Web bengali.cri.cn   
হুমায়ুন আহমেদ: হিমু ও মিসির আলীর স্রষ্টা
  2013-11-14 10:46:47  cri


হুমায়ূন আহমেদ স্বাধীন বাংলাদেশের সবচে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার, গীতিকার এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা দুই শতাধিক। তাঁর বেশ কিছু গ্রন্থ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। হুমায়ুন আহমেদ ছবি আঁকতে পছন্দ করতেন। লিখতেন মাটিতে বসে। ছিলেন মজলিশী। গল্প করতেন, রসিকতা করতেন। ছিলেন স্বল্পবাক ও খানিকটা লাজুক প্রকৃতির।

১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই নভেম্বর নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার কুতুবপুরে তত্কালীন পূর্ব্পাকিস্তানে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ফয়জুর রহমান আহমদ এবং মাতার নাম আয়েশা আখতার খাতুন। তাঁর পিতা একজন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন এবং তিনি ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পিরোজপুর মহকুমার এসডিপিও হিসেবে কর্তব্যরত অবস্থায় শহীদ হন। ফয়জুর রহমান লেখালিখি করতেন ও পত্র-পত্রিকায় সেসব লেখা প্রকাশিতও হয়েছে। তার প্রকাশিত একটি গ্রন্থের দ্বীপ নেভা যার ঘরে। হুমায়ুন আহমেদের ছোট ভাই ডক্টর মুহম্মদ জাফর ইকবালএকজন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। তার আরেক ভাই আহসান হাবীব রম্য সাহিত্যিক ও কার্টুনিস্ট।

হুমায়ুন আহমেদ বগুড়া জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন এবং রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে সব গ্রুপে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। পরে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই বিজ্ঞান বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন শাস্ত্রে অধ্যয়ন করেন এবং প্রথম শ্রেণীতে বিএসসি (সম্মান) ও এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। পরে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পলিমার রসায়ন বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচডি লাভ করেন। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে তার কর্মজীবন শুরুহয়। ১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। ভীষণ জনপ্রিয় লেখক হিসেবে ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায়, তিনি একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজ ছেড়ে দেন।

ছাত্র জীবনে একটি নাতিদীর্ঘ উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যজীবনের শুরু। উপন্যাসটির নাম নন্দিত নরকে। ১৯৭২-এ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। তার দ্বিতীয় উপন্যাস শঙ্খনীল কারাগার। তার উপন্যাসের দুটি চরিত্র হিমুও মিসির আলী অসম্ভব জনপ্রিয়। বিশেষ করে হিমু চরিত্রটি তরুণ সমাজে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। তার আরেকটি সৃষ্ট আরেকটি জনপ্রিয় চরিত্র বাকের ভাই।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাস মধ্যাহ্ন তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা হিসেবে পরিগণিত। তার জোছনা ও জননীর গল্প ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তযুদ্ধ অবলম্বনে রচিত। তার আত্মজীবনীমূলক বেশ কয়েকটি গ্রন্থের মধ্যে আছে: বলপয়েন্ট, কাঠপেন্সিল, ফাউন্টেইন পেন, নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ, আমার ছেলেবেলা, হিজিবিজি ইত্যাদি।

বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে হুমায়ুন আহমেদ টেলিভিশনের জন্য নাটক লেখা শুরু করেন। নাট্যকার হিসেবে তিনি ছিলেন শতভাগ সফল। তার লেখা ধারাবাহিক নাটক এইসব দিন রাত্রি, বহুব্রীহি, কোথাও কেউ নেই, অয়োময়, আজ রবিবার ইত্যাদি অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তিনি অসংখ্য সাধারণ টিভি নাটকও লিখেছেন। ঈদে হুমায়ুন আহমেদের হাসির নাটক প্রচারিত হতো একাধিক টিভি চ্যানেলে।

টেলিভিশনের জন্য একের পর এক দর্শক-নন্দিত নাটক রচনার পর হুমায়ূন আহমেদ ১৯৯০-এর গোড়ার দিকে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা শুরু করেন। তাঁর পরিচালনায় প্রথম চলচ্চিত্র আগুনের পরশমণি মুক্তি পায় ১৯৯৪ সালে। চলচ্চিত্রটি মুক্তিযুদ্ধকে ভিত্তি করে নির্মিত। ২০০০ সালেমুক্তি পায় তার পরিচালিত শ্রাবণ মেঘের দিন ও ২০০১ সালে দুই দুয়ারী। ২০০৩-এ নির্মাণ করেন চন্দ্রকথা। ১৯৭১-এবাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ২০০৪ সালে নির্মাণ করেন শ্যামল ছায়া চলচ্চিত্রটি। ২০০৮-এ হুমায়ুন নির্মাণ করেন আমার আছে জল চলচ্চিত্রটি। ২০১২ সালে মুক্তি পায় হুমায়ূন পরিচালিত সর্বশেষ চলচ্চিত্র ঘেটুপুত্র কমলা। হুমায়ুন আহমেদ তার চলচ্চিত্রের জন্য গানও রচনা করেছেন। একজন গীতিকার হিসেবেও তিনি ছিলেন সফল।

হুমায়ূন আহমেদের লেখা উপন্যাস অবলম্বনে অন্য পরিচালকরা নির্মাণ করেছেন একাধিক চলচ্চিত্র। এসব চলচ্চিত্রের মধ্যে আছে নন্দিত নরকে, নিরন্তর, সাজঘর, দারুচিনি দ্বীপ ইত্যাদি।

বাংলা সাহিত্যের অসম্ভব জনপ্রিয় এই লেখক প্রায়ই বলতেন, "আমি মনের আনন্দে লিখি।" মনের আনন্দে তিনি লিখে গেছেন দুই শতাধিক গল্পগ্রন্থ ও উপন্যাস। তার লেখা শেষ উপন্যাস দেয়াল। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে লেখা উপন্যাসটি বেশ বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল।

লেখক হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন। পাশাপাশি তিনি অর্জন করেছেন অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা। তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার, শিশু একাডেমী পুরস্কার, একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার,লেখক শিবির পুরস্কার, মাইকেল মধুসুদন পদক, বাচশাস পুরস্কার, হুমায়ূন কাদির স্মৃতি পুরস্কার, জয়নুল আবেদীন স্বর্ণপদক পেয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার সময় ১৯৭৩খ্রিস্টাব্দে তিনি বিয়ে করেছিলেন গুলতেকিন আহমেদকে। তাদের তিন মেয়ে ও এক ছেলে। তিন মেয়ের নাম: বিপাশা আহমেদ, নোভা আহমেদ, শীলা আহমেদ। আর ছেলের নাম নুহাশ আহমেদ। ২০০৫ সালে গুলতেকিনের সঙ্গে তাঁর বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে এবং ঐ বছরই তিনি প্রতিভাবান অভিনেত্রী ও কণ্ঠশিল্পী মেহের আফরোজ শাওনকে বিয়ে করেন। হুমায়ূন-শাওনের দুই ছেলে নিষাদ হুমায়ূন ও নিনিত হুমায়ূন।

১৯৭১ খ্রিস্টাব্দেবাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী হুমায়ুন আহমেদকে গুলি করেছিল। সেদিন তিনি অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন। কিন্তু ক্যান্সারের কবল থেকে তিনি রেহাই পাননি। ২০১২ সালের ১৯ জুলাইনন্দিত নরকের এই নন্দিত লেখক চিকিত্সাধীন অবস্থায়যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।

(তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য)

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
Play
Stop
ওয়েবরেডিও
বিশেষ আয়োজন
অনলাইন জরিপ
লিঙ্ক
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040