চীনের হ্যনান প্রদেশের হুই জেলার কিন্ডারগার্ডেনের প্রধান কুও ওয়েন ইয়ানের গল্প
2021-10-09 14:41:11

আগের অনুষ্ঠানে আমরা চীনের বিভিন্ন দরিদ্র এলাকা তথা গ্রামাঞ্চলের প্রাথমিক বা মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকদের গল্প তুলে ধরেছি। চীনের গ্রামাঞ্চলের পুনরুজ্জীবনের সাথে সাথে সেখানকার শিক্ষা খাতেও দ্রুত উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। এখন কেবল উচ্চশিক্ষা নয়, বরং কিন্ডারগার্টেন থেকে শিক্ষার ওপর মনোযোগ দেয় সরকার। আজকের অনুষ্ঠানে চীনের হ্যনান প্রদেশের হুই জেলার সিপিংলুও উপজেলার একটি কিন্ডারগার্টেনের প্রধান ম্যাডাম কুও ওয়েন ইয়ানের গল্প আপনাদের সাথে শেয়ার করবো। তার মাধ্যমে আপনারা জানতে পারবেন উনি কিভাবে গ্রামাঞ্চলের প্রিস্কুল শিক্ষাদানে নিজের অবদান রাখেন।

২০২১ সালে কুও ওয়েন ইয়ান চীনের সেরা শিক্ষকের পুরস্কার লাভ করেন। তিনি চীনের একমাত্র প্রতিষ্ঠাতা যিনি গ্রামাঞ্চলে কমিউনিটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন এবং সাথে সাথে কিন্ডারগার্টেনের প্রধানের দায়িত্ব পালন করে থাকেন।

২০০২ সালে ২০ বছর বয়সে কুও ওয়েন ইয়ান নোর্মল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পর কিন্ডারগার্টেন ও প্রাথমিক স্কুলে দুই বছরের মতো শিক্ষকতার কাজ করেন। বিয়ের পর তিনি একটি বাচ্চা জন্ম দেন এবং শিক্ষকতার চাকরিও ছেড়ে দেন। তারপর তাঁর ছেলে একটু বড় হয়ে কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি হয়। তার তখন আর ঘরে বসে দিন কাটতে চায় না। তাই তিনি স্থানীয় শিক্ষা বিভাগের পরীক্ষায় অংশ নেন এবং শীর্ষস্থান পেয়ে আবার কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক হন। তখন তাঁর বয়স ৩০ বছর।

চীনের হ্যনান প্রদেশের হুই জেলার কিন্ডারগার্ডেনের প্রধান কুও ওয়েন ইয়ানের গল্প_fororder_gwy1

হুই জেলা পাহাড়াঞ্চলে অবস্থিত; মোট আয়তন ২০০০ বর্গকিলোমিটার। তবে পাহাড়াঞ্চলের আয়তন ১০০৭ বর্গকিলোমিটার। তাই স্থানীয় ভৌগোলিক অবস্থা ভালো নয় এবং অর্থনীতিও দুর্বল। ফলে স্থানীয় পরিবারগুলোকে অনেক কষ্ট করে পাহাড়ের বাইরে বাচ্চাদের শিক্ষার জন্য পাঠাতে হয়। স্থানীয় পাহাড়াঞ্চলের বাচ্চাদের জন্য গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে ২০১২ সালে হুই জেলায় শিক্ষা ও সংস্কৃতি কেন্দ্র নির্মাণ করা হয় এবং সেখানে কিন্ডারগার্টেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও স্থাপন করা হয়।

কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা যথেষ্ঠ নয়, সেরা শিক্ষকও প্রয়োজন। যখন কুও ওয়েন ইয়ান আবার কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন, তখন কিন্ডারগার্টেনের প্রধান ম্যাডাম চাং ছিং এ্য ক্যান্সার আক্রান্ত হয়েছেন। যদিও শরীরের অবস্থা দিন দিন অবনতি হচ্ছিল, তথাপি তিনি পাহাড়াঞ্চলে মৌলিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে নতুন কিন্ডারগার্টেনে যান এবং শিক্ষক কুওকে সাথে নিয়ে যান।

আসলে কুও ওয়েন ইয়ানের ছোটবেলা গ্রামাঞ্চলে কেটেছে। তাই গ্রামের প্রতি তাঁর গভীর আবেগ ও ভালোবাসা রয়েছে। ম্যাডাম চাংয়ের অবস্থা জেনে তিনি কোনো দ্বিধা করেননি, দূরবর্তী এলাকার এ নতুন কিন্ডারগার্টেনে পৌঁছে যান।

মাত্র ৩ বছর পর ৪৭ বছর বয়সে ম্যাডাম চাং ছিং এ্য চিরদিনের মতো দুনিয়ার অন্য প্রান্তে চলে যান। তখন থেকে শিক্ষক কুও কিন্ডারগার্টেনের নতুন পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে শুরু করেন। বাচ্চাদের জন্য তিনি কাঁধে ভারী দায়িত্ব বহন করেন। অতীতকালের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, আগে এখানে বিদ্যুত্, পানি, চেয়ার ও টেবিল কিছুই ছিল না। টয়লেট ও দরজাও ছিল না। তাই প্রতিদিন সকালে অনেক দূর হেঁটে নির্মাণ সাইটে যেতে হতো। হাতে করে তারা কিন্ডারগার্টেনের বিভিন্ন জিনিস নিয়ে আসেন।

তারপর ক্লাসের প্রয়োজনে কিন্ডারগার্টেনে উদ্ভিদ বাগান নির্মিত হয়েছে। ভোর ৫টায় জেগে উঠে সংশ্লিষ্ট নির্মাণকাজ শুরু করতেন  কুও এবং মধ্যরাত পর্যন্ত কাজ চলতো। গ্রীষ্মকালে অতি গরম। এর মধ্যেই তিনি খালি পায়ে মাটিতে দাঁড়িয়ে ক্লাস নিতেন। মাঝে মাঝে পরিচিত লোক তাঁকে খুঁজতে কিন্ডারগার্টেনে আসেন। কিন্তু তাকে অফিসে বসে থাকতে কেউ দেখে না। তিনি সবসময়  কিন্ডারগার্টেনের বিভিন্ন জায়গা পর্যবেক্ষণ করে বেড়ান। ২০১৯ সালের জুন মাসে সংবাদদাতা শিক্ষক কুও’র গল্প তুলে ধরার জন্য ছুয়ানচুং কিন্ডারগার্টেনে যান। তবে দূরবর্তী এলাকার এ কিন্ডারগার্টেনের দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে যান তিনি। কারণ এখানে সবুজ গাছ ও উদ্ভিদ দেখা যায়,  ক্লাসের পরিবেশ শান্তিময় ও আরামপ্রদ। ক্লাসের বাচ্চাদের চোখে উষ্ণতা ও আন্তরিকতার আলো ছড়িয়ে পড়। এ দৃশ্য দেখে কেউ বিশ্বাস করতে পারবে না এটা দূরবর্তী এলাকার কিন্ডারগার্টেন!

এ সম্পর্কে কুও বলেন, জীবনযাপনের কষ্ট সমাধান করা সহজ। কিন্তু শিক্ষার দুর্বলতা, শিক্ষাসম্পদের অভাবসহ বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে অনেক বেশি কষ্ট তাকে সহ্য করতে হয়েছে। কিভাবে বাচ্চাদের জন্য উপযোগী ও আকর্ষণীয় প্রশিক্ষণ-কার্যক্রম প্রণয়ন করা যায়? সবকিছু শূন্য থেকে শুরু করতে হয়। তিনি চীনের প্রিস্কুল শিক্ষাদানের প্রতিষ্ঠাতা ছেন হ্য ছিনের শিক্ষাপদ্ধতি গবেষণা করে কিন্ডারগার্টেনের অবস্থা বিবেচনা করে সৃজনশীল তত্ত্ব চালু করেন। ছুয়ানচুং কিন্ডারগার্টেনের বাচ্চাদের জন্য প্রাকৃতিক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন তিনি, যাতে বাচ্চারা প্রকৃতিকে সম্মান করতে ও ভালোবাসতে পারে।

এ সম্পর্কে শিক্ষক কুও বলেন, শহরাঞ্চলের কিন্ডারগার্টেনের সঙ্গে তুলনা করলে গ্রামাঞ্চলের কিন্ডারগার্টেনের আধুনিক সম্পদ কম। তবে পাহাড়াঞ্চলের প্রাকৃতিক দৃশ্য, নদী ও ধানক্ষেত এবং কৃষিজাত প্রযুক্তি ও চার ঋতুর পরিবর্তন সুস্পষ্টভাবে অনুভব করা যায় এখানে। তাই বাচ্চারা প্রাকৃতিক পরিবেশে বড় হয়ে ওঠে।

ভূট্টার চামড়া শুকিয়ে যাওয়ার পর শহরে আবর্জনায় পরিণত হয়। তবে গ্রামাঞ্চলের বাচ্চাদের হাতে তা জুতা, কুশন আর ফুলে পরিণত হয়। ভূট্টার চামড়া দিয়ে তৈরি হস্তশিল্পকর্মের বিশেষ ক্লাস আছে কিন্ডারগার্টেনে। তা ছাড়া, শিক্ষকদের সহায়তায় ধানক্ষেতের পাশের বন্যফুল, শুকনো গাছের শাখা এবং কাগজের বক্সসহ বিভিন্ন জিনিস দিয়ে ফুল তৈরির ক্লাসও চালু আছে এখানে। এমন ক্লাসের মাধ্যমে বাচ্চারা সৃজনশীলতার চর্চা করতে সক্ষম।

বাচ্চাদের কিন্ডারগার্টেনে ভালো অভ্যাস তৈরি হয়, তবে ছুটির সময় বাড়িতে ফিরে গেলে পিতামাতা যদি এইভাবে তাদের অভ্যাসের মানদন্ড মেনে না চলে, তাহলে তাদের ভালো অভ্যাস কম সময়ের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। দীর্ঘকাল ধরে তা বাচ্চাদের স্বাস্থ্যকর উন্নয়নের জন্য ক্ষতিকর। এ সম্পর্কে শিক্ষক কুও বলেন, পিতামাতা ও কিন্ডারগার্টেন যৌথভাবে বাচ্চাদের শ্রেষ্ঠ অভ্যাস তৈরি করতে চাইলে পিতামাতার যৌথ প্রচেষ্টা ও পেশাগত শিক্ষার জ্ঞানও শেখা প্রয়োজন।

পিতামাতাদের বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষাদানের অভ্যাস গড়ে তুলতে শিক্ষক কুও শিক্ষাবিদদের আমন্ত্রণ জানিয়ে বিশেষ সেমিনার আয়োজন করেন এবং নিয়মিত শিক্ষকদের নিয়ে বাচ্চাদের পরিবার সফর করতে যান। যাতে বাচ্চাদের বাড়িতে থাকা ও পড়াশোনার অবস্থা জানা যায় এবং পিতামাতাদের আরো ভালভাবে বাচ্চাদের যত্ন নেওয়া শেখানো যায়।

পিতামাতাদের চেতনার পরিবর্তনে ২০১৪ সালে তিনি নতুন পদ্ধতিতে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা নেন। তিনি শিক্ষকদের দল নিয়ে চীনের প্রথম কিন্ডারগার্টেনভিত্তিক গ্রামাঞ্চলের কমিউনিটি বিশ্ববিদ্যালয় গঠন করেন। এ বিশেষ কমিউনিটি বিশ্ববিদ্যালয় কেবল পিতামাতাদের স্কুল নয়, কৃষকদের প্রযুক্তিগত একাডেমি নয়, বরং বড়দের সারা জীবনের স্কুল।

প্রতিবছর এ কমিউনিটি বিশ্ববিদ্যালয় নতুন উন্নয়ন ও পরিকল্পনা রচনা করে থাকে। নব্যতাপ্রবর্তন ও উন্নয়নের পথের শেষ প্রান্ত থাকে না, তাই থামতেও পারে না। এ সম্পর্কে শিক্ষক কুও বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ মানুষের শিক্ষা গ্রহণের প্রতিষ্ঠান, যারা গ্রামাঞ্চলে বসবাস করে থাকে, তাদের শিক্ষা গ্রহণে আরো সহজ ও সাধারণ পদ্ধতি চালু করা প্রয়োজন। সাধারণ মানুষের শিক্ষার চাহিদা পূরণ করা সম্ভব এভাবে।

শিক্ষক কুওয়ের নেতৃত্বে কমিউনিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেজর ৪টি থেকে ২৪টিতে উন্নীত হয়েছে। বিভিন্ন মেজর চালুও যুক্তিযুক্ত। বাচ্চাদের যত্ন নেওয়ার জ্ঞান, স্বাস্থ্য রক্ষার ক্লাস শিক্ষার্থীদের জীবনযাপনের চেতনা ও ধারণা উন্নত করেছে। চারুকলার ক্লাস, সংগীত ও বাদ্যযন্ত্র বাজানোসহ বিভিন্ন ক্লাসের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জীবনকে আরও বৈচিত্র্যময় করা সম্ভব হয়েছে। তা ছাড়া, রান্নাবান্না ও সাধারণ জীবনের সাথে জড়িত ক্লাসও ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

শিক্ষক কুও এবং তাঁর সহকর্মীরা কেবল কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক নয়, বরং কমিউনিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এখন গ্রামবাসীদের মধ্যে ঝগড়া ও মাজিয়াং খেলা খুবই কম দেখা যায়। তারা বরং গান গাওয়া ও বই পড়ায় এখন বেশি আগ্রহী।

গ্রামাঞ্চলের শিক্ষা খাতে অবদান রাখা শিক্ষক কুও’র দায়িত্ব ও তিনি এ নিয়ে আশাবাদী। তিনি সহকর্মীদের সাথে অবিরাম প্রচেষ্টার মাধ্যমে সুন্দর গ্রাম গড়ে তুলেছেন।

 

বিশ্ববিদ্যালয়ের দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তা প্রসঙ্গ

২০২১ সালের নতুন সেমিস্টার শুরু হয়েছে। এ বছর ঝড়বৃষ্টি, বন্যা বা কোভিড-‌১৯ মহামারীর কারণে বিভিন্ন শিক্ষার্থীর পরিবারের আর্থিক অবস্থা দুর্বল। তাদের সহায়তা দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয়, যাতে প্রত্যেক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে ও লেখাপড়া চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নতুন শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর বিস্তারিত তদন্ত সাপেক্ষে সহায়তা পাবে। যাদের পরিবার ঝড়বৃষ্টি, বন্যা বা মহামারীর কারণে দরিদ্রতর হয়েছে, তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে সহায়তা দেওয়া হবে। পাশাপাশি, এসব শিক্ষার্থীর নামও গোপন রাখা হবে।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা বিভাগ নতুন শিক্ষার্থীদের ভর্তির কাজে সহজতর সবুজ চ্যানেল স্থাপন করবে। যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়, তাদের নির্দিষ্ট ভর্তুকি ও সহায়তা দিতে হবে।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা বিভাগ রাষ্ট্রীয় পড়াশোনা ঋণসংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রেখে সংশ্লিষ্ট সহায়তানীতি সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের জানাবে। ঋণের পরিমাণ এমন হতে হবে যাতে শিক্ষার্থীদের চাহিদা মেটে। আবর পড়াশোনাশেষে সেই ঋণ ফেরত দিতেও শিক্ষার্থীদের উত্সাহিত করা হবে। ঋণের জন্য আবেদনের সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াও সহজতর করতে হবে। 

(সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)