীবনযাত্রা দেখতে চায়। সম্প্রতি জর্ডান নদীর পশ্চিম তীরের শহর - জেরিকোর গামীণ ভ্রমণ অনেকের সে আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেছে। এখন শুনবেন চীন আন্তর্জাতিক বেতারের সংবাদদাতা জাং চিন ও ওয়াং ছিয়ানের পাঠানো ‌এ সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন।

এবারের জেরিকো ভ্রমণ ছিল 'ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সৃজনশীল আঞ্চলিক উদ্যোগ' অর্থাত্ আইপিসিআরআই নামক সংস্থার 'পৃথকীকরণ দেয়াল ভাঙ্গা' জর্ডান নদীর পশ্চিম তীরের ভ্রমণগুলোর অন্যতম। ভ্রমণে প্রায় ৪০জন অংশগ্রহণকারীর মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন ইসরায়েলি নাগরিক। আইপিসিআরআই-এর ফিলিস্তিন অঞ্চলের প্রধান রিমান বারাকাত বলেন, 'পৃথকীকরণ দেয়াল ভাঙ্গা' ভ্রমণের মাধ্যমে ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সঙ্গনিরোধ অতিক্রম করা হবে। তিনি বলেন,

"ইসরায়েল সরকারের বিচ্ছিন্ন নীতির কারণে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ খুবই কম। একে অপরকে উপলব্ধির অভাব রয়েছে তাদের। তাই আমরা এ ধরনের উপায়ে ইসরায়েলিদেরকে নিজেদের চোখে ফিলিস্তিন দেখানো এবং মনস্তাত্ত্বিক বাধা ও ভুল বোঝাবুঝি দূর করার চেষ্টা করি। এ ধরনের নিজস্ব অভিজ্ঞতা খুব প্রয়োজনীয়।"

ভ্রমণের প্রথম বিরতি ছিল একটি ফিলিস্তিন শরণার্থী শিবির, যার প্রবেশদ্বারে রয়েছে একটি বিরাট চাবির ভাস্কর্য। ওপরে আরবি ও ইংরেজি দুই ভাষায় লেখা 'আমরা ফিরে আসবো'। ফিলিস্তিনি পথনির্দেশক হুসাম জুবরান জানান, এ ধরনের ভাস্কর্য প্রায় প্রতিটি ফিলিস্তিন শরণার্থী শিবিরের প্রবেশদ্বারে দেখা যায়। এটা নিজেদের ভূমি ত্যাগে বাধ্য হওয়া ফিলিস্তিনিদের হৃদয়ে মাতৃভূমির প্রতীকে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন,

"মানুষ যে কারণেই নিজ ভূমি ত্যাগ করুক না কেন, তারা মনে করে, তারা ফিরে আসবে। সুতরাং তারা সবকিছু বাসায় রেখে তালা লাগিয়ে শুধু চাবি নিয়ে চলে যায়। কিন্তু আস্তে আস্তে তারা বুঝতে পারে, তারা আর ফিরতে পারবে না। সুতরাং চাবিটা তাদের এবং ছেড়ে আসে স্বদেশভূমির সঙ্গে একমাত্র যোগাযোগ এবং একমাত্র আবেগের অবলম্বন হয়ে যায়। তাই চাবি এবং 'আমরা ফিরে আসবো'-এ প্রত্যয় ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের চূড়ান্ত প্রতীকে পরিণত হয়।

কিন্তু কয়েক দশক চলে গেলেও ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরের পুনর্বাসন এখনও একটি অমীমাংসিত বিষয় রয়েছে। জেরিকো ভ্রমণে অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই তাই মনে করেন, সব ফিলিস্তিনি শরণার্থীর স্বদেশে ফিরে যাওয়া একটি অসম্ভব ব্যাপার। একজন নারী ভ্রমণকারী বলেন,

"৬০ বছরেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে। শরণার্থীদের আগের আবাস ফিরিয়ে দেওয়া বাস্তবে একেবারে সম্ভব নয়। আমার মনে হয়, ইসরায়েলের শরণার্থী সমস্যা স্বীকার করা উচিত। কিন্তু তাদের ফিরে আসা অসম্ভব। এ সমস্যার একটি সমাধান পরিকল্পনা থাকা উচিত। হয়তো সেটা তাদের অর্থনৈতিক ক্ষতিপূরণ; তবে তাদের আবার ফিরে আসা নয়।"

ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের দীর্ঘমেয়াদি সংঘাত্ এবং ইতিহাস ও বর্তমান পরিস্থিতির ব্যাপারে ভিন্ন মন্তব্যের কারণে ইসরায়েলি এবং তাদের ফিলিস্তিনি পথনির্দেশকের মধ্যে প্রশ্ন-উত্তর ও বাদ-প্রতিবাদ ছিল পুরো ভ্রমণ জুড়ে। কিন্তু তাদের অধিকাংশই মনে করেন, পারস্পরিক যোগাযোগ ও পারস্পরিক বোঝাপড়া একটি প্রয়োজনীয় ব্যাপার। একজন নারী ভ্রমণকারী বলেন,

"ভ্রমণে অনেক বিতর্কিত ইস্যু তোলা হয়েছে। সবাই নিজেদের মতামত প্রকাশ করেছেন। সবাই খুবই সতর্কতার সাথে মত প্রকাশ করেছেন। আমেজটা খুবই উত্সাহ-উদ্দীপনাময়। আমার মনে হয়, এটা খুবই ভালো। আমাদের আরো বেশি সংলাপ দরকার।"

দশ হাজার বছর আগেও জেরিকোয় মানুষের বসবাস ছিল। ১৯৯৩ সালে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে 'ওসলো চুক্তি' স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ফিলিস্তিনকে ফিরিয়ে দেওয়া অঞ্চলগুলোর অন্যতম এটি। এ ভ্রমণে অন্তর্ভূক্ত ছিল রাজনৈতিক বিষয় থেকে শুরু করে দৃশ্য দর্শন পর্যন্ত। শরণার্থী সমস্যা ছাড়াও পানিসম্পদ এবং সীমান্তে পরীক্ষাসহ বিভিন্ন পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা হয় ভ্রমণকালে। পাশাপাশি অংশগ্রহণকারীরা এখানকার বিখ্যাত কুরানতুল আশ্রম এবং হিশাম প্রাসাদসহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান ও দৃশ্যবলী দেখতে পান।

পর্যটকের মধ্যে ছিলেন ২০০০ সালে দ্বিতীয় ফিলিস্তিন বিদ্রোহের পর আর জেরিকোতে আসেননি এমন বেশ কজন প্রবীণ। একজন প্রবীণ বলেন,

"আমি অনেক অনেক বছর জেরিকোয় আসিনি। অনেক আগে আমরা এখানে আসতে এবং খেতে খুবই পছন্দ করতাম। এখানে আমার অনেক বন্ধু আছেন। কিন্তু এখন এখানে আসা খুবই কঠিন। তাই এখানে আসতে পেরে আমি খুব আনন্দিত।"

প্রথমবারের মতো এখানে আগত ফিলিস্তিনি তরুণ-তরুণীর সংখ্যা বেশ ছিল সফরকারী দলে। তাদের কারণে দর্শনীয় স্থানে তড়িঘড়ি সফর সম্পন্ন করা যায় না।

"আমার প্রত্যাশা আরো বেশি। আমি আরো বেশি ফিলিস্তিনির সঙ্গে দেখা করতে চাই। সড়কে বেড়ানো, বাজারে হাঁটা, কিছু মজার জায়গা দেখা এবং আরো বেশি সময় আশেপাশে হেঁটে মানুষের সঙ্গে কথা বলতে চাই। আমি আরো বেশি জানতে চাই। আগে শোনা ব্যাপার ও জিনিস এখন নিজের চোখে দেখতে চাই।"

ভ্রমণের সর্বশেষ অংশ – জেরিকো শহরের কেন্দ্রস্থলে কিছুক্ষণ অবাধ ঘোরাফেরা – কিছু মাত্রায় সে ধরনের ইচ্ছে পূরণে সহায়ক হয়। প্রায় প্রত্যেকে কম-বেশি জিনিস কেনেন। সেগুলোর বেশিরভাগ ইসরায়েলে পাওয়া যায় না এমন ছোটখাট পণ্য। কেউ কেউ কেনেন টাটকা ও সস্তা সবজি ও ফল। একজন ইসরায়েলি যুবক একটি খুবই বড় লেটুস কিনেন। এটি কিনতে পেরে তিনি খুব তৃপ্তি লাভ করেন। তিনি বলেন,

"আগে আমি রামাল্লায় গিয়েছি। আমি আরব শহরগুলোকে খুব পছন্দ করি। কারণ খুব মজা লাগে। তাই বেড়াতে খুব ভালো লাগে। সবশেষে আমাদের শহরে এবং বাজারে বেড়াতে দেওয়া হয়। এটাতে আমার খুব আনন্দ ও মজা লাগে। আশা করি, আরো বেশি এখানে আসতে পারবো। কিন্তু এটা খুবই কঠিন বিষয়।"

অধিকাংশ ইসরায়েলির জন্য ফিলিস্তিন-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে যাওয়া খুব ভয়ের ব্যাপার। তারা দলে সেখানে যেতে চায়, একা একা যেতে চায় না। প্রতিটি ফিলিস্তিন-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের প্রবেশদ্বারে বিরাট সতর্কতামূলক নোটিশ থাকে। এতে ইসরায়েলি নাগরিকদেরকে এ ধরনের অঞ্চলে প্রবেশে নিষেধ করা হয়; হুঁশিয়ার করা হয় এখানে প্রবেশ করলে একদিকে জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হবে এবং অন্যদিকে ইসরায়েলি আইনের লঙ্ঘন হবে।

এবারের জেরিকো ভ্রমণকালে স্থানীয় যোগাযোগ রক্ষাকারী ব্যক্তি ওসামা এলেওয়াত বলেন, দু'পক্ষের জনগণের চাহিদা বুঝে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের উচিত্ 'কদাকার' বাধা ভেঙ্গে ফেলা। তিনি বলেন,

"আমাদের দু'পক্ষের মধ্যে কিছু সীমানা রয়েছে। সবাই এটা পার হতে ভয় পায়। আমার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে দু'পক্ষকে জানিয়ে দেওয়া যে, আমরা সবাই স্বাভাবিক মানুষ। সবাই শান্তিতে বিশ্বাস করি। 'পৃথকীকরণ দেয়াল ভাঙ্গা' কথাটিতে শুধু মাটির উঁচু দেয়াল ভাঙ্গার কথা বোঝানো হচ্ছে না; বরং আমাদের হৃদয়ের উঁচু দেয়াল ভাঙ্গার কথা বলা হচ্ছে।

এ ভ্রমণ জেরিকো শহরের কেন্দ্রস্থলে আরামদায়ক অবস্থানে ইসরায়েলিদের ভয়কে সাময়িকভাবে ভুলিয়ে দেয়। কিছু সময়ের জন্য তারা সাধারণ পর্যটকের মতোই ভয়হীন সময় কাটান।

"আমি ও আমার ছোট বোন একটি ক্যাফেতে কিছুক্ষণ বসে কফি খেয়েছি এবং সড়কের দৃশ্য দেখেছি। সবকিছু স্বাভাবিক থাকবে। আমরা ভুলে যাই এটা একবারের বিশেষ ভ্রমণ এবং আমরা একটি বিশেষ পর্যটকদল। এ ধরনের অনুভূতি সত্যই ভাল।"

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
Play
Stop
ওয়েবরেডিও
বিশেষ আয়োজন
অনলাইন জরিপ
লিঙ্ক
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040