চীনের এআই গবেষক চাং পো’র গল্প
2021-10-18 16:05:56

বর্তমান বিশ্বের মানুষ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে দ্রুত উন্নতি করছে। বিশেষ করে বিভিন্ন দেশে তথ্য-প্রযুক্তির দ্রুত উন্নয়ন ঘটছে ও এর প্রয়োগও বাড়ছে। আর এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি বিজ্ঞানের জগতের অতি গুরুত্বপূর্ণ এক অংশে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এআই প্রযুক্তির ব্যাপক প্রয়োগ মানবজাতির সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এআই প্রযুক্তি খাতে চীনের সাফল্য ছিল আকর্ষণীয়। চীন এখন বিশ্বের এআই প্রযুক্তির প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে বলা চলে। ‘এআই প্রযুক্তি উন্নয়ন, ২০২০’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুসারে, এআই প্রযুক্তি খাতে উচ্চপর্যায়ের সেরা ব্যক্তিদের সংখ্যা ও পেটেন্ট আবেদনের সংখ্যার দিক দিয়ে চীন বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষস্থানে রয়েছে। বলা বাহুল্য, চীনের এআই প্রযুক্তি খাতের দ্রুত উন্নয়ন চীনা বিজ্ঞানীদের যৌথ প্রয়াসের ফল। অধ্যাপক চাং পো তাঁদের মধ্যে একজন, যিনি ৪০ বছর আগে এআই প্রযুক্তি খাতে গবেষণাকাজ শুরু করেছিলেন। তিনিই চীনে প্রথম এআইবিষয়ক থিসিস প্রকাশ করেন।

চীনের এআই গবেষক চাং পো’র গল্প_fororder_zb1

এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন একটি সুপরিচিত টার্ম। অথচ ৪০ বছর আগেও টার্মটি ছিল চীনে পুরোপুরি অজানা। তখন চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতের লোকজনের কাছেও এই টার্মটি ছিল অপরিচিত। ১৯৭৮ সালে চীনের ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০ বছর শিক্ষকতার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অধ্যাপক চাং পো গবেষণার নতুন জগতে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত নেন। তার নতুন জগত হলো এআই তথা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগত। তখন অধ্যাপক চাংয়ের বয়স ৪৩ বছর। মধ্য-বয়সে গবেষণার জন্য নতুন বিষয় বেছে নেওয়া স্বাভাবিকভাবেই ছিল চ্যালেঞ্জিং। তখন চীনে এআই প্রযুক্তি সম্পর্কে কেউ তেমন কিছু জানতেন না। এর মানে তাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করা কেউ তখন দেশে ছিল না। এ সম্পর্কে অধ্যাপক চাং বলেন, ‘সেই সময় চীনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতের গবেষকদের এআই প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা ছিল খুবই সীমিত ও দুর্বল। এআইসংশ্লিষ্ট তথ্যও ছিল খুবই কম।’ তবে তখন আন্তর্জাতিক সমাজ এআই প্রযুক্তির গবেষণায় ২০ বছরেরও বেশি সময় অতিক্রম করে ফেলেছে। চীনের বৈদেশিক আদান-প্রদানের সাথে সাথে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দেশটির সহযোগিতাও ব্যাপকভাবে বাড়ে। ফলে বিদেশি বিজ্ঞানীদের সাথে মতবিনিময়ের সুযোগ পান অধ্যাপক চাং।

১৯৮০ সালে অধ্যাপক চাং যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করতে যান। তখন বিদেশি বিজ্ঞানীদের সাথে এআই বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি প্রায়শই বিব্রতকর প্রশ্নের মুখোমুখি হতেন। একবার এক বিজ্ঞানী তাকে বললেন, ‘তুমি চীন থেকে এসেছো। এআই প্রযুক্তি তো তোমার ভালো বোঝার কথা নয়!’ এমন কথা শুনে অধ্যাপক চাং সিদ্ধান্ত নিলেন যে, ভবিষ্যতে চীনের এআই প্রযুক্তিকে অবশ্যই বিশ্বমানে পৌঁছে দিতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনাকালে তিনি গণিত ও এআই প্রযুক্তির সংমিশ্রণের সুউজ্জ্বল সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা করেন। তখন তিনি ভাবেন যে, এআই প্রযুক্তির উন্নয়ন করতে চাইলে অবশ্যই গণিতের ব্যবহার করতে হবে। তাই তখন থেকে তিনি চীনের আনহুই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক চাং লিংয়ের সাথে সহযোগিতা করে এআই প্রযুক্তির গবেষণাকাজ শুরু করেন।

তখন আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ব্যয় ছিল অনেক বেশি। তাই দুই অধ্যাপক চিঠির মাধ্যমে মত বিনিময় করতেন। এ সম্পর্কে অধ্যাপক চাং পো বলেন, ‘তখন চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিমানে চিঠি আদান-প্রদানে ব্যয় হতো প্রায় ১০০ ইউয়ান। আর চিঠি পৌঁছাতে সময় লাগতো কমপক্ষে ২০ দিন। আমাদেরকে চিঠির ওজনও ঠিক রাখতে হতো। কারণ, ওজন একটু বেশি হলে খরচও বেড়ে যেতো। চিঠি লিখতে তুলনামূলকভাবে হাল্কা কাগজ ব্যবহার করতাম এবং চিঠি ছোট ছোট অক্ষরে লিখতাম।’

এভাবেই চলে চীনের এই দুই অধ্যাপকের মধ্যে এআই প্রযুক্তি খাতের গবেষণা-সহযোগিতা। প্রায় এক বছর পর দু’জন যৌথভাবে এআই প্রযুক্তির ওপর থিসিস লেখা সম্পন্ন করেন এবং তা সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। থিসিটি বিদেশি গবেষকদের ব্যাপক মনোযোগ আকর্ষণ করে। এ থিসিস অধ্যাপক চাংয়ের আশা ও আত্মবিশ্বাস অনেক বাড়িয়ে দেয়। চীনের এআই প্রযুক্তি উন্নয়নে আরও বেশি অবদান রাখার ব্যাপারে তিনি আরও বেশি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ওঠেন।

১৯৮২ সালের শুরুতে অধ্যাপক চাং যুক্তরাষ্ট্রের পড়াশোনা শেষ করে স্বদেশে ফিরে আসেন এবং এআই প্রযুক্তির গবেষণাকাজ আরও সম্প্রসারিত করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। এআই প্রযুক্তির ব্যাপক প্রয়োগের জন্য অধ্যাপক চাং অন্যান্য গবেষকদের সাথে নিয়ে চীনের দক্ষিণপশ্চিম ও উত্তরপূর্বাঞ্চলের অনেক কারখানায় জরিপ চালান। তাঁদের বিশ্বাস ছিল, এআই রোবট হবে ভবিষ্যতের চীনের একটি বড় চাহিদা। এ জরিপের ফলাফল অনুসারে, অধ্যাপক চাং ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এআই রোবট পরীক্ষাগার স্থাপন করেন এবং সংশ্লিষ্ট পরীক্ষার সরঞ্জামও কেনেন। উপযোগী সরঞ্জাম কিনতে অনেক বরাদ্দ প্রয়োজন। তখন তারা দেশি-বিদেশি কারখানাগুলোর সাথে যোগাযোগ করে অবশেষে পরীক্ষাগারের জন্য চীনের প্রথম রোবটিক বাহু স্থাপন করেন।

রোবটিক বাহু একটি জটিল জিনিস, যা এআই প্রযুক্তির শিল্পে প্রয়োগের দৃষ্টান্তস্বরূপ। ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এআই রোবট পরীক্ষাগারেও এই রোবটিক বাহু’র গুরুত্ব অনেক। তাই যখন রোবটিক বাহু বিমানে করে বেইজিংয়ে পৌঁছায়, তখন অধ্যাপক চাংও বিমানবন্দরে গিয়ে নিজে তা পরীক্ষাগারে নিয়ে আসেন।

নিজের পেশাগত জীবন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমার জীবনে মোট দুটি কাজ করেছি: একটি পড়াশোনা এবং আরেকটি ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজ।’ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পর তিনি টানা ৬০ বছর ধরে শিক্ষকতার কাজ করেছেন। তাঁর ছাত্র-ছাত্রী চীনের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। এআই প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করে তাঁর প্রায় ৯০ জন ছাত্র-ছাত্রী পিএইচডি করেছেন।

এআই প্রযুক্তির গবেষণা সম্পর্কে তিনি বলেন, আগেকার চীনে যে-কোনো কাজ শুরুর দিক ছিল কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং। কারণ, এখানে গবেষণাতথ্যের অভাব, হার্ডওয়্যার ও সফ্টওয়্যারের অভাব ছিল প্রকট। এমন পরিস্থিতিতে কেবল নিজেদের পরিশ্রমের ওপর ভিত্তি করে গবেষণা করতে হতো। অধ্যাপক চাং চাইতেন সেরা শিক্ষার্থীরা বিদেশে যাওয়ার পরিবর্তনে নিজের দেশে থেকেই লেখাপড়া করবে। তিনি মনোযোগ দিয়ে তাদের প্রশিক্ষণ দিতেন। অধিকাংশ সেরা শিক্ষার্থী তার কাছ থেকে এআই প্রযুক্তির ব্যবহার শেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অবশেষে তারা নিজেদের পরিশ্রমে এআই প্রযুক্তি মহলের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিও পরিণত হয়েছে।

জনাব চাং পো ১৯৮৩ সালে এআই প্রযুক্তির গবেষণায় কয়েকটি সাফল্য অর্জন করেন। ওই বছর আন্তর্জাতিক এআই সম্মেলন জার্মানিতে আয়োজিত হয়। তখন অধ্যাপক চাং পো এবং তাঁর সহপাঠী চাং লিং সে সম্মেলনে নিজেদের থিসিস তুলে ধরেন। ১৯৮৪ সালে দু’জন একসাথে ইউরোপের এআই প্রযুক্তির পুরস্কার লাভ করেন। এটি ছিল আন্তর্জাতিক মহলে সর্বপ্রথম চীনা এআই বিষেশজ্ঞের পুরস্কার অর্জন। ১৯৮৫ সালে তিনি চীনের প্রথম এআই রোবট পরীক্ষাগার স্থাপন করেন এবং ১৯৮৭ সালে তাঁর প্রথম এআইবিষয়ক ডক্টরেট শিক্ষার্থী স্নাতক হন। ১৯৯০ সালে তিনি সহকর্মীদের সাথে নিয়ে চীনের প্রথম এআই প্রযুক্তি ও ব্যবস্থার পরীক্ষাগার নির্মাণ করেন এবং ১৯৮৭ সাল থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তিনি চীনের উচ্চপ্রযুক্তির এআই রোবট পণ্ডিত দলের সদস্য হিসেবে কাজ করেন। ২০১৮ সালে ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এআই গবেষণাগার প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি এ গবেষণাগারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন।

গত ৪০ বছর ধরেই তিনি চীনের এআই প্রযুক্তির অগ্রগতির জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তিনি এসময়ের মধ্যে শতাধিক থিসিস প্রকাশ করেন এবং আইসিএল ইউরোপীয় এআই পুরস্কারসহ বিভিন্ন সাফল্য অর্জন করেন। বিশেষ করে, চীনের এআই প্রযুক্তির গবেষণা উন্নয়ন ও শিল্পে এআই প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে তিনি অবদান রেখেছেন। সংশ্লিষ্ট তথ্য থেকে জানা গেছে, চিত্র শনাক্তকরণ, কণ্ঠ শনাক্তকরণসহ বিভিন্ন প্রযুক্তিতে চীন বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষস্থানে রয়েছে। এআই প্রযুক্তির পেটেন্টের আবেদনের সংখ্যার দিক দিয়েও বিশ্বের প্রথম স্থানে রয়েছে চীন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, তৃতীয় প্রজন্মের এআই প্রযুক্তির উন্নয়নে চীনা বিজ্ঞানীরা আন্তর্জাতিক পণ্ডিতদের সঙ্গে সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছে। চীন এআই প্রযুক্তির উন্নয়নের পথ খুঁজে বের করেছে। চীনা জাতি ও দেশের উন্নয়ন আর মানবজাতির কল্যাণে চীনা বিজ্ঞানীরা আরও বেশি অবদান রাখতে সক্ষম।

অধ্যাপক চাং পো’র বয়স ৮৬ বছর। তিনি এখনও ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এআই গবেষণাগারের অনারারি ডিন হিসেবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির কোনো শেষ নেই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির পথে তার চলারও যেন কোনো শেষ নেই।(সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)