বিদেশে চীনা সংস্কৃতির প্রচার করছে চীনা শিক্ষার্থীরা
2021-11-29 16:06:58

এখন বিশ্বায়নের যুগ। এ যুগে বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে আদান-প্রদান বাড়ছে। এক দেশের মানুষ অন্য দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। প্রাচীন সভ্যতা ও ঐতিহ্যিক সংস্কৃতি সম্পর্কে মানুষের আগ্রহও আগের চেয়ে বেড়েছে। চীনা সংস্কৃতি সম্পর্কেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ জানছেন। তাদের সামনে শুধু চীনাদের চপস্টিক বা মার্শাল আর্ট নয়, বরং অনেককিছুই তুলে ধরার আছে। আর এই তুলে ধরার কাজটা করছেন চীনা শিক্ষার্থীরাও।

আজকাল অনেক চীনা শিক্ষার্থী বিদেশে পড়াশোনা করছেন। তারা শুধু বিদেশে বসে লেখাপড়াই করেন না, বরং স্বদেশের ঐতিহ্যিক সংস্কৃতিও বিদেশিদের সামনে তুলে ধরার কাজ করেন।  আজকের আসরে লন্ডনে হান রাজবংশ আমলের পোশাক-আশাকের সঙ্গে স্থানীয়দের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কাজে জড়িত তিন চীনা শিক্ষার্থীদের কথা বলব।

২৩ বছর বয়সী ছেলে চেং থাও লন্ডনে হান রাজবংশ আমলের কাপড়চোপড় বিক্রির কারণে ইন্টারনেটে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। তিনি ব্রিটেনের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী।  তিনি অন্য দুই চীনা সহপাঠীকে সাথে নিয়ে প্রাচীন হান রাজবংশ আমলের স্টাইলের পোশাক  বিক্রি শুরু করেন। এ থেকে তার আয় বেশি না। কিন্তু তার কারণে অনেক বিদেশি বন্ধু হান রাজবংশ আমলের পোশাক সম্পর্কে জানতে পেরেছে এবং ঐতিহ্যিক চীনা সংস্কৃতির প্রতি তাদের আগ্রহও জন্মেছে। এটা এই তিন চীনা শিক্ষার্থীর জন্য বেশ উত্সাহব্যঞ্জক ব্যাপার।

বিদেশে চীনা সংস্কৃতির প্রচার করছে চীনা শিক্ষার্থীরা_fororder_hf1

চলতি বছরের ৩ অক্টোবর লন্ডনে তারা হান পোশাক বিক্রি শুরু করে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ছেলে চেং থাওর ব্রিটেনে পড়াশোনা করতে আসার কথা ছিল। তবে, কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে তিনি শুধু চীন থেকে অনলাইনে ক্লাস করতেন। চলতি বছরের মে মাসে শ্রেণিকক্ষের পাঠদান শুরু হয়। তখন তিনিও লন্ডনে যান। ক্লাসের শিক্ষক প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে নিজ নিজ ব্যবসার পরিকল্পনা প্রস্তুত করার এসাইনমেন্ট দেন। চেং থাও  বিদেশে হান আমলের পোশাক বিক্রির ব্যবসাসংক্রান্ত পরিকল্পনা পেশ করেন।

ব্রিটেনে আসার পর কয়েকজন চীনা শিক্ষার্থীর সাথে পরিচয় হয় চেংয়ের। মেই ছিং তাদের মধ্যে একজন। বেইজিংয়ে বড় হয়েছে মেয়ে মেই ছিং। আর প্রায় ১০ বছরের বেশি সময় ধরে বিদেশে জীবন কাটাচ্ছে। বিদেশে হান রাজবংশ আমলের পোশাক পরার অভিজ্ঞতাও তার রয়েছে। তাই তার আরেকজন মেয়ে বন্ধু মু ইয়ুকে নিয়ে চেং থাওয়ের প্রকল্পে অংশগ্রহণে সম্মত হয় সে। তারা ব্রিটেনে একটি হান পোশাকের দোকান খোলার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু তাদের হাতে যথেষ্ট অর্থ নেই। তবে তাদের জন্য আশার কথা ছিল, ব্রিটেনের বাজারে ভারতীয় ও জাপানি পোশাকের চাহিদা আছে। তারা ভাবল, যদি ব্রিটিশ ক্রেতারা ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের সাংস্কৃতিক পণ্য ক্রয়ে আগ্রহী হয়, তবে চীনা ঐতিহ্যিক পোশাকও তাদের মধ্যে জনপ্রিয় হতে পারে। তারা একসাথে লন্ডনের শহরাঞ্চলের কয়েকটি বড় বাজারে যায় এবং স্টল খরচসহ বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে। একবার তারা এক ট্যাক্সিচালকের কাছে লন্ডনের ৩০০ বছরেরও বেশি ঐতিহ্যিক বাজারের তথ্য জানতে পারে। অবশেষে সেখানে তাদের দোকান খোলার সিদ্ধান্ত নেয়।

চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝিতে স্নাতক পর্যায়ের থিসিস লেখা শেষ করে চেং। তখন থেকেই তিন জনের ব্যবসা-পরিকল্পনা আনুষ্ঠানিকভাবে বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়। তারা চীন থেকে হান আমলের স্টাইলের পোশাক ও গয়না কেনে এবং ধীরে ধীরে ব্যবসা শুরু করে।

বিদেশে চীনা সংস্কৃতির প্রচার করছে চীনা শিক্ষার্থীরা_fororder_hf2

৩ অক্টোবর ছিল তাদের প্রথম ব্যবসার দিন। সেদিন ছিল রোববার, সাপ্তাহিক ছুটির দিন। চীনে মোবাইল ই-কমার্স এখন ব্যাপকভাবে প্রচলিত। কিন্তু ব্রিটেনের বাজারে প্রধানত ক্রেডিটকার্ড ব্যবহার করেন ক্রেতারা। তারা বুঝলেন, তাদেরকে বিশেষ মেশিন কিনতে হবে। তবে ব্যক্তিগতভাবে এমন মেশিনের জন্য আবেদন করা খুবই জটিল ব্যাপার। চীনে এ ধরনের মেশিনের ব্যবহারও অনেক কমে গেছে। তিন জনের কেউ সেটা ব্যবহারও করতে পারে না। এ মেশিনের মাধ্যমে টাকা গ্রহণে অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয় তারা। এদিকে, ব্রিটেনের বাজারে দোকানের ভাড়া অনেক বেশি। তাই তারা ব্যবসার ক্ষতির জন্য প্রস্তুতি নেয়। তবে প্রথম দিনেই তারা মুনাফার মুখ দেখে। দোকানব্যয় বাদ দিয়ে তারা প্রত্যেকে ৩০ থেকে ৪০ পাউন্ড করে মুনাফা পায়, যা ছিল তাদের জন্য অনেক আনন্দের ব্যাপার।

চেং বলল, ‘আমাদের গয়না বেশ সস্তা। যেমন কাগজের পাখা মাত্র ৫ পাউন্ড এবং হাং পোশাকও প্রায় ৭০ থেকে ৮০ পাউন্ডের মতো। তাই সাধারণ মানুষের কাছে এগুলো জনপ্রিয়তা পায়। অন্যান্য স্টলের মালিকরা আমাদের পণ্যকে অনেক সস্তাই মনে করেন। তাদের কথা, এতো সস্তায় পণ্য বিক্রি করলে ব্যবসায় লস হবে।’  

চিংরা বাজার ঘুরে দেখার পর খেয়াল করে যে, আসলেই তাদের জিনিসের দাম খুব কম; এতে লাভও অনেক কম হয়। তখন তারা বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয় এবং পণ্যে মান উন্নয়নে মন দেয়। তারা চীনা হাতপাখাসহ বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যময় ক্ষুদ্র পণ্যও চীন থেকে নিয়ে আসে। স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য এমন জিনিস অতি আকর্ষণীয়। চীনের ঐতিহ্যিক হেয়ারপিন চুল সাজানোর কাজে লাগে। তাই নারীরা সেটি বেশ পছন্দ করেন। তবে তারা কিভাবে চীনের ঐতিহ্যিক হেয়ারপিন ব্যবহার করতে হয়, তা জানে না। তাই মেয়ে মেই ছিং ক্রেতাদের হেয়ারপিনের ব্যবহারও শিখিয়ে দেয়।

অনেক ব্রিটিশ বাচ্চা চীনের বিভিন্ন খেলনা অত্যন্ত পছন্দ করে। যেমন রটলের বিশেষ শব্দ শুনে বেশ মজা পায় তারা। তখন তিন জন চীনা শিক্ষার্থী রটল খেলার পদ্ধতিও বুঝিয়ে দেয় বাচ্চাদের। এতে আরও বেশি ক্রেতা তাদের পণ্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়।

তারা নিয়মিতই স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রশংসা শুনতে পায়। হান পোশাক তাদের দৃষ্টিতে অনেক সুন্দর। এক মাসের মধ্যেই ব্যবসায় মুনাফা করার পাশাপাশি তারা হান পোশাকের সঙ্গে স্থানীয়দের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কাজটি করে। এমন অভিজ্ঞতা স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্যও নতুন। একবার এক ব্রিটিশ বয়স্ক নারী নীল ও লাল রঙের একটি হান পোশাক বেশ পছন্দ করেন। তখন তিনি জানতে চান, তিনি এই পোশাক বড়দিনে পরতে পারেন কি না? তখন ছেলে চেং থাও তাঁকে বুঝিয়ে বলেন যে, এটা চীনা ঐতিহ্যিক পোশাক।

অনেক স্থানীয় শহরবাসী হান পোশাক নিয়ে নানান ধরনের প্রশ্ন করেন। একবার একজন পুরুষ তার মোবাইলে হান পোশাকের ছবি তুলে ছেলে চেং থাওকে দেখান এবং তাকে জিজ্ঞেস করেন, তাদের স্টলের কাপড় কি একই রকম কি না। তখন তিনি আসল কাপড় দেখে বেশ পছন্দ করেন।

বাজারের অন্যান্য স্টলের ব্যবসায়ীরাও নিয়মিত তাদের স্টলে বিভিন্ন ধরনের হান পোশাক দেখতে আসেন। পাশের ওড়না ব্যবসায়ী বুলগেরিয়া থেকে এসেছেন। তিনি পুরুষদের একটি বিশেষ হান পোশাকের ব্যাপারে বেশ আগ্রহ প্রকাশ করেন। তখন চেং তাকে বুঝিয়ে বলেন যে, সেটি প্রাচীনকালে রাজার এসকর্টের কাপড়। হান পোশাককে স্থানীয়দের মাঝে পরিচিত করতে গিয়ে চেং থাওয়ের ইংরেজি ভাষা আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। সে চীনের ঐতিহ্যিক সংস্কৃতি সম্পর্কেও অনেক নতুন তথ্য জেনেছে। এ সম্পর্কে সে বলল, বিদেশি বন্ধুদের চীনা সংস্কৃতি বুঝাতে হলে সহজভাবে তা ব্যাখ্যা করতে হবে। সেটি চীনের ঐতিহ্যিক সংস্কৃতি প্রচারের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

চেং সংবাদদাতাকে বলল, প্রায় এক মাস হলো স্টলের ব্যবসা চালু হয়েছে। এখন তাদের আয় ও ব্যয় প্রায় সমান সমান। তবে তারা মনে করে, এমন কাজের তাত্পর্য বেশি। কারণ, হান পোশাক বিক্রির মাধ্যমে তারা খেয়াল করে যে, বিদেশিরা চীনা সংস্কৃতি সম্পর্কে খুব কম জানে। তাদের স্টলের মাধ্যমে চীনা সংস্কৃতি সম্পর্কে বিদেশিরা বেশি করতে জানতে পারছে।

চেং থাও মনে করে, ইন্টারনেট থেকে স্টলের ভিডিও দেখে অনেক চীনা শিক্ষার্থী হান পোশাক পরে ঘুরতে আগ্রহী হয়ে ওঠে।  এটাও তাদের জন্য আনন্দের ব্যাপার। এ স্টল আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক বিনিময়ের প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে। হান পোশাক  বিক্রির পাশাপাশি বিদেশিদের সামনে চীনের ঐতিহ্যিক সংস্কৃতিও তারা তুলে ধরছে, যা তাত্পর্যপূর্ণ। ভবিষ্যতে মুনাফা বাড়াতে তারা নতুন ব্যবস্থা নেবে এবং আরো বেশি সুন্দর হান পোশাক বিদেশিদের সামনে উপস্থাপন করার চেষ্টা করবে বলে জানাল চেং।